মাদার প্ল্যানেট

যখন শুধুমাত্র মাদার প্ল্যানেট টার্মিনাসের প্রতি চরম অবিশ্বাসের কারণে সাতাশটা স্বাধীন বণিক বিশ্ব একত্রিত

যখন শুধুমাত্র মাদার প্ল্যানেট টার্মিনাসের প্রতি চরম অবিশ্বাসের কারণে সাতাশটা স্বাধীন বণিক বিশ্ব একত্রিত হয় নিজেদের মাঝে তারা একটা সম্মেলনের আয়োজন করে। প্রতিটা গ্রহই নিজস্ব ক্ষুদ্রতা থেকে উদ্ভূত সিমাহীন অহংকারে সমৃদ্ধ, রুক্ষ কঠিন গ্রাম্য জীবনযাপনে অভ্যস্ত, এবং জাগতিক সমস্যা মোকাবিলা করে করে তিক্ত বিরক্ত। শুরুতেই অতি তুচ্ছ একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে এই মন মরা গ্রহবাসীদের টালমাটাল অবস্থায় পড়তে হয়।

 

সমস্যাটা ভোটাভুটির নিয়ম, প্রতিনিধিদের ধরন-গ্রহের মান অনুযায়ী নাকি জনসংখ্যা অনুযায়ী হবে-ইত্যাদি বিষয় নির্ধারণ করা নিয়ে নয়, কারণ এই বিষয়গুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। আবার সমস্যাটা কাউন্সিল এবং ডিনারে কীভাবে টেবিল সাজানো হবে সেটা নিয়েও নয়; কারণ এই বিষয়গুলোর সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে।

 

সমস্যা দেখা দেয় সম্মেলনের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে-কারণ এটা অত্যন্ত প্রবল প্রাদেশিক মানসিকতার ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত কূটনীতির সর্পিল পথ তাদের নিয়ে যায় র‍্যাডল নামক গ্রহে যার পক্ষে কয়েকজন বক্তা শুরু থেকেই যুক্তি দেখিয়ে বলছিলেন যে এটা মোটামুটি কেন্দ্রে অবস্থিত।

 

র‍্যাডল ক্ষুদ্র এক বিশ্ব-সামরিক গুরুত্ব বিবেচনায় যা সাতাশটা গ্রহের মাঝে সবচেয়ে দুর্বল। এবং এই গ্রহ বেছে নেওয়ার এটাও একটা কারণ।

 

এটা একটা রিবন ওয়ার্ল্ড-গ্যালাক্সি যাকে নিয়ে অহংকার করতে পারে, কিন্তু অধিবাসীদের অল্পসংখ্যকই শারীরিক গঠনে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। অন্য কথায় বলা যায় এটা এমন একটা বিশ্ব যেখানে দুই তৃতীয়াংশ অধিবাসী বিরামহীনভাবে অত্যধিক ঠাণ্ডা এবং অত্যধিক গরমের মোকাবেলা করতে বাধ্য হয়, যেখানে জীবনধারণের সম্ভ্যাব্য স্থিতিশীল স্থান হচ্ছে রিবন বেষ্টিত আধো আলোকিত অঞ্চল।

 

এমন একটা গ্রহ কারো কাছেই আকর্ষণীয় মনে হতে পারে না। কিন্তু এখানে ভূ তাত্ত্বিক কৌশলে বিশেষ ধরনের কিছু স্থান তৈরি হয়েছে-র্যাডল সিটি এমনি একটি স্থানে অবস্থিত।

 

একটা পর্বতের মসৃণ পাদদেশে এই শহর বিস্তৃত-যে পর্বত শীর্ষ শীতল আবহাওয়া এবং ভয়ংকর তুষারপাত থেকে রক্ষা করছে শহরটাকে। উষ্ণ এবং শুকনো বায়ু শহরটাকে আরামদায়ক করে তুলেছে, পাহাড় চূড়ার বরফ গলিয়ে পাইপের সাহায্যে পানি সরবরাহ করা হয়-এবং এ দুয়ের মাঝে র‍্যাডল সিটি পরিণত হয়েছে এক চিরস্থায়ী উদ্যানে, অন্তহীন ভোরের আলোয় সিক্ত।

 

প্রতিটা বাড়ির সামনে রয়েছে উন্মুক্ত বাগান। প্রতিটা বাগান উদ্যানবিদ্যার চমৎকার নিদর্শন, সেখানে চমৎকার প্যাটার্নে মূল্যবান উদ্ভিদ জন্মানো হয়েছে ছিল তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একমাত্র উপায়-যতদিন না র‍্যাডল সাধারণ বণিক বিশ্ব থেকে উৎপাদনকারী বিশ্বে পরিণত হয়।

 

কাজেই ভয়ানক এক বিশ্বে র‍্যাডল সিটি হল কোমলতা এবং প্রাচুর্যের ক্ষুদ্র বিন্দু, এক টুকরো স্বর্গ-এবং এই গ্রহ বেছে নেওয়ার এটাও একটা কারণ।

 

বাকি ছাব্বিশটা বণিক বিশ্ব থেকে নানা বর্ণের লোক এসে হাজির হয়েছে: প্রতিনিধি এবং তাদের স্ত্রী, সেক্রেটারি, সাংবাদিক, স্পেসশিপ এবং সেগুলোর কু-অল্প দিনেই প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল র‍্যাডলের জনসংখ্যা এবং টান পড়ল তার সীমিত সম্পদে।

 

হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকা মানুষগুলোর মাঝে অল্প কয়েকজন আছে যারা বাস্ত বিকই জানে না যে গ্যালাক্সিতে নিঃশব্দে একটা যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। এবং যারা জানে তাদের ভেতর তিনটা শ্ৰেণী আছে। প্রথমত যারা জানে কম কিন্তু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী-

 

যেমন ঐ তরুণ স্পেস পাইলট, যার টুপিতে হেভেন এর ব্যাজ লাগানো এবং বিপরীত দিকের র‍্যাডলিয়ান তরুণীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কায়দা করে চোখের সামনে গ্লাস ধরে রেখেছে। সে বলছিল : “এখানে আসার সময় আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের ভেতর দিয়ে এসেছি। ঠিক হোরলেগর এর ভিতর দিয়ে এক লাইট মিনিট বা একটু বেশিও হতে পারে-দূরত্ব পেরিয়ে আসতে হয়।”

 

“হোরলেগর?” লম্বা পায়ের স্থানীয় অধিবাসী বলল। “গত সপ্তাহে মিউল ওখানে শক্ত মার দিয়েছে, তাই না?”

 

“আপনি কার কাছে শুনলেন মিউল শক্ত মার দিয়েছে?” চমৎকার ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল তরুণ পাইলট।

 

“ফাউণ্ডেশন রেডিও।”

 

“হ্যাঁহ? হ্যাঁ, হোরলেগর দখল করেছে। আমরা ওদের একটা কনভয়ের প্রায় মাঝখানে গিয়ে পড়ি। শক্ত মার দেওয়ার মতো কিছু না।”

 

খসখসে উঁচু গলায় কথা বলল কেউ একজন, “অমন কথা কইয়েন না। ফাউণ্ডেশন হগল সময়ই আগে মাইর খায়। খালি দেখতে থাহেন। ব্যাবাক ফাউণ্ডেশন জানে কহন পাল্টা মাইর দিতে অইব, তারপর-বুম!” চিকন গলা মুখে পাতলা হাসি ছড়িয়ে তার কথা শেষ করল।

 

“যাই হোক, কিছুক্ষণ নীরব থেকে হেভেনের পাইলট বলল, “আমরা মিউলের শিপগুলো দেখেছি, এবং বেশ ভালোই মনে হয়েছে, বেশ ভালো। সত্যি কথা বলতে কি একেবারে নতুন দেখাচ্ছিল।”

 

“নতুন?” চিন্তিত সুরে বলল স্থানীয় অধিবাসী, “ওরা নিজেরা তৈরি করেছে?” মাথার উপরের ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ল একটা, নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকল, তারপর চিবোতে লাগল। এক ধরনের কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল পুরো ঘরে। “তুমি বলতে চাইছ নিজেদের তৈরি জিনিস দিয়ে ওরা ফাউণ্ডেশন-এর যুদ্ধযানগুলোকে পরাজিত করেছে? বলে যাও।”

 

“আমরা নিজের চোখে দেখেছি, ডক।”

 

সামনে ঝুঁকল স্থানীয় অধিবাসী, “জানো আমি কী ভাবছি? শোন। নিজেকে তামাশায় পরিণত করো না। সবকিছু সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের তুখোড় লোজন আছে। তারা জানে কী করতে হবে।”

 

সেই খসখসে কণ্ঠস্বর আবার কথা বলল উঁচু গলায়, “খালি দেখতে থাহেন। ফাউণ্ডেশন একেবারে শেষ মুহূর্তের লাইগা অপেক্ষা করতাছে, তারপর বুম!” সামনে দিয়ে একটা মেয়ে যাচ্ছিল, তার দিকে তাকিয়ে হাসল বোকার মতো।

 

স্থানীয় অধিবাসী বলে চলেছে, “যেমন, তোমার কি ধারণা পরিস্থিতি মিউলের পক্ষে। না-আ-আ। আমি শুনