এথেন্সের শিকল বাধা

এটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক একটি ভৌতিক গল্প। এখানে ভৌতিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।

সে আজ অনেক দিন আগের কথা। এক হাজার কি দেড় হাজার বছর তো হবেই। প্রাচীন গ্রীসে এথেন্স বলে একটা জায়গা ছিল। এথেন্স কিছু অপরিচিত নাম নয়, সবাই এর নাম শুনেছ ইতিহাসে। সেই এথেন্সেরই একটা পাহাড় ঘেরা ছোট্ট গ্রামে এক জঙ্গলের মধ্যে পুরনো একটা বাড়ি ছিল। বাড়িটা অবশ্য অনেকদিন ধরে খালি পড়েছিল। একে তো নির্জন পাহাড়ী অঞ্চল। তার ওপর বনজঙ্গল দিয়ে ঘেরা পরিবেশ। তায় পরিত্যক্ত। লোকজন না থাকলেও বাড়িটা কিন্তু খুব একটা ভাঙাচোরা অবস্থায় ছিল না। অর্থাৎ ইচ্ছে করলে পরিষ্কার করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে বসবাস করা যায়। 

 

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ওই বাড়ির যে মালিক সে কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও অনেকদিন পর্যন্ত কাউকে ওই কুঠিটা ভাড়া দিতে পারেনি। আসলে পাহাড়ের ওপর নির্জন জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত কুঠিটার বেশ বদনাম হয়ে গিয়েছিল। একবার এক শান্তিপ্রিয় ভদ্রলোক কুঠিটা দেখে লোভ সামলাতে না পেরে ছুটি কাটাবার জন্য ঐ কুঠিতে কয়েকটা রাত কাটাতে আসেন। কিন্তু পরদিন সকালে দেখা গেল লোকটির মৃতদেহ পড়ে আছে কুঠির দালানে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা নিয়ে তেমন কেউ মাথা ঘামায় নি। তবে যাঁরা তাঁর মৃতদেহ দেখেছিল তাদের মধ্যে কিছু সন্দেহ দানা পাকিয়েছিল। কারণ, মৃত্যুর পরেও লোকটির চোখেমুখে একটা অস্বাভাবিক ভয় লেগেছিল। আর চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল। কিন্তু পরে, মানে বেশ কিছুদিন পর আর একজন সৈনিক ধরনের লোক সেই বাড়িতে এসেছিল রাত কাটাতে। লোকটি ছিল অসম্ভব সাহসী। সেই লোকটি প্রাণে মরেনি ঠিকই, কিন্তু তার মুখ থেকে রাত্রির অভিজ্ঞতা যা শোনা গিয়েছিল তা ছিল রীতিমতো ভয়াবহ। খাওয়াদাওয়া সেরে রাত্রে সবে সে শুতে গিয়েছিল এমন সময় হঠাৎ সে দেখতে পেল ছাইরঙের দাড়িওয়ালা ইয়া চেহারার বিশাল এক বুড়ো হাতে পায়ে শেকল পরা অবস্থায় তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভয়াবহ চেহারার বুড়োটার মুখ থেকে কেমন এক ধরনের গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছিল। সৈনিক পুরুষটি মারা যায়নি ভয়ে। কিন্তু অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। পরদিন জ্ঞান ফিরে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সে সেই কুঠি ছেড়ে পালিয়ে গেল। সৈনিকটির মুখে সব শোনার পর সারা গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। এমনকি দিনের বেলাতেও আর কোনও সাহসী লোক ঐ বাড়ির দিকে পা মাড়াত না। কুঠিটার গায়ে রাতারাতি ‘ভূতের বাড়ি’ তকমাটা লেগে গেল। কুঠির মালিক যে ছিল সে কুঠিটা ভাড়া দিয়ে নিজের সংসার চালাত। কিন্তু যে মূহুর্তে কুঠিটার ভূতুড়ে বদনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল তারপর থেকে আর কেউই কুঠিটা ভাড়া নিয়ে থাকতে রাজি হল না। শেষপর্যন্ত কুঠির মালিক জলের দরে কুঠিটা বিক্রি করে দিতে চাইল। কিন্তু কিনবে কে? কে শখ করে ভূতের হাতে প্রাণ দিতে আসবে? 

