নিরা যে আম্মার পাশে এসে বসেছে, প্রথমে বুঝতে পারিনি। আম্মার কথায় আমার সম্বিত ফিরলো, এর আগে মনোযোগ দিয়ে মোবাইল চালাচ্ছিলাম।
'তোমার কি সমস্যা, মা?'
'আন্টি, আমার চোখের সমস্যা।'
'ওহ। চোখে কম দেখো?'
'কিছুটা আন্টি। ছোট থেকেই সমস্যা। এখন একটু ইম্প্রুভ করছে। ডক্টর বলেছেন দু'তিনমাস পর আর চোখে চশমা দেয়া লাগবে না।'
আমি নিরার দিকে তাকাই। ও আমার দিকে না তাকিয়েও মুচকি মুচকি হাসে। কি ফাজিল মেয়েটা, ওকে বলা উচিতই হয় নাই আজকে মাকে নিয়ে হাসপাতালে আসবো। সুন্দর সুরসুর করে হাসপাতালে চলে এসেছে।
মা ওকে বললো, 'তুমি কিসে পড়ো?'
'অনার্স শেষ করলাম আন্টি। মাস্টার্স শুরু হবে আগামী মাসে।'
'কোন সাবজেক্ট?'
'কেমিস্ট্রি।'
'কোন ভার্সিটি?'
নিরা ভার্সিটির নাম বললো। মা অবাক হয়ে বললেন, 'আরে, আমার ছেলেও তো একই ভার্সিটিতে একই সাবজেক্টে পড়ে। হ্যাঁরে অনীক, তুই একে চিনিস না?'
আমার ততক্ষণে ঠান্ডা ঘাম ছুটে গেছে। আম্মা যদি কোনোভাবে জানে, নিরাকে আমি শুধু চিনিই না, আমাদের দু'বছরের রিলেশন, তাহলে এই হাসপাতালেই হয়তো আমার মুন্ডুপাত শুরু করবে। শুধু তাই না, বাবার কানেও যাবে কথাটা।
বাবা ভীষণ রাগী। তিনি এসব রিলেশনশিপ কিছুতেই দেখতে পারেন না। তার অবশ্য কারণ আছে। আমাদের ফ্যামিলিতে রিলেশনশিপের বিয়ের ইতিহাস ঠিক সুখকর নয়। আমার বড় ফুপি নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলেন, তার পরিবারের সবাই এই বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিন বছরের মাথায় ফুপির স্বামী আরেকটা বিয়ে করেন। আমি আমার পুরোটা জীবন ফুপির কষ্ট দেখে বড় হয়েছি।
আমার এক চাচারও রিলেশনের বিয়ে। তিনি পরিবারের একমাত্র ছেলে। ছেলের পছন্দে বাবা-মা না করেননি। শেষমেষ বছর না ঘুরতেই ছেলে বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যায়।
এমন বেশ কিছু ঘটনা আছে আমাদের পরিবারে। আমাদের পরিবার তাই লাভ ম্যারেজের একদম বিপক্ষে। তাদের যুক্তি, বাবা-মা এবং পরিবারের বড়রা দেখেশুনে যে বিয়ে দেবেন, তার চাইতে ভালো বিয়েতো আর হয় না। নিজেদের পছন্দের বিয়েতে আবেগটা থাকে, বিচক্ষণতা থাকে না।
আমাকেও কলেজে ওঠার পরপরই ভালো মতো তালিম দেয়া হয়েছিলো, কখনো যেন প্রেম না করি। আমিও এই শিক্ষা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছিলাম। ভার্সিটিতে উঠে যখন নিরাকে প্রথম দেখি, তখনও একবারও মনে হয়নি এই মেয়েটার প্রেমে পড়বো কখনো। কিন্তু...
মায়ের ডাকে আবার বর্তমানে ফিরে এলাম, 'এই, তুই একে চিনিস?'
আমি তাড়াতাড়ি বলি, 'না তো, উনাকে তো জীবনে এই প্রথম দেখলাম।'
নিরা মুচকি হেসে বলে, 'ভাইয়া, আপনি কোন ব্যাচ?'
আমি ঢোক গিলে বলি, 'উনত্রিশ।'
'এজন্যই ভাইয়া আপনি আমাকে দেখেন নাই, আমিও আপনাকে দেখি নাই। আপনার জুনিয়র আমি।'
মা বললেন, 'হ্যাঁ, তাইতো। তুমিতো অনার্স কমপ্লিট করলে, আর আমার ছেলে মাস্টার্স শেষ করে চাকরিতে ঢুকলো মাত্র। বুঝলা মা, ছেলেটা এত্তো মেধাবী, কিন্তু পড়তে চায় না একদম। এতো করে বললাম বিসিএসের প্রিপারেশনটা শেষ কর, তা না, ওর আগে চাকরি করা চাই। একটা কথাও শুনতে চায় না ফাজিলটা।'
নিরাকে দেখে মনে হচ্ছে ও অনেক কষ্টে হাসি চেপে আছে। কি যে বিপদ! মাকে দেখি ওর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন। এখন যদি ধরা পড়ে যাই? যেই একটু মনে হচ্ছিলো, বিপদ থেকে বেঁচে যাচ্ছি, মা কিছু বুঝতে পারেননি, তখনই আবার বিপদে ফেলে দিচ্ছে মেয়েটা।
প্রথম যেমন বিপদে ফেলেছিলো দু'বছর আগে। ওকে কে বলেছিলো সেদিন নীল শাড়িটা পরে আসতে? আমি তখন একটা নাটকের পার্ট করছি বাড়িতে না জানিয়ে, নিরা আমার নায়িকার রোলে। ওর সাথে আগে কখনো রিহার্সালে সমস্যা হয়নি, কিন্তু সেদিনই কি জানি হয়ে গেল। ওর দিকে তাকিয়ে সংলাপ বলতে বলতে বারবার আটকে যাচ্ছিলাম, আর ও মিটিমিটি হাসছিলো।
আজ যেমন হাসছে।
মা অবাক হয়ে বললেন, 'হাসছো কেন?'
নিরা বললো, 'আন্টি, আমারও এক ভাই আছে, এমনই ফাজিল। আমি বারবার বিসিএস প্রিপারেশন নিতে বলি, কিন্তু শুনেই না।'
মা আমার দিকে তাকালেন। আমার কান ততক্ষণে লাল হয়ে গেছে। মা বললো, 'কিরে, তুই ঘামছিস কেন?'
'গরম লাগছে।'
'এসিতে গরম লাগছে?'
নিরা বললো, 'আন্টি, এভাবে ঘামা তো স্বাভাবিক না। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে। উনাকে ডাক্তার দেখান শিগগির।'
মা মুচকি হেসে বললো, 'হু, দেখাবো। তা, তোমার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?'
'বাবা, মা আর ছোট ভাই।'
'বাবা কি করেন?'
'ডক্টর।'
'এই ক্লিনিকেই বসেন?'
'জ্বী না, আন্টি।'
'তাহলে এখানে এসেছো কেন?'
নিরা একটু চমকালো। তারপর মুচকি হেসে বললো, 'আব্বুই এখানে পাঠিয়েছেন আন্টি, এখানকার আই স্পেশালিস্ট আব্বুর বন্ধু।'
আম্মু বললো, 'এনামুল ভাই তোমার বাবার বন্ধু? উনি তো আমাদেরও খুব পরিচিত, তোমার আংকেলের বন্ধু। কি নাম তোমার আব্বার?'
'ডাক্তার এম. এম. সুলতান।'
'ওহ, এনামুল ভাই তো কখনো তার নাম বলেননি। দেখি, জিজ্ঞেস করবো।'
নিরা ঢোক গিললো। আমার তখন খুব রাগ লাগছে ওর উপর। কি দরকার ছিলো রিস্ক নিয়ে এভাবে আসার? ওর চোখের সমস্যা-টমস্যা কিছু নাই, এখানের আই স্পেশালিস্টও ওর আব্বুর পরিচিত নন। ও কেবল আসছে আম্মাকে দেখতে। ওর খুব ইচ্ছা, আম্মাকে পটাবে। আমি এতোবার বলেছি, লাভ হবে না, তবুও কানে দেয়না কথা। আজকে বুঝবে মজা।
মা নিরাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমরা থাকো কোথায়?'
'আন্টি, এলিফ্যান্ট রোড।'
'অনীক, তুই না মাঝে মাঝে এলিফ্যান্ট রোডে যাস, তোর কোন বন্ধুকে দেখতে?'
আয় হায়, মাকে এলিফ্যান্ট রোডের কথা কেন বলেছিলাম? তাড়াতাড়ি বলি, 'হ্যাঁ, যাই তো। আরিফের বাসা তো এলিফ্যান্ট রোডে।'
মা নিরার দিকে ফিরে বললেন, 'তুমি আরিফকে চেন?'
'না আন্টি।'
'তুমি তো তোমার ভার্সিটির কাউকেই চিনো না।'
আমি বললাম, 'মা, মনে হয় ছেলেদের চিনে না।'
'তুই কেমনে জানলি?'
