চাকরটি ঘরে এসে ঢুকতে

চাকরটি ঘরে এসে ঢুকতেই একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোকটা কি পর্দার পেছনে আড়ি পেতে

চাকরটি ঘরে এসে ঢুকতেই একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোকটা কি পর্দার পেছনে আড়ি পেতে শুনছিল এতক্ষণ? লোকটির মুখের ওপরে কোনোরকম ভাবান্তর দেখা গেল না। সে নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। একটা সিগারেট ধরিয়ে আরশীর দিকে এগিয়ে গেলেন ডোরিয়েন। তাকিয়ে দেখলেন। ভিকটরের মুখটা বেশ সপষ্টই দেখা যাচ্ছিল আরশীর ওপরে। চাকরের মুখের মতনই সে মুখ নিবাত-নিষ্কম্পা ভয় করার মতো কিছু নেই সেখানে। তবু তাঁর মনে হল সাবধানে থাকাই ভালো।

 

ধীরে-ধীরে কথা বললেন ডোরিয়েন: রাঁধুনিকে পাঠিয়ে দাও, তারপরে তুমি ছবির যারা ফ্রেম তৈরি করে সেই দোকানে দুজন মিস্ত্রিকে এখনই আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলা তাঁর মনে হল, লোকটি চলে যাওয়ার সময় পর্দার দিকে একবার তাকিয়ে গেল। অথবা এটা তাঁর মতিভ্রম?

 

কিছুক্ষণ পরে কালো পোশাক পরে মিসেস লিফ লাইব্রেরিতে হাজির হল, স্কুলঘরের চাবিকাঠিটা তিনি চাইলেন।

 

মিসেস লিফ বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করল, পুরনো স্কুলঘরের চাবি চাইছেন, মিঃ ডোরিয়েন? ঘর তো একেবারে ধুলোয় বোঝাই হয়ে রয়েছে। আপনি ঢোকার আগে ঝেড়ে-মুছে ঘরটাকে চলনসই করতে হবে। ওঘরে এখনই আপনি ঢুকতে পারবেন না। স্যার; না, না, নিশ্চয় না।

 

ঘর ঝাড়-পোঁচ করতে আমি চাইনে, লিফ, আমি যা চাই সেটা হচ্ছে চাবিকাঠি।

 

কিন্তু স্যার, ঘরের মধ্যে মাকডশার ডাল গিজ গিজ করছে। ঢুকলেই আপনার গোটা গা ভর্তি হয়ে যাবে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে ঘরটা খোলা হয়নি, সেই যেদিন হিজ লর্ডশীপ দেহত্যাগ করেছেন।

 

দাদামশায়ের কথা উঠতেই তিনি ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। দাদামশায়ের সম্বন্ধে তাঁর যে স্মৃতি রয়েছে তার মধ্যে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু নেই। তিনি বললেন: তাতে কিছু যাবে আসবে না। ডাযগাটা আমি কেবল দেখতে চাই। চাবিটা আমাকে দাও।

 

কাঁপা হাতে চাবির বান্ডিল ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা চাবি বার করে বৃদ্ধা লিফ বলল: এই যে। গোছা থেকে এখনই এটা আমি বার করে দিচ্ছি। কিন্তু ওখানে আপনি থাকবেন ঠিক করেননি তো? এ ঘরে তো আপনি ভালোই রয়েছেন।

 

না, না, রাত্রিবাস করার কোনো পরিকল্পনা আমার নেই। ধন্যবাদ, এবার তুমি এস।

 

কিন্তু তখনই সে চলে গেল না; দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সাংসারিক ব্যপার নিয়ে কিছুটা বকবক করল। তিনি মনে-মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন: বেশ তো; তোমার যেটা ভালো মনে হবে সেইভাবেই সংসার চালাও।

 

মিসেস লিফ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। চাবিকাঠিটা পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলেন ডোরিয়েন; ঘরের ভেতরে চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখলেন।

 

দেখতে-দেখতে লাল সাটিনের বিরাট একটা চাদরে তাঁর চোখ এসে পড়ল, চারপাশটা তার সোনালি বুটির কাজ, সপ্তদশ শতাব্দীর ভেনিস্যি কারুকলার একটি অপূর্ব নিদর্শন। বোলোচানার কনভেনট থেকে তাঁর দাদামশায় সেটি সংগ্রহ করেছিলেন। হ্যাঁ, সেই ভয়ানক বস্তুটাকে ওই চাদর দিয়ে স্বচ্ছন্দে ঢাকা দেওয়া যাবে। ওটা দিয়ে প্রায় মৃতদেহগুলিকে ঢাকা দেওয়া হত। এখন ওটা দিয়ে এমন একটা জিনিসকে চাপা দেওয়া হবে যেটা আপনা থেকে বিকৃত হয়ে ওঠে; মৃতদেহের বিকৃতির চেয়েও যার বিকৃতি অনেক বেশি ভয়ঙ্কর-যে নিজে না মরেও চারপাশে মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়িয়ে দেয়। মৃতদেহের ওপরে পোকারা যে বিকৃতি ঘটায়, তাঁর পাপ ক্যানভাসের ছবিটির ওপরেও সেই রকম বিকৃতি ঘটাবে তাঁর পাপগুলি ছবিটির সৌন্দর্য নষ্ট করবে, ধ্বংস করে দেবে তার লাবণ্য। একেবারে কদর্য হয়ে যাবে জিনিসটা তবু তর মৃত্যু হবে না; তবু সে চিরকাল বেঁচে থাকবে।

 

ভাবতে-ভাবতে তিনি শিউরে উঠলেন। প্রতিকৃতিটাকে ঢেকে রাখার আসল কারণটা তিনি যে বেসিলকে বলেননি সে-জন্যে অনুশোচনা হল তাঁর। লর্ড হেনরির প্রভাব অথবা তাঁর নিজের প্রবৃত্তি থেকে যে সব পঙ্কিল চিন্তাগুলি বেরিয়ে তাঁকে পাপের পথে টেনে নিয়ে যেতে চায় সেগুলির প্রভাব থেকে বেসিল হয়তো তাঁকে বাঁচাতে পারতেন। তাঁর ভালোবাসার মধ্যে এমন কিছু নেই যা মহৎ নয়, মননশীলতা যার মধ্যে নেই। কারণ, কোনো খাদ নেই বেসিলের। ভালোবাসার ভেতরে। এই ভালবাসা দেহজ নয়। প্রবৃত্তিগুলি ক্লান্ত হয়ে উঠলেই দেহ ভলোবাসা নষ্ট হয়ে যায়। মাইকেল এঞ্জেলো, মনতেন উইনকিলম্যান এবং শেকসপীয়ন–এঁরা সবাই সেই আসল ভালোবাসারি পূজারী। হ্যাঁ, বেসিলই তাঁকে বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন আর সে সময় নেই। অতীতকে সব সময় বিনষ্ট করা। যায়। অনুশোচনা, আত্মাহুতি আর বিস্মৃতির মধ্যেই কবরস্থ করা যায় অতীতকে। কিন্তু ভবিষ্যতকে এড়ানো যায় না। তাঁর কামলা আর ভোগের উচ্ছ্বাসই তাঁর সামনে বিপদের নতুন পথ খুলে দেবে, আজ যে বিপদ অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে একদিন তাই রূপায়িত হবে ভয়ঙ্কর বাস্তব সত্য।

 

সোফার ওপর থেকে তিনি সোনালি কারুকার্য করা বিরাট চাদরটিকে হাতে করে তুলে নিলেন; তারপরে সেটি নিয়ে পর্দার পেছনে চলে গেলেন। ক্যানভাসের ওপরে যে মুখটি আঁকা রয়েছে, আগের সেটি কি আরো কুৎসিত রূপ ধারণ করেছে? দেখে তো মনে হল কোনোরকম পরিবর্তন দেখা দেয়নি, কিন্তু ছবিটির


Rx Munna

447 Blog posts

Comments