 

 তবু একজন রাজি হল। কুঠির মালিক একজন খদ্দের পেলেন। লোকটি ছিলেন তখনকার দিনে একজন নামকরা দার্শনিক। দার্শনিক মানুষরা সাধারণত নির্জন জায়গা পছন্দ করেন। তাঁরা যুক্তি আর তর্ক দিয়ে সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করতে ভালবাসেন। লোকমুখে কুঠিটার অপবাদের কথা এই দার্শনিক লোকটিরও কানে এসেছিল। কিন্তু তিনি মনেপ্রাণে কোনও অলৌকিক ব্যাপার বিশ্বাস করতে চাইতেন না। তিনি স্থির করলেন, বাড়িটায় গিয়ে তিনি উঠবেন। মানুষের মধ্যে ভূতের ভয়ের অযৌক্তিক সংস্কারকে উড়িয়ে দেবেন। কুঠির মালিকের কাছে গিয়ে তিনি কুঠিটা কেনার বাসনার কথা জানালেন। কুঠির মালিক তো হাতে স্বর্গ পেল। সে ধরেই নিয়েছিল এমন ভূতের বাড়ি কোনওদিন ভাড়া হবে না বা বিক্রি হবে না। তাই দার্শনিক ভদ্রলোকের প্রস্তাব শুনে আকাশ থেকে পড়ল সে। সে’ও সঙ্গে সঙ্গে জলের দরে কুঠিটা বিক্রি করে হাঁফ ছাড়ল। 

 

 আগেই বলেছি, যুক্তি ছাড়া দার্শনিক চলেন না। যা চোখে দেখা যায় না, হাত দিয়ে যাকে ছোঁয়া যায় না অথবা অন্তর দিয়ে যাকে উপলব্ধি করা যায় না তেমন কিছুতে তাঁর বিশ্বাস আসবে কেন? 

 

 নিজের সব জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে দার্শনিক ভদ্রলোক উঠলেন সদ্য কেনা সেই বাড়িতে। সারাদিন ধরে নিজের হাতে সবকিছু গোছালেন। নিজের হাতেই সব কাজ করতে হয়েছিল কারণ বাড়িটার এমন বদনাম হয়েছিল যে বেশী পয়সার লোভ দেখিয়েও কোনও চাকর বাকর রাখতে পারেন নি তিনি। 

 

 যাই হোক, সারাদিন পরিশ্রমের পর দার্শনিক ভদ্রলোক বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। খুব একটা খাবার ইচ্ছে না থাকলেও রাতে সামান্য রুটি মাংস আর কফি দিয়ে রাতের আহার শেষ করলেন। তারপর গিয়ে শুলেন তাঁর ছোট্ট বিছানায়। মাথার কাছে সেকেলে ধরনের একটা জানলা ছিল। সেটা খুলেই রাখলেন। গরমের দিন। রাতের ফুরফুরে হাওয়ায় অত্যন্ত ক্লান্ত দেহে বাতি নিভিয়ে শোওয়ার সাথে সাথেই তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। 

 

 কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলেন কে জানে! হঠাৎ একটা অদ্ভুত আওয়াজ আর অস্বস্তির মধ্যে তার ঘুমটা ভেঙে গেল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মানুষের হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে প্রকৃতিস্থ হতে সময় লাগে। দার্শনিক ভদ্রলোকেরও সামান্য সময় লাগল তিনি কোথায় আছেন, কেমনভাবে আছেন, এটুকু বুঝতে। তারপর তাঁর সবকিছু একে একে মনে পড়ল। তিনি নতুন বাড়িতে এসেছেন। আর নতুন বাড়িতে এটাই তাঁর প্রথম রাত্রিবাস – সব মনে পড়তে লাগল। কান খাড়া করে অদ্ভুত আওয়াজ আর অস্বস্তিটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন। মিনিট দুই তিন মড়ার মতো পড়ে থেকে তিনি বুঝলেন আওয়াজটা অনেকটা শেকলের ঝনঝন আওয়াজের মতো। কিন্তু খুব অস্পষ্ট। কে যেন অনেক দূর থেকে শেকল টেনে টেনে আসছে। ধীরেধীরে চোখ মেলে তাকালেন দার্শনিক ভদ্রলোক। জমাট অন্ধকার সারা ঘরে ছড়িয়ে আছে। মাথার কাছে জানলা দিয়ে কেবল আকাশটুকু দেখা যায়। অবশ্য সেই সময় আকাশটাকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল না। আকাশের রঙ আর ঘরের রঙ এক হয়ে গিয়েছিল। দার্শনিক ভদ্রলোক কিন্তু চট করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন না। তিনি লক্ষ্য করতে চাইলেন ব্যাপারটা কি। আরও একটা অনুভব করলেন তিনি, সমস্ত ঘরের বাতাস যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। একটা দম বন্ধ করা গুমোট পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। 

 

 অনেকটা সময় যখন এইভাবে কেটে গেল, আর জমাট বাঁধা অন্ধকারটা যখন ধীরেধীরে সয়ে এল, হঠাৎই তিনি আবিষ্কার করলেন হাতে পায়ে শেকল বাঁধা একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি আস্তে আস্তে ভেসে উঠছে। হাত নেড়ে সেই ছায়ামূর্তিটা কি যেন বলতে চাইছে তাকে। মূর্তির দুটো চোখ থেকে যেন জ্বলন্ত আগুনের আভা বেরোচ্ছে। 

 

 দার্শনিক ভদ্রলোক ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী। ভৌতিক কিছুতে তাঁর তেমন বিশ্বাস ছিল না। তবু ভয় না পেলেও একটা অদ্ভুত বিস্ময় তাঁকে কিছুক্ষণের জন্য আচ্ছন্ন করে ফেলল। 

 

 তিনি বুঝতে চেষ্টা করলেন, জিনিসটা কি? কোনও ভয়ঙ্কর দানব না কি কোনও অসৎ মানুষ ওইভাবে সাজগোজ করে এসে তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে? 

 

শুয়ে শুয়ে এসব নানান যুক্তিতর্ক যখন তাঁর মনে ঝড় তুলেছে তখনিই তিনি দেখলেন সেই হাতে-পায়ে শেকল পরা ছায়া ছায়া মূর্তিটা ধীরেধীরে তাঁরই দিকে এগিয়ে আসছে। দুচোখ সেটার তখনো জ্বলছে। সে যেন মুখ হাঁ করে আর হাত-পা নেড়ে কিছু যেন বলতে চাইছে তাঁকে। আর হাত পা নাড়ার সাথে সাথে শেকলের ঝনঝন আওয়াজটাও ক্রমাগত শব্দ তুলছিল। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে নিশ্চয় অজ্ঞান হয়ে যেত ভয়ে অথবা দূর্বল হৃদয়ের লোক হলে মৃত্যু হত ভয়ে। কিন্তু অত্যন্ত সাহসী এই ভদ্রলোকটির কিছুই হল না। বরং তিনি যেমন ছিলেন সেইভাবেই তাকিয়ে রইলেন ছায়ামূর্তিটার দিকে। আসলে তিনি দেখতে চাইছিলেন, মূর্তিটা এরপর কি করে? 

 

 এক মুখ দাড়িগোঁফের জঙ্গল, আর এক মাথা রুক্ষ চুলে মূর্তিটাকে তখন বেশ বীভৎস আর ভয়াবহ মনে হচ্ছিল। তার ওপর তার হাতের নখগুলো ছিল বেশ বড় বড়। হাতের তীক্ষ্ণ আর বড় বড় নখ দেখে দার্শনিক ভদ্রলোকের মনে একটা অন্য ধরনের ভয়ও এল। ভূত তিনি বিশ্বাস করতেন না। মৃত্যুর পর প্রেতাত্মা মানুষের কতটা ক্ষতি করতে পারে সে সন্মন্ধে তাঁর কোনও ধারণাই ছিল না। অদেখা এমন কিছু পৃথিবীতে আছে বলেও তাঁর বিশ্বাস ছিল না। ভূতের চেয়ে জ্যান্ত চোরডাকাত মানুষের বেশি ক্ষতি করে বলেই তিনি মনে করেন। কিন্তু এখন? এখন তিনি কি করবেন? সম্ভাব্য বিপদের থেকে আত্মরক্ষার উপায় ভাবছিলেন যখন হঠাৎ সেইসময় দার্শনিক ভদ্রলোক লক্ষ্য করলেন, মূর্তিটি আর এক পা-ও না এগিয়ে এসে ক্রমাগত পিছু হটতে লাগল। পিছোতে পিছোতে একসময় সে ঘর পরিত্যাগ করল। 

