দেবকুমার

একদিন দুজন দরিদ্র কাঠুরিয়া বিরাট একটা পাইন বনের ভিতর দিয়ে হাঁটছিল। শীতকাল। ঠান্ডা কনকনে রাত

একদিন দুজন দরিদ্র কাঠুরিয়া বিরাট একটা পাইন বনের ভিতর দিয়ে হাঁটছিল। শীতকাল। ঠান্ডা কনকনে রাত। মাটির ওপরে গাছের পাতায় বেশ পুরু পুরু বরফ জমেছে। তাদের পথের দু’পাশে ঘন বরফের চাঁই মটমট করে পল্লবগুলিকে ভেঙে দিচ্ছে। হাঁটতে-হাঁটতে যখন তারা পাহাড়ি ঝর্নার কাছে এল তখন ঝর্নাটা নির্জীব হয়ে বাতাসে ঝুলছে; কারণ, বরফ-রাজ তাকে চুমু খেয়েছে। এত ঠান্ডা যে কী করবে তা তারা ভেবে পেল না।

 

দুটো পায়ের ভেতরে ন্যাজটা ঢুকিয়ে দিয়ে বনের মধ্যে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে নেকড়ে বাঘ ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বলল–উঃ! আবহাওয়া বটে একখানা! সরকার এ-সম্বন্ধে কোনো ব্যবস্থা করে না কেন?

 

সবুজ রঙের লিনেট পাখিরা গানের সুরে বলে-হুইট! হুইট! হুইট! পুরনো পৃথিবীটা মরে গিয়েছে। সাদা চাদরে তার মৃতদেহটাকে ওরা দিয়েছে ঢেকে।

 

টার্টল ডাভেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল–পৃথিবীর আজ বিয়ে হবে; তাই সে সাদা পোশাক পরেছে। তাদের লাল টুকটুকে পাগুলি তুষারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারা মনে করেছিল এই অবস্থায় তাদের কিছু রোমান্টিক হওয়া উচিত।

 

দাঁত খিচোল নেকড়ে বাঘ–মূর্খ কোথাকার! আমি বলছি এই উৎপাতের জন্যে আমাদের সরকারই দায়ী। আমার কথা যদি তোরা বিশ্বাস না করিস তাহলে আমি তোদের খেয়ে ফেলব। নেকড়ের বাস্তব বুদ্ধিটা অত্যন্ত প্রখর ছিল; কোনো একটা যুৎসই যুক্তি খাড়া করতে সে পিছপা হত না।

 

কাঠঠোকরা পাখি দার্শনিক হয়েই জন্মেছে। সে বলল আমার কথা যদি ধর তাহলে আমি ওসব অ্যাটমিক থিয়োরিতে বিশ্বাসী নই। আসল কথাটা হল কোনো জিনিস যদি কোনো একরকম হয় তাহলে সেটা সেই রকমই হবে এবং বর্তমানে সত্যিই বড়ো ঠান্ডা পড়েছে।

 

সত্যিই প্রচণ্ড ঠান্ডা। লম্বা ফার গাছের কোটরে বসে বাচ্চা কাঠবিড়ালিরা নিজেদের গরম রাখার জন্যে পরস্পরের নাক ঘষে দিচ্ছিল। খরগোসেরা নিজেদের গর্তের মধ্যে গুঁড়ি দিয়ে শুয়ে রইল; বাইরে তাকাতে ভরসা পেল না। সেই শীতের রাত্রিতে একমাত্র যাদের বেশ আনন্দ হল তারা হচ্ছে শিংওয়ালা ওই পেঁচারা। তারা তাদের বড়ো-বড়ো হলদে চোখ পাকাতে-পাকাতে বনের একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত আনন্দে ডাকাডাকি শুরু করল–টুইট! টু-টুইট! কী চমৎকার আবহাওয়া!

 

আমাদের সেই দুটি কাঠুরে চলছে তো চলছেই। মাঝে মাঝে আঙুল ঝেড়ে তারা বরফ সরাচ্ছে, আর বিরাটাকার লোহার জুতো ঠুকে বরফের চাঁই ভাঙছে। একবার তারা বরফের খাদে পড়ে গেল; যখন ওপরে উঠল তখন তারা একেবারে সাদা হয়ে গিয়েছে একবার তারা জমাট-বাঁধা জলায় পড়ে গেল। জ্বালানি কাঠগুলি ছিটকে পড়ল তাদের কাঁধ থেকে। আবার সেগুলি কুড়িয়ে বেশ ভালো করে কাঁধে বাঁধতে হল তাদের। একবার তারা পথ হারিয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল; কারণ তারা জানত বরফের মধ্যে যারা ঘুমিয়ে পড়ে তাদের ওপরে বরফ বড়ো নির্দয় ব্যবহার করে। কিন্তু পথিকদের দেবতা সেন্ট মার্টিনের ওপরে বিশ্বাস রেখে ঠিক রাস্তায় ফিরে এল তারা। অবশেষে তারা বনের সীমান্তে এসে হাজির হল। দূরে দেখতে পেল তাদের গ্রামে বাতি জ্বলছে। অরণ্যের বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেয়ে তারা এতই খুশি হয়ে উঠল যে তারা জোরে-জোরে হাসতে লাগল। তাদের কাছে মনে হলে পৃথিবীটা রূপালি ফুলের মতো; আর চাঁদটি হচ্ছে যেন সোনাল ফুল।

 

কিন্তু হাসি বন্ধ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে নিজেদের দারিদ্র্যের কথা স্মরণ করে তারা বেশ মুষড়ে পড়ল। একজন বলল–আমরা আনন্দ করলাম কেন? জীবনটা তো হচ্ছে ধনীদের জন্যে, আমাদের মতো গরিবদের জন্যে নয়। এর চেয়ে বরং ওই বনের মধ্যে ঠান্ডায় মরে যাওয়াই আমাদের পক্ষে ভালো ছিল অথবা কোনো বন্য জন্তু যদি আমাদের খেয়ে ফেলত তাহলেও আমরা কোনো দুঃখ করতাম না।

 

তার সঙ্গীটি বলল–ঠিকই বলেছ। কাউকে-কাউকে অনেক জিনিস ঈশ্বর দেন; আবার কাউকে কাউকে ঈশ্বর কিছুই দেন না। অন্যায়টাই পৃথিবীতে রমরমিয়ে বেড়াচ্ছে। দুঃখ ছাড়া সমান ভাগে ভাগ করে নেওয়ার-ও কিছু নেই এ জগতে।

 

তারা দুজনেই যখন এইভাবে বিলাপ করছিল ঠিক সেই সময় ব্যাপারটা ঘটল। আকাশ থেকে একটা উজ্জ্বল আর সুন্দর নক্ষত্র পৃথিবীর বুকে নেমে এল। তারা অবাক হয়ে দেখল তাদের কাছ থেকে অনতিদূরে একঝাঁক উইলো গাছের পেছলে সেই দ্যুতিময় নক্ষত্রটা পড়ে গেল।

 

তারা চিৎকার করে উঠল–ওখানে একটা সোনার তাল পড়েছে। আমাদের মধ্যে যে দেখতে পাবে ওটা হবে তারই।

 

এই বলেই তারা ছুটতে শুরু করল। সোনার লোভ তাদের এত!

 

তাদের মধ্যে একজন দৌড়ে তার সঙ্গীকে টপকে উইলো গাছগুলির ওপাশে হাজির হল; সত্যিই তো সাদা বরফের ওপরে একটা সোনার জিনিস পড়ে রয়েছে। এই দেখেই সে জিনিসটার দিকে দৌড়ে গিয়ে তার ওপরে হাত রাখল। সেটা সোনালি আলখাল্লায় মোড়া; সেই আলখাল্লার ওপরে তারকা চিহ্ন রয়েছে অনেগুলি। জিনিসটা সেই আলখাল্লা দিয়ে বেশ ভালো করে জড়ানো এই দেখেই সে তার সঙ্গীকে চিৎকার করে ডাকল। সঙ্গীটি এলে তারা দুজনে পাটের পর পাট খুলতে লাগল। তারা ঠিক করেছিল ভেতরে যদি কিছু সোনা-দানা থাকে তাই তারা ভাগ করে নেবে। কিন্তু হায়রে কপাল! সেই ভাঁজ খুলে তারা না পেল কোনো সোনা, না পেল কোনো রুপো; এমন কি মূল্যবান কোলো ধাতুও দেখতে পেল না তারা। যা দেখল তা হছে একটা ছোট্ট শিশু। শিশুটা ঘুমোচ্ছে।

 

এই দেখে একজন আর একজনকে বলল–কী তিক্তভাবেই না আমাদের আশার পরিসমাপ্তি হল! কিছুই লাভ হল না আমাদের। কারণ, মানুষের কাছে শিশুর দাম কী? একে এখানেই ফেলে রেখে যাই চল। আমরা গরিব লোক। আমাদের ছেলেও কম নেই, তাদের খাবার থেকে কিছুটা কেটে একে খাওয়াতে আমরা পারব না।

 

কিন্তু তার সঙ্গীটি বলল–উহু। শিশুটিকে এইভাবে মৃত্যুর মুখে ফেলে যাওয়াটা খারাপ হবে। যদিও তোমার মতোই আমিও গরিব, ছেলেমেয়েদের খাইয়ে যদিও আমার কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না, তবুও একে আমি বাড়িতে নিয়ে যাই। আমার স্ত্রী একে দেখবে।

 

এই বলে পরম যত্নে শিশুটি সে কোলে তুলে নিল, ঠান্ডার হাত থেকে তার নরম দেহটাকে বাঁচানোর জন্যে সেই আলখাল্লাটা দিয়ে বেশ ভালো করে তাকে জড়াল, তারপরে তার বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। তার এই মূর্খতা আর নরম হৃদয় দেখে তার সঙ্গীটি অবাক


Rx Munna

447 Blog posts

Comments