'আমি কেমনে জানবো?'
'এইযে বললি।'
'মনে হয় বলেছিলাম।'
নিরা তাড়াতাড়ি বললো, 'আন্টি, আমি আসলেই ছেলেদের সাথে কম মিশি তো, তাই বড় ভাইদের চিনি না।'
'হু, বুঝতে পারছি। নাহলে তো অনীককে চিনতেই।'
'জ্বি আন্টি। উনাকে তো আজকেই প্রথম দেখছি।'
'আচ্ছা মা, তোমার কপালের কাটা দাগটা কিসের?'
'আন্টি, গতমাসে ইডেন অ্যামিউজমেন্ট পার্কে বেড়াতে গিয়ে একটা রাইড থেকে পড়ে গিয়ে একটু ব্যাথা পেয়েছিলাম।'
মা চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, 'তোরা গতমাসে ঐ পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলি না? তোরও না একটা বন্ধু এভাবে রাইড থেকে পড়ে ব্যাথা পেয়েছিলো, তাই বাসায় ফিরতে দেরি হয়েছিলো?'
এই রে, ফেঁসে গেছি মনে হচ্ছে। ঢোক গিলে বললাম, 'হ্যাঁ আম্মু, ঐটা আরেকটা ফ্রেন্ড। ছেলে ফ্রেন্ড।'
'কি আজব! সবাই ঐ রাইড থেকে পড়ে যায় নাকি?'
নিরা বললো, 'জ্বি আন্টি, অনেকেই পড়ে যায়।'
মা বললো, 'শুধু শুধু যে কেন এসবে মানুষ ওঠে?'
এর মধ্যেই সবচেয়ে বড় বিপদ ঘটে গেল। এনামুল আংকেল ওয়েটিং রুমে ঢুকলেন।
আম্মু ডাক দিলেন, 'এনামুল ভাই। ও এনামুল ভাই, এইদিকে...'
নিরা লাফিয়ে উঠে আম্মুকে বললো, 'আন্টি, আজ বাসায় যেতে হবে। আসি।'
'সে কি! চোখ দেখাবা না?'
'না আন্টি। আরেকদিন দেখাবো।' বলেই নিরা ছুটে বেরিয়ে গেল।
আম্মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, 'মেয়েটা এমন করলো কেন?'
'কে জানে?'
'ওর মনে হয় চোখ দেখানো না, অন্য কোন ধান্দা ছিলো। আজকালকার মেয়েরা! এদের পেটে পেটে থাকে ধান্দা। এসব মেয়েদের থেকে দূরে থাকবি, ঠিক আছে?'
আমি শুকনো মুখে মাথা নেড়ে বললাম, 'ঠিক আছে।'
সন্ধ্যায় নিরা ফোন দিয়ে বললো, 'রেজাল্ট কি?'
'নেগেটিভ। আম্মা তোমাকে একদমই পছন্দ করে নাই। আমাকে না জানিয়ে এভাবে ক্লিনিকে চলে এলে কেন আজ?'
নিরার মনটাও যেন খারাপ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে বললো, 'আমি কি জানতাম এমনটা হবে?'
আমি আর কিছু বললাম না। খারাপ লাগছিলো। মাকে রাজি না করে বাবা পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে না। সেই মা-ই যখন নারাজি, তখন বাবাকে মানাবো কিভাবে? নিরার সাথে সম্পর্কটা আর টিকলো না হয়তো।
রাতে খেতে বসে মা বাবাকে বললো, 'শুনো, আজকে ক্লিনিকে গিয়ে একটা মেয়ের সাথে দেখা হলো।'
আমি কান খাঁড়া করলাম, মা কি বলে শুনতে। এতো তাড়াতাড়ি মা বাবাকে নিরার কথা বলছে? নিশ্চয়ই সেই ধান্দাবাজির কথাই বলবে। নিরার সাথে সম্পর্কটা টেকার আর কোনো সম্ভাবনা নেই।
বাবা বললেন, 'তারপর?'
'মেয়েটা দেখতে যেমন মিষ্টি, কথাবার্তাও তেমনি সুন্দর।ফ্যামিলিও খুব ভালো।'
'তো?'
'ছেলের বিয়ে দিতে হবে না।'
আমি বিষম খেলাম। জোরে কাশতে শুরু করলাম। বাবা বললেন, 'কি হলো?'
'গলায় ভাত আটকেছে।'
'নে, নে। পানি খা।'
আমি পানি খেতে খেতেই বাবা মাকে বললেন, 'মেয়েটার ঠিকানা এনেছ?'
'ঠিকানা আনিনি, তবে বাড়ির ফোন নম্বর এনেছি। অনীক, মেয়েটার বাড়ির ফোন নাম্বার তোর বাবাকে দিস তো।'
বাবা তাকালেন আমার দিকে। আমি তাকালাম মায়ের দিকে। মা বললেন, 'এই গাধা, তোকে মেয়েটার বাড়ির ফোন নাম্বার নিতে বলেছিলাম না? নিস নাই?'
আমি মিনমিন করে বললাম, 'হু, নিয়েছি।'
'তাহলে তো হয়েই গেলো। তুমি সময় করে একটু ফোন দিও ওদের বাড়ি।'
খাবার শেষে আমি মাকে বললাম, 'তুমি তাহলে সবই জানতে?'
'কি?'
'আমার আর নিরার ব্যাপার?'
'হু। জানতাম। তোদের দুবছরের রিলেশন, নাটক করতে গিয়ে দেখা, সারারাত কথা বলা, সবই জানতাম আমি।'
'তাহলে ক্লিনিকে এমন অভিনয় করলে কেন?'
'তোরা অভিনয় করতে পারিস, আর আমি পারি না?'
'কিন্তু এতো কিছু তুমি জানলে কিভাবে?
ঘুম ভাঙতেই কেমন যেনো অবাক হয়ে গেলো রফিক। রাতে তার কখনোই ঘুম ভাঙে না। নিরিবিলি একা এই বাসায় সে সবসময়ই এক ঘুমে রাত পার করে দিয়েছে, তাহলে আজ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়ার কারণ টা কি? বুঝে উঠলো না সে।
বিছানা থেকে নামলো রফিক, বাথরুম পেয়েছে, হয়তো এই কারণেই ঘুম ভেঙেছে ভাবলো সে। হঠাৎ রফিক খেয়াল করলো পুরো বাসাটা কেমন যেনো ঠান্ডা হয়ে আছে, জুন মাসের এই গরমে বাসা এতো ঠান্ডা কিভাবে হলো ভেবে পেলো না সে, বৃষ্টি হয়েছে নাকি? বৃষ্টি হলেও তো এতো ঠান্ডা হবার কথা না। মনে হচ্ছে যেনো হিমালয়ে এসে পরেছে সে।
কাঁপতে কাঁপতে রফিক বাথরুমে ঢুকলো, বাথরুমের আয়নায় তাকালো সে, কয়েক মুহূর্ত ধরে আয়নায় তাকিয়ে রইলো সে। আয়নার দিকে তাকিয়ে তার বারবার শুধু মনে হচ্ছে কিছু একটা যেনো ঠিক নেই, কিছু একটা সমস্যা আছে, ঠিক কি সমস্যা তা বুঝে উঠতে পারছে না সে।
আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠলো রফিক, এবার সে বুঝতে পারছে সমস্যাটা আসলে কোথায়… আয়নায় সে নিজের যে প্রতিবিম্বকে দেখতে পাচ্ছে সেটি ডানে বায়ে দুলছে, অনেকটা ঘুমের ঘোরে মানুষ যেরকম দুই পাশে দুলতে থাকে সেরকম অথচ রফিক আয়নার সামনে একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে যদি আয়নার সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই থাকে তাহলে আয়নায় তার প্রতিবিম্বটি দুলছে কিভাবে? কিছু ভাবতে পারছে না সে।
রফিক অনেক কষ্টে মাথা ঠান্ডা করলো। ঠান্ডা ও পরিষ্কার ভাবে চিন্তা করতে হবে।
সে মাত্রই ঘুম থেকে উঠে এসেছে, ঘুমের ঘোর এখনো পুরোপুরি কাটে নি, এ কারণেই হয়তো ভুলভাল দেখছে সে। আয়নার দিকে আবারো তাকালো রফিক, আয়নায় তার প্রতিবিম্বটি এখনো হাল্কা ভাবে ডানে বায়ে দুলছে, দেখে মনে হয় যেনো নাচছে প্রতিবিম্বটি। রফিক ভয়েভয়ে তার একটি হাত উপরে উঠালো, কিন্তু তার আয়নার প্রতিবিম্বটির হাত উঠলো না, সে দুলতেই থাকলো।
আস্তে আস্তে রফিকের মনের ভেতর তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক, অমানুষিক এক আতঙ্ক। বিস্ফোরিত চোখে সে তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে। আয়নায় তার প্রতিবিম্বটি হঠাৎ দুলুনি থামিয়ে দিলো, কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো প্রতিবিম্বটি, তারপর ধীরে ধীরে মুখ হা করে জিহ্বা বের করলো, অস্বাভাবিক লম্বা সেই জিহ্বাটি কুচকুচে কালো।
দুই চোখে প্রচন্ড আতঙ্ক নিয়ে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছে রফিক, সে নিজে মুখ বন্ধ করে আয়নায় তাকিয়ে আছে অথচ তার আয়নার প্রতিবিম্বটি কুচকুচে কালো জিহ্বা বের করে তারই দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!
ভয় পেলো রফিক! প্রচন্ড ভয়! চিৎকার করে সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এক দৌড়ে নিজের শোবার ঘরে চলে এলো।
শোবার ঘরের বড় আয়নাটাতে চোখ চলে গেলো তার, শোবার ঘরের আয়নাতেও তার প্রতিবিম্বটি একই রকম ভাবে লম্বা কুচকুচে কালো জিহ্বা বের করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আতঙ্কে মাথা কাজ করছে না রফিকের, শোবার ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়ে রান্না ঘরে চলে এলো সে, রান্নাঘরের জানালা দিয়ে পাশের বাসার বসার ঘর দেখা যায়, সেই বসার ঘরের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে রফিক ডাকলো, "ভাই! কেউ আছেন বাসায়?? ভাই আমার অনেক বড় বিপদ! কেউ বাঁচান আমাকে!" রফিকের প্রাণান্তকর চিৎকারেও পাশের বাসায় কাউকে দেখা গেলো না, আশেপাশের সবকিছু নিশ্চুপ।
রফিক দ্রুতপায়ে রান্নাঘর থেকে বেরোতেই দেখলো ফ্রিজের ওপরে একটি বিশাল আয়না রাখা, সেই আয়নাতেও তার প্রতিবিম্ব একই ভাবে কালো জিহ্বা বের করে তার দিকে তাকিয়ে আছে, অথচ রফিক ভালো করেই জানে যে তার বাসার রান্নাঘরে কখনোই কোনো আয়না ছিলো না, তাহলে এই আয়না কোথা থেকে এলো?
রফিক কিচ্ছু ভাবতে পারছে না। হঠাৎ সে খেয়াল করলো আয়নায় তার প্রতিবিম্বটি ডেকে উঠলো "রফিক!"
ঠিক একই সময়ে তার বাসার বাথরুমের আয়না ও শোবার ঘরের আয়নাতে তার প্রতিবিম্ব গুলো একই ভাবে "রফিক" বলে ডেকে উঠলো।
বাথরুম, শোবার ঘর ও রান্নাঘরের আয়নায় রফিকের প্রতিবিম্বগুলি আবারো হাল্কাভাবে ডানে বায়ে দুলছে এবং বারবার ডাকছে "রফিক! রফিক! রফিক!"
রফিক আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না, হাটু ভেঙে রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে গেলো সে। প্রচন্ড আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে সে, মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না তার। তার বাসাটি প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে আছে এখন, বাসার তাপমাত্রা মনে হয় যেনো হিমাঙ্কেরও নিচে চলে গিয়েছে৷
"রফিক! রফিক! রফিক! রফিক!"
আয়নাগুলো থেকে আরো জোরে জোরে তার নাম ডাকার শব্দ আসছে।
প্রচন্ড ভয়, আতঙ্ক ও ঠান্ডায় রফিক উঠে দাঁড়াতেও পারছে না। হঠাৎ সে এক অমানুষিক আতঙ্ক নিয়ে দেখলো যে তার সামনে কয়েক ফুট দূরে প্রায় ১৫/২০ টি আয়না সারিবদ্ধ ভাবে রাখা, প্রতিটি আয়নাতেই তার নিজের প্রতিবিম্ব, প্রতিবিম্বগুলি ডানে বায়ে দুলছে এবং প্রচন্ড জোরে জোরে তার নাম ধরে ডাকছে "রফিক! রফিক! রফিক!"
প্রচন্ড চিৎকারে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়।
এতো আয়না কোথা থেকে এলো এই বাসায়? এসব কি?
আর কিছু ভাবতে পারছে না রফিক, তার শরীর হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীদের মতো কাঁপতে লাগলো, মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙতে লাগলো।
প্রায় ৪ দিন পর রফিকের বাসার দরজা ভেঙে তার মৃতদেহ উদ্ধার করলো পুলিশ ও প্রতিবেশী। পুলিশ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে পুরো বাসায় ১০০টিরও বেশি নানান রকমের আয়না ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। প্রতিটি আয়নার কাঁচ ভাঙা।