প্রচন্ড গরম, উত্তপ্ত বালুকাময় পথ সহ্য করে হযরত মূসা (আঃ) মিশর থেকে মাদইয়ানে পৌঁছেছেন। এখন তিনি ফিরআউনী শত্রম্ন কর্তৃক ধৃত হবার দূর্ভাবনা মুক্ত, কিন্তু তিনি তখনও অবহিত হতে পারেন নাই যে, তিনি মাদইয়ানে উপনীত হয়েছেন। দীর্ঘ পথ চলার শ্রান্ত্মিজনিত অবসান্নতা, তদুপরি ক্ষুধা তৃষ্ণা, সব মিলিয়ে তিনি অত্যন্ত্ম দুর্বল হয়ে পড়েন। তাই দৈহিক অবসাদ অবসন্নতা দূরীকরণার্থে তিনি এক বৃক্ষ ছায়ার অবস্থান গ্রহণ করেন। বৃক্ষর অদূরেই একটি পানির কুয়া রয়েছে। তিনি দেখলেন, অনেক লোক স্ব স্ব পশুকে পানি পান করানোর উদ্দেশে সেখানে একত্র হয়েছে। একে একে সবাই নিজ নিজ পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে যাচ্ছে। দুইটি মেয়েও কয়েকটি পশু নিয়ে এনেছিলো পানি পান করানোর জন্য, কিন্ত্মু তারা রাখাল দলের ভিড় এড়িয়ে দূরে দাড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে এরা অভিজাত নন্দিনী। তাই কুপের পাড়ে এসে রাখাল ছেলেদের সাথে তালগোলে এক সাথে নিজেদের পশুগুলোকে পানি পান করানো তাদের জন্য সম্ভব হয়ে উঠছে না। তিনি বৃক্ষ ছায়ার উপবেশন করে মেয়ে দুইটির অবস্থা সচকিত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কিন্তু তাদের পশুগুলো বার বার পানির প্রতি ধাবমান হচ্ছে আর তারা সেগুলোকে ফিরিয়ে রাখছে। কুপের পাড়ে আগত এ দুইটি মেয়ে হযরত শোয়াইব (আঃ) এর কন্যা। শোয়াইব (আঃ) এ সময় বয়সের ভারে ন্যূব্জ। তাঁর কোন পুত্র সন্ত্মান ছিল না। তদুপরি তার পরিবারে এমন কোন পুরম্নষ লোকও ছিলো না যে, ঘর গৃহস্থালীর এসব কাজ করতে পারে। বয়সের কারনে তিনি নিজেও এসব কাজে অক্ষম। তাই একান্ত্ম বাধ্য হয়েই তাঁর কন্যাদ্বয়ের ঘর গৃহস্থলীর কাজ করতে হয়। শোয়াইব (আঃ) এর কন্যাদ্বয়ের বড় জনের নাম সফুরা আর ছোট জনের নাম সগূরা বলে জানা যায়। পরবর্তীতে সফূরা মূসা (আ:) এর পত্নিত্বে বরিত হন। মূসা (আঃ) এগিয়ে গিয়ে বোনদ্বয়কে অপেক্ষার কারন জিজ্ঞাসা করলে তারা নিজেদের পারিবারিক অবস্থা বিবৃত করে বলল, পুরম্নষের ভিড় ঠেলে কাজ করা আমাদের পছন্দনীয় নয়। একান্ত্ম বাধ্য হয়েই আমরা এখানে এসেছি। পরিবারে সক্ষম কোন পুরম্নষ মানুষ থাকলে আমরা আসতাম না। এখন আমরা রাখালদের প্রস্থানের অপেক্ষা করছি। প্রতিদিন আমরা তাই করে থাকি। তারা চলে গেলেই আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করাই। তাদের কথাবার্তা শুনে তারা যে অভিজাত বংশের নন্দিনী, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত হন এবং তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। তিনি রাখালদের ভিড় ঠেলে তাদের পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে দিয়ে পুনরায় বৃক্ষ ছায়ায় গিয়ে উপবেশন করেন। কন্যাদ্বয় স্বগৃহ অভিমুখে চলে যায়। মাদইয়ানের কূপের নিকট উপনীত হওয়া এবং শোআইব (আঃ) এর কন্যাদ্বয়ের পশুগুলোকে পানি পান করানো, তাদের সাথে কথোপকথন ইত্যাদি সম্পর্কে আলস্নাহ তা’য়ালা কোরাআন মাজিদে বলেন-
ولما ورد ماء مدين وجد عليه امة من الناس يسقون ووجد من دونهم امراتين تذودان قال ماخطبكما قالتا لانسقي حتي يصدر الرعاء وابونا شيخ كبير.
অর্থঃ আর যখন তিনি মাদইয়ানের পানির কূপের নিকট উপনীত হলেন, তখন এক দল লোক দেখতে পেলেন যারা (নিজ নিজ পশুকে) পানি পান করাচ্ছে, আর তাদের পিছনে দুই জন স্ত্রীলোককে দাঁড়ানো দেখলেন, তিনি (মূসা আঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের উদ্দেশ্য কি? তারা বলল, যে যাবত এ রাখাল দল (তাদের পশুগুলোকে) পানি পান করিয়ে দূরে সরে না যাবে, ততক্ষন আমরা পানি পান করাবো না। আর আমাদের পিতা অতিশয় বৃদ্ধ। [সূরাঃ কাসাস, আয়াতঃ ২৩]
পশুগুলোকে পানি পান করাতে এসে শোয়াইব (আঃ) এর কন্যাদ্বয়ের অপেক্ষার কারণ সম্পর্কে আরেকটি বনর্ণাও রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, যেদিন হযরত মূসা (আঃ) মাদইয়ানের কূপের পাড়ে উপনীত হন, সেদিন শোয়ইব (আঃ) এর কন্যাদ্বয়কে রাখালদের ভীড়ের সাথে সাথে আরেকটি কারণেও তথায় অপেক্ষা করতে হয়েছে। তা হচ্ছে, রাখালরা নিজেদের পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে যাবার সময় কূপের মুখে পাথর চাপা দিয়ে যায়। এ পাথরটি ছিল অত্যন্ত্ম ভারী। এটি সরাতে চলিস্নশ জন লোকের প্রয়োজন পড়তো। আর যে ডোল দিয়ে পানি উঠাতে হত সেটিও অত্যন্ত্ম ভারী ছিল বিধায় রাখালদের চলে যাবার পরও শোয়াইব (আঃ) এর কন্যাদ্বয়কে কূপ রক্ষীদের আগমণের অপেক্ষা করতে হয়েছে। তারা এলে কূপের মুখের পাথর সরাবে এবং ডোল দিয়ে পানি উঠিয়ে দিবে, তবেই তারা নিজেদের পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে ঘরে ফিরে যাবে। মুসা (আঃ) দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত্ম তাদেরকে অপেক্ষারত দেখে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা রাখালদের ভীড়, কূপের পাথর এবং ভারী ডোল দিয়ে পানি উঠাতে না পারার কথা ব্যক্ত করে। তাদের কথা শুনে মূসা (আঃ) একাই কূপের মুখের পাথর তুলে পানি উঠিয়ে দেন এবং কন্যাদ্বয় পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে গৃহঅভিমুখে ফিরে যায়। মেয়ে দুক্ষটি চলে যার মুসা (আঃ) পুনরায় বৃক্ষ ছায়ায় গিয়ে বসে পড়েন। এসময় তাঁর ক্ষুধা তৃষ্ণা এবং দৈহিক অক্ষমতা অবসাদগ্রস্থতা তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে। এ সম্পর্কে আলস্নাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন-
فسقي لهما ثم تولي الي الظل فقال رب اني لما انزلت الي من خير فقير-
অর্থঃ অনন্ত্মর মুসা (আঃ) তাদের (শোয়াইব (আঃ) এর কন্যাদ্বয়ের) পশুগুলোকে পানি পান করালেন, অতঃপর (তথা হতে) সরে গিয়ে ছায়ায় বসলেন। তখন দোয়া করলেন, হে আমার রব! আমার প্রতি আপনি যে নেয়ামত পাঠান আমি তার মুখাপেক্ষী। -(সুরাঃ কাসাস, আয়াতঃ ২৪)
মুসা (আঃ) শোয়াইব (আঃ) এর কন্যাদ্বয়ের পশুগুলোকে পানি উঠিয়ে দেবার পর তারা কোন প্রকার কথাবার্তা ছাড়াই চলে গেলেও মূসা (আঃ)- এর নৈতিক শুচি শুদ্ধতা, মার্জিত আচরণ, চলন-বলন, অনন্য দৈহিক শক্তি সামর্থ্য ইত্যাদি গুণ-বৈশিষ্ট্য তাদের দৃষ্টি এড়াতে পারে নাই। কারণ, তারা পাথর সরানো, ডোল বয়ে পানি উঠানোতে দৈহিক শক্তিমত্তা এবং তাদের কথাবার্তায় নৈতিক শুচি শুদ্ধতার স্বাক্ষর পেয়েছেন। ঘরে ফিরেও দুই বোন এ অপরিচিত যুবকের মাঝে পরিদৃষ্ট গুণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছিলেন। তাদের কথার আওয়াজ হযরত শোয়ইব (আঃ)- এর কর্ণগোচর হয়। কেননা, অন্য দিন তারা এত দ্রম্নত ঘরে ফিরতে পারে না। আজকে কি করে সম্ভব হলো তা জিজ্ঞাসা করেন। তারা পিতার কাছে ঘটনা সবিস্ত্মরে বিবৃত করল। তারা এও বলল, যুবকটি অতুল দৈহিক শক্তি ও সুঠাম দেহের অধিকারী, পুণ্যবান ও আমানতদার। সুতরাং আমাদের মনে হয়, এ যুবক কে আমাদের ঘর গৃহস্থলীর কাজের জন্য রেখে দিলে ভাল হবে। কারণ, যে কোন কাজ সূক্ষভাবে সমাধার জন্য দৈহিক শক্তিমত্তা এবং আমানতদারি- এ দুটি গুণ বৈশিষ্ট্যই সর্বাধিক প্রয়োজন। হযরত শোয়াইব (আঃ)ও ঘর গৃহস্থলীর কাজ সুষ্ঠভাবে সমাধার জন্য দৈহিক শক্তিমত্তার অধিকারী একজন আমানতদার লোকের প্রয়োজন অনুভব করছিলেন। কন্যাদ্বয়ের নিকট যুবকের কথা জানতে পেরে তিনি তাকে ডেকে আনার জন্য কন্যা "সফুরা" কে পাঠান। শোয়াইব (আঃ) এর কন্যা সফুরা অতি সংযত ভাবে, বেশবাসে সমকালে প্রচলিত পর্দারীতি রক্ষা করে মূসা (আঃ)- কে ডেকে আনার উদ্দেশে গমন করেন। এ সম্পর্কে আলস্নাহ