 

 অশরীরী মূর্তিটিকে পিছিয়ে যেতে দেখে দার্শনিক ভদ্রলোকটি ক্ষণিকের অবশ অবস্থা ত্যাগ করে তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠলেন। তারপর নিজেও ছুটে ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। 

 

 অশরীরী মূর্তিটা ভূত বা অদ্ভুত যাই হোক, দার্শনিক পরম বিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন, বারান্দা পার হয়ে মূর্তিটা ধীরেধীরে নীচে নেমে গেল। তারপর লম্বা উঠোনের ঠিক মাঝ বরাবর গিয়ে হঠাৎই যেন কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেল। দার্শনিক একবার চিৎকার করে উঠলেন ” কে – কে” বলে। কিন্তু উত্তরে কেবল অনেক দূর থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট গোঙানি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলেন না। 

 

 উঠোনের ঠিক যে জায়গায় মূর্তিটা অদৃশ্য হয়েছিল সেইখানে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ গুম হয়ে কি যেন ভাবলেন তিনি। আরও দু একবার ডাকাডাকি করেও কারও উত্তর কিছু পেলেন না। বিফল মনোরথ হয়ে তিনি ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন। বাকি রাতটা তিনি এই অদ্ভুত ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে কাটিয়ে দিলেন। 

 

 ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে গত রাতে ঠিক যে জায়গা থেকে মূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সেখানে এসে অনেক কিছু পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলেন। কিন্তু দিনের বেলায় কোনও কিছুই তাঁর অস্বাভাবিক মনে হল না। 

 

 পাহাড়ের টিলায় এই কুঠিবাড়িটা ছিল লোকালয় থেকে বেশ কিছু দূরে। তার ওপর ভূতুড়ে বদনামের জন্য লোকজন এমনকি কোনও সাহসী পুরুষও এই বাড়ির ত্রিসীমানায় আসত না। নির্জন নির্বান্ধব এই পরিবেশে দার্শনিক ভদ্রলোক আবার তন্ময় হয়ে গেলেন নিজের পড়াশোনায়। প্রায় সারাদিনই বইয়ের জগতে ডুবে থাকলেন। ফলে রাতের সেই অশরীরী আর অদ্ভুত ঘটনাটার কথা প্রায় ভুলেই গেলেন। 

 

 

রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে যখন বিছানায় শুতে এলেন তখনিই আরেকবার তাঁর গত রাতের ঘটনাটার কথা মনে পড়ল। কিন্তু ঘটনাটিকে তিনি তেমন আমল দিলেন না। ভাবলেন অত্যধিক ক্লান্তি আর চিন্তাগ্রস্ত থাকার জন্য আধা ঘুম আধো জাগরণে কি দেখতে কি দেখেছিলেন। বিছানায় শোওয়ার সাথে সাথে ঘুম না এলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন। 

 

 ভয়ডর না থাকার জন্য সবকিছুকে অলীক বলে উড়িয়ে দিলেও আজ রাতেও কিন্তু গত রাতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। এমনকি তার পরের রাতেও একই ব্যাপার ঘটল। পরপর তিন রাত্রি একইভাবে অশরীরী মূর্তির আবির্ভাব এবং একইভাবে হাত পা নেড়ে কিছু বলতে চাওয়ার চেষ্টা এবং একইভাবে উঠোনের ঠিক একই জায়গায় এসে তার মিলিয়ে যাওয়া, দার্শনিককে বেশ ভাবিয়ে তুলল। তিনি কিছুতেই কোনও ব্যাখ্যা দিয়েও বুঝতে পারছিলেন না…..এটা কেমন করে হচ্ছে? কিভাবে হচ্ছে? 

