রাজ-অভিষেকের আগের রাত্রি যুবক রাজা তাঁর সুন্দর ঘরে একা বসে রয়েছে। যুগের প্রথা অনুযায়ী সভাসদেরা তাঁকে আভূমি প্রণাম করে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গিয়েছেন। সেখান থেকে রাজপ্রাসাদের ‘গ্রেটহল’-এ তাঁরা জমায়েত হয়েছেন-রীতি শিক্ষার বিখ্যাত অধ্যাপকের কাছ থেকে রীতি সম্বন্ধে কিছু বক্তৃতা শোনার জন্যে। সভাসদদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ ছিলেন সভার আদব-কায়দাটাকে তখনো যাঁরা রপ্ত করতে পারেননি এবং আমার ধারণা, যে কোনো সভাসদের কাছে এটি একটি অমার্জনীয় অপরাধ।
সভাসদেরা চলে যাওয়ার ফলে বালকটির–সত্যিই বালক ছাড়া আর কিছু নন তিনি–ষোল বছরের যুবককে আর কী বলা যেতে পারে– কোনো দুঃখ হল না। একটি নরম সোফার ওপরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গা এলিয়ে দিলেন তিনি। অরণ্যবাসী কোনো দেবতার মতো খুলে দিলেন তাঁর বিস্মিত দুটো চোখ আর ঠোঁট; শিকারির জালে আটকে পড়া নতুন কোনো জন্তুর মতো অবাক বিস্ময়ে তিনি তখন তাকিয়েছিলেন।
আর সত্যি কথাই তো! তিনি যখন বাঁশি হাতে নিয়ে একটি মেষপালকের যাকে তিনি নিজের বাবা বলেই জানতেন–মেষের পাল নিয়ে চরাতে বেরিয়েছিলেন ঠিক সেই সময় হঠাৎ শিকারিরা তাঁকে ধরে নিয়ে আসে। শোনা যায়, একদিন একটি যুবক-অনেকের মতে বিদেশি-বাঁশি বাজিয়ে বৃদ্ধ রাজার কন্যাকে মুগ্ধ করেছিল। আবার কেউ কেউ বলে যুবকটি বিমিনি থেকে এসেছিল। পেশায় সে ছিল চিত্রকর। তার সাংসারিক অবস্থা সাধারণ হলেও, রাজকুমারী তাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়েছিলেন-ততটা সম্মান তার নাকি পাওয়ার কথা ছিল। না। তারপরে গোপনে সে রাজকুমারীকে বিয়ে করে। এই যুবকটি তাদেরই পুত্র। তারপরে হঠাৎ একদিন গির্জার কাজ অসমাপ্ত রেখেই চিত্রকরটি কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়। শিশুটির বয়স তখন সাত দিনও হয়নি। তার মা তখন ঘুমোচ্ছিলেন। সেই সময় বৃদ্ধ রাজার বিশ্বস্ত একটি অনুচর তাকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ের নীচে একটি অপুত্রক কৃষক দম্পতির বাড়িতে পোঁছে দিয়ে আসে। দুঃখে জর্জরিত হয়ে, না, তীব্র এক পেয়ালা ইতালিয়ান বিষপান করার জন্যে-খবরটা কেউ জানে না–ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারীর মৃত্যু হয়। যে সময়ে রাজার বিশ্বস্ত অনুচর তাঁর শিশুপুত্রটিকে নিয়ে দূরে পাহাড়তলীতে কৃষক দম্পতির দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে আজ একদল লোক রাজকুমারীর মৃতদেহটি নিয়ে একটি পরিত্যক্ত সমাধি ক্ষেত্রে উপস্থিত হল। সেখানে আগে থেকে কবর একটা খোলাই ছিল। সেইখানেই তাঁকে কবর দেওয়া হল। লোকমুখে শোনা যায় ওরই মধ্যে আর একটি যুবককে কবরস্থ করা হয়েছিল। যুবকটি বিদেশি কিন্তু অপরূপ সুন্দর। তার দুটি হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা; আর বুকের ওপরে অনেকগুলি রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন।