একদিন সকালে একটা বুড়ো ভলো ইঁদুর গর্ত থেকে তার মাথাটা বার করে দিল। তার ছোটো ছোটো চোখ দুটো চকচকে, শক্ত গোঁফ জোড়া ধূসর রঙের আর ন্যাজটা হচ্ছে কালো ভারতীয় রবারের মতো। ছোটো-ছোটো হাঁসগুলো সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছিল পুকুরে দেখতে তাদের হলদে ক্যানারি পাখির মতো। তাদের মার পা দুটো সত্যিকার লাল। কেমন করে জলে। মাথার ওপরে দাঁড়াতে হয় মা তাদের সেই শিক্ষাই দিচ্ছিল। সে তার বাচ্চাদের বারবার সাবধান করে দিচ্ছিল—’মাথার ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়াতে না শিখলে কোনো উঁচু সমাজে তোমরা কলকে পাবে না।’ কিন্তু বাচ্চারা সেকথা গ্রাহ্যই করছে না। বাচ্চা বলেই বোধ হয় সভ্য সমাজে ঢুকতে পারার সুবিধে কত তা তারা জানত না।
জলের ইঁদুর চিৎকার করে উঠল-বেয়াদপ ছোকরা সব বটে! ওদের ডুবে মরাই ভালো। মা-হাঁসটা বলল–মোটেই না। প্রত্যেককেই শেখার সুযোগ দিতে হয়। তাছাড়া, মাদের কোনো বিষযেই ধৈর্য হারালে চলে না।
জলের ইঁদুর বলল–তাই নাকি! তা, বাপ-মাযের অনুভূতির সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। সংসার বলতে কি নেই আমার। আসল কথাটা হচ্ছে, আমি কোনো দিন বিয়ে করিনি ভবিষ্যতে বিয়ে করার ইচ্ছেও আমার নেই। একদিক থেকে প্রেম জিনিসটা ভালোই; তবে অনুগত বন্ধুত্ব তার চেয়েও ভালো।
কাছাকাছি একটা উইলো গাছের ডালে একটা সবুজ রঙের লিনেট পাখি বসেছিল। ওদের আলোচনা শুনে সে বলল–তাই বুঝি! কিন্তু জিজ্ঞাসা করি অনুগত বন্ধুর দায়-দায়িত্ব কী?
মা-হাঁসটা বলল–হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক ওই কথাটা আমিও জানতে চাই। এই বলে সে সাঁতার কাটতে কাটতে পুকুরের আর একপাশে গিয়ে কেমন করে মাথার ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়াতে হয় সেইটাই তার বাচ্চাদের দেখাতে লাগল।
জলের ইঁদুর বলল–কী বোকার মতো যে প্রশ্ন কর! আমার অনুগত বন্ধু যে হবে সে আমার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করবে এটা অবশ্যই আমি চাই।
ছোটো-ছোটো পাখনা উড়িয়ে আকাশে ভাসতে-ভাসতে বাচ্চা পাখিটা ডিজ্ঞাসা করল–আর প্রতিদানে কী করতে হবে তোমাকে?
জলের উঁদুর বলল–কী যে ছাই-ভস্ম সব বল আমার তা মাথায় ঢোকে না।
লিনেট বলল–একটা গল্প শোন।
আমার সম্বন্ধে! তাহলে শুনব। গল্প শুনতে আমার খুব ভালো লাগে।
লিনেট বলল–এ গল্প তোমার সম্বন্ধেও খাটবে। এই বলে সে উড়ে গিয়ে পুকুরের ধারে বসে গল্প শুরু করল। এক সময় হ্যানস নামে একটা সৎ জীব বাস করত।
বেশ সম্ভ্রান্ত গোছের?–জিজ্ঞাসা করল জলের ইঁদুর।
লিনেট বলল–না। সদ্য হৃদ্য আর পরিচ্ছন্ন হাসিখুশি ছাড়া তার মধ্যে আর কিছু সম্ভ্রান্ত । ছিল বলে আমার মনে হয় না। একা-একা সে ছোটো একটা ঘরে থাকত; আর প্রতিটি দিনই সে বাগানে কাজ করত। সারা দেশে তার বাগানের মতো সুন্দর বাগান আর কারও ছিল না। সব ঋতুতেই তার বাগানে সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে থাকত।
অনেক বন্ধু ছিল মানুষটির; কিন্তু তার সবচেয়ে অনুরক্ত বন্ধু ছিল মিলার হিউ। সত্যি কথা বলতে কি এই ধনী হিউ তার এতই অনুরক্ত ছিল যে এমন কোনো দিন সে বাগানের পাশ দিযে যায়নি যেদিন যে বাগানের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বড়ো একটা সুন্দর ফুলের গুচ্ছ অথবা পকেট ভর্তি করে প্লাম আর চেরি তুলে নিয়ে যায়নি–অবশ্য বাগানে সেগুলি থাকলে।
মিলার হিউ বলত–সত্যিকার বন্ধু তারা যারা একজনের জিনিস সবাই মিলে ভাগ করে নেয়।
এই কথা শুনে হ্যানস হাসত আর ভাবত এত উঁচু আদর্শবাদী বন্ধু আর কার রয়েছে?
মাঝে-মাঝে অনেকেই অবাক হয়ে ভাবত ওই ধনী হিউ, যার কলে একশ বস্তা ময়দা সব সময় মত হয়ে থাকে, যার রয়েছে দু’টা দুধওয়ালা গরু আর লম্বা-লম্বা সুন্দর লোমশ অজস্র ভেড়া–সেই মানুষটি হ্যানসকে প্রতিদানে কখনো কিছু দেয় না কেন। কিন্তু এসবু। ছোটোখাটো ব্যাপার নিযে হ্যানস কোনো দিন মাথা ঘামাত না। বন্ধুদের নিঃস্বার্থপর দানের সম্বন্ধে মিলার হিউ যে সমস্ত লম্বা-লম্বা বক্তৃতা দিত, হ্যানস সেই সব বক্তৃতা খুব মন দিযে শুনত আর উপভোগ করত।
বাগান থেকে হ্যানস যে বিশেষ কিছু পেত তা নয়। শরৎ, গ্রীম আর বসন্তে সে মোটামুটি খুশিই থাকত; কিন্তু শীতকালটাই ছিল তার কাছে মারাত্মক; কারণ, ওই সময়ে তার বাগানে কিছুই ফলত না; অনেকদিন এমনও হয়েছে যে সে কিছু শুকনো ফল মুখে দিয়ে ঘুমোতে গিয়েছে। তা ছাড়া, এই সময়টা সে বড়ো নিঃসঙ্গও বোধ করত, কারণ গোটা শীতকালটা। মিলার হিউও পথ দিয়ে হাঁটত না।
মিলার তার স্ত্রীকে বলত–যতদিন শীত থাকবে ততদিন হ্যানসকে না দেখতে যাওয়াই ভালো। কারণ, মানুষ যখন দুঃখে পড়ে তখন তার কাছে কারও যাওয়া উচিত নয। তাতে তাকে বিব্রত করা হয়। অন্তত, প্রকৃত বন্ধুত্ব বলতে এইটাই আমি বুঝি। আর এ বিষয়ে আমি যে ঠিক সে-সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত। সুতরাং বসন্তকাল না আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব; তারপরে আমি দেখা করব তার সঙ্গে। সে তখন আমাকে এক বাক্স প্রিমরোজ উপহার দিয়ে যথেষ্ট আনন্দ পাবে।
প্রচুর পাইন কাঠের আগুনের ধারে মেভাজি একটা আরাম কেদারায় বসে তার স্ত্রী বলল–অন্য লোকের সম্বন্ধে তুমি বেশ চিন্তাশীল দেখছি। বন্ধুত্বের সম্বন্ধে তোমার এই ধরনের। কথা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগছে যদিও পাদরি বাবা বিরাট তিনতলা বাড়িতে থাকেন। এবং কড়ে আঙুলে সোনার আংটি পরেন তবুও আমি নিশ্চিত যে তিনিও এইরকম সুন্দর কথা বলতে পারবেন না।
মিলারের সবচেয়ে ছোটো ছেলেটা বলল–কিন্তু তাঁকে কি আমরা এখানে আনতে পারি নে? যদি তিনি সত্যিকার দারিদ্রে পড়ে থাকেন আমি তাহলে তাঁকে আমার অর্ধেকটা খাবার দিতে পারি–আর দেখাতে পারি আমার সাদা খরগোসগুলি।
মিলার বেশ উঁচু স্বরে বলল–আচ্ছা বোকা ছেলে তো! তোমাকে স্কুলে পাঠিয়ে যে কী সুরাহা হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি না কিছুই শিখছ বলে তো মনে হচ্ছে না। হ্যানস যদি এখানে এসে আমাদের এই ভালো-ভালো খাবার, ভালো-ভালো লাল মুদ, আর এমন আরামের গৃহস্থালী দেখে তাহলে তার মনে হিংসার উদ্য হতে পারে, এই হিংসাটাই হচ্ছে বন্ধুত্বের পহেল্ক বড়োই বিপজ্জনক। এতে মানুষের স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। আমি কিছুতেই হ্যানসকে তার চরিত্র নষ্ট করতে দেব না। তার সবচেয়ে প্রিয়ে বন্ধু আমি। সব সময় আমি তার ওপরে নডরে রাখব। দেখব সে যাতে লোভের পথে পা না বাড়ায। তাছাড়া সে যদি এখানে আসে তাহলে আমার কাছ থেকে ধারে কিছু ময়দা নেওয়ার প্রস্তাব সে দিতে পারে। কিন্তু আমি তাকে ধার দিতে পারি নে। মযদা আর বন্ধুত্ব এক জিনিস নয। দুটো জিনিসের বানাই। আলাদা। তাদের অর্থও যে আলাদা সেকথা সবাই জানে।
বিরাট একটা পাত্রে মদ ঢেলে তার স্ত্রী বলল–বা! কী সুন্দর কথা! মনে হচ্ছে, আমি গির্জায় রয়েছি।
মিলার বলল–অনেক মানুষই ভালো অভিনয় করতে পারে। কিন্তু ভালো কথার শক্তি কম মানুষেরই রয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায় দুটোর মধ্যে ভালো কথা বলাটাই বেশি শক্ত-আর সেই সঙ্গে সূতর।
এই বলে ছেলের দিকে এমন রুষ্টভাবে সে তাকিয়ে রইল যে বেচারা লজ্জায় মাথা নীচু করল। যাই হোক, তার ব্যস এত কম যা তাকে হমা করা যেতে পারে।
জলের ইঁদুর জিজ্ঞাসা করল–তোমার গল্প শেষ?
লিনেট বলল–মাত্র শুরু।
জলের ইঁদুর বলল–তুমি তো তাহলে দেখছি সেকেলে হয়ে গিয়েচ্ছ। আজকাল প্রতিটি দক্ষ। কথকই শেষ থেকে শুরু করে, তারপরে চলে যায় প্রথমে, শেষ করে মাঝখানে। এইটিই হচ্ছে নতুন রীতি। সেদিন একজন সমালোচক একটি যুবককে সঙ্গে নিয়ে পুকুরের ধারে বেড়াতে বেড়াতে এই কথা বলছিলেন। আমি তা শুনেছি। কথাটা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে আমার। কারণ ভদ্রলোকের চোখে নীল চশমা, মাথায় টাক আর যখনই যুবকটি কিছু বলতে চাইছিল তখনই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তাঁর কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হচ্ছিল একটিমাত্র ধ্বনি-পুঃ। কিন্তু গল্পটা শুরু কর ভাই। তোমার এই মিলারটিকে আমার বেশ ভালো লাগছে। অনেক সৎগুণ তার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।
লিনেট বলল–বসন্ত আসার সঙ্গে সঙ্গে মিলার তার স্ত্রীর কাছে ঘোষণা করল যে খুদে হ্যালস-এর সঙ্গে দেখা করতে যাবে।
তার স্ত্রী সানন্দেই বলল–সত্যিই তোমার হৃদয় কত উদার। তুমি সব সময় অন্য লোকের কথা ভাবা যাই হোক, ফুল আনার জন্যে সেই বড়ো ঝুড়িটা নিয়ে যেতে ভুলো না যেন।
যথারীতি ব্যবস্থা গ্রহণ করে মিলার হ্যানস-এর সঙ্গে দেখা করতে গেল।
গুডমর্নিং হ্যানসা শীতকালটা কাটল কেমন?
হ্যানস বলল–প্রশ্নটা করে তোমার হৃদ্যতারই পরিচয় দিযে। না, খুব কষ্টেই গিয়েছে। কিন্তু বসন্তকাল এসে গিয়েছে। আমি এখন খুশিই। আমার ফুল সব ভালোই কাটছে।
মিলার বলল–সারা শীতকালটাই আমরা তোমার কথা ভেবেছি। তুমি যে কেমন করে কাটাচ্ছ তাই ভেবেই অবাক হচ্ছিলাম আমরা।
ধন্যবাদ। ধন্যবাদ। আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা আমাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছ।
তোমার কথা শুনে অবাক হচ্ছি হ্যানসা বন্ধুত্ব কাউকে ভুলতে দেয় না। এর সম্বন্ধে ওইটাই হল সবচেয়ে আশ্চর্য কথা মনে হচ্ছে, জীবন-কাব্য বলতে কী বোঝায় তা তুমি জান না। ভালো। কথা! তোমার ওই প্রিমরোভগুলি সত্যিই কী সুন্দর।
হ্যানস বলল–নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমার ভাগ্য ভালো যে অতগলো সন্দর প্রিমরোজ ফল আমার বাগানে ফুটেছে। আমি ওগুলি বাজারে নিয়ে গিয়ে বার্গোমাস্টারের মেযেকে বিক্রি করব; আর সেই টাকায় আমার একচাকার ঠেলাগাড়িটা ফিরিয়ে নিয়ে আসব।
ফিরিয়ে আনবে? তুমি কি সেটা বিক্রি করে দিয়েছিলে?
বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলাম। বুঝতেই পাচ্ছ শীতকালটাই হচ্ছে আমার দুঃসময়। তখন রুটি কেনার মতো পয়সাও আমার হাতে থাকে না। প্রথমে বিক্রি করলাম রুপোর বোতাম, তারপরে কুপোর চেন, তারপরে সেই বড়ো পাইপ, তারপরে ঠেলাগাড়ি, এখন আমি সব কটাই ফিরিয়ে আনব।
মিলার বলল–হ্যানস, আমি তোমাকে আমার ঠেলাগাড়িটা দেব। গাড়িটা অবশ্য খুব একটা ভালো অবস্থায় যে নেই সেকথা অবশ্য মিথ্যে নয়। তবু সেটা আমি তোমাকে দেব। আমি জানি এ থেকে আমার হৃদযটা যে কতটা দরাজ তাই প্রমাণিত হবে; আর ওটা বিলিয়ে। দেওয়ার জন্যে অনেকে যে আমাকে মূর্খ বলবে সেদিক থেকেও আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি বিশ্বের আর দশটা মানুষের মতো নই। আমি জানি উদারতাই হচ্ছে বন্ধুত্বের মূল কথা। আর তা ছাড়া, আমার একটা নতুন ঠেলাগাড়ি রয়েছে। তুমি নিশ্চিন্ত হও। আমি ওটা তোমাকে দেব।
খুদে চেহারার হ্যানস-এর মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল; সে বলল–সত্যিই বড়ো উদার তুমি। বাড়িতে আমার কিছু কাঠের তক্তা রয়েছে। ওগুলি দিয়ে কম খরচেই আমি ওটা সারিয়ে নিতে পারব।
মিলার বলল–কী বললে! কাঠের তক্তা। আরে, আমার গোলার ছাদের জন্য ঠিক ওইগুলিই তো আমার চাই। ছাদে একটা বিরাট গর্ত হয়েছে সেই গর্তটা বোজাতে না পারলে বৃষ্টির জলে আমার সব শস্য নষ্ট হয়ে যাবে। কী সৌভাগ্য যে তুমি খবরটা দিলে! একটা সৎকাজের ইঙ্গিত আর একটা সৎকাডের সংবাদ কী করে দেয় এইটাই হল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমি তোমাকে আমার ঠেলাগাড়ি দিয়েছি; তুমি আমাকে তোমার তক্তা দাও। অবশ্য তক্তার চেয়ে ঠেলাগাড়ির দাম অনেক বেশি। কিন্তু সত্যিকার বন্ধুত্ব কোনোদিন দর কষাকষি করে না। অনুগ্রহ করে ওগুলি আমাকে দাও; আমি এখনই কাজ শুরু করে দিই।
নিশ্চয়-নিশ্চয়-এই বলে হ্যানস দৌড়ে গিয়ে তক্তাগুলি টেনে আনল।
সেই দিকে তাকিয়ে মিলার বলল–তা তো বেশ বড়ো নয় হে। ভয় হচ্ছে আমার চাল সারানোর পরে এমন কিছু তক্তা বাঁচবে না যা দিয়ে তোমার ঠেলাগাড়ি সারানো চলবে। অবশ্য তার