 অবশেষে চতুর্থ দিন সকালে দার্শনিক কিন্তু আর সবকিছু নিছক কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে পারলেন না। আবার ভয় পেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েও গেলেন না। তিনি মনে মনে ভাবলেন, নিশ্চয় এর মধ্যে অনুসন্ধানের কিছু আছে। সত্যিই যদি কোনও অশরীরী প্রেত হয়ে থাকে, তাহলে সে নিশ্চয় তাঁকে কিছু বলতে চাইছে। আর সবচেয়ে যেটা তাঁকে আকৃষ্ট করল, সেটা হচ্ছে উঠোনের ঐ নির্দিষ্ট স্থানটি। কেনই বা বা প্রতি রাতে অদ্ভুত আর বীভৎস আকৃতির ঐ মূর্তি উঠোনের ওই বিশেষ জায়গায় এসে হারিয়ে যাচ্ছে! তাহলে ঐ জায়গাটিতে কি তাৎপর্যপূর্ণ কিছু আছে? এর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। 

 

 চতুর্থ দিন সকালে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে দার্শনিক আর বাড়িতে বসে রইলেন না। চলে গেলেন শহরে। প্রথমেই তিনি যোগাযোগ করলেন স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে। সব কথা তাঁকে খুলে বললেন। অন্য কেউ হলে হয়ত ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু এই দার্শনিক ছিলেন বেশ নামী লোক। জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান হিসেবে তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন সকলের কাছে। তাই তাঁর কথাকে হেলায় উড়িয়ে দিতে পারলেন না ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। কালবিলম্ব না করে তিনি বেশ কিছু মজুর নিয়ে ফিরে এলেন দার্শনিকের কেনা নতুন বাড়িতে। উঠোনের ঠিক যে জায়গায় এসে অশরীরী সেই মূর্তিটি গত তিন রাতে অদৃশ্য হয়েছে, সেই জায়গায় মাটি কোপাতে লাগল মজুররা। অবশ্য বেশিদূর খুঁড়তে হল না। সামান্য কয়েক হাত জমির নীচেই পাওয়া গেল একটা আস্ত কঙ্কাল। কঙ্কালটির হাত-পা শেকল দিয়ে বাঁধা। শিকলে মরচে পড়েছে পুরু হয়ে। 

 

 প্রেতাত্মায় কোনওদিনই বিশ্বাস ছিল না দার্শনিকের। কিন্তু সব ঘটনা চাক্ষুস করে তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের পরামর্শে ধর্মীয় নিয়মকানুন মেনে কঙ্কালটিকে যথাযথ ভাবে কবর দেওয়া হল। আর সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার, কঙ্কালটিকে ভালভাবে ধর্মীয় রীতি মেনে কবরস্থ করার পর আর কোনওদিন ঐ বাড়িতে সেই অশরীরী মূর্তির আবির্ভাব ঘটেনি। 

 

 এরপর দার্শনিক বহুদিন সেই বাড়িতে বাস করেছিলেন। আর কোনওদিন কিছু দেখেন নি তিনি। কিন্তু তিনি তবু বাড়িটির ব্যাপারে খোঁজখবর শুরু করলেন। গ্রামের কেউ কিছু ঠিকভাবে বলতে না পারলেও গ্রামের এক অতি বৃদ্ধের মুখে শোনা গেল, ‘ অনেক অনেকদিন আগে এক বৃদ্ধ ক্রীতদাসকে সামান্য অপরাধের জন্য ওইভাবে হাতে পায়ে শেকল বেঁধে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল ঐ বাড়িতে। ’ এ ঘটনা সত্য কি মিথ্যা জানার উপায় নেই। 

 

 তবে দার্শনিক বুঝেছিলেন, মৃত্যুর পরেও আত্মার আসা যাওয়া থাকে। আর সে আত্মা যদি অতৃপ্ত হয় তাহলে অশরীরী রূপ নিয়ে মানুষকে দেখা দিতে চায়। হয়তো বা সেই অতৃপ্ত আত্মা মুক্তির পথ খোঁজে। 


Tanvir Arafat

93 Blog posts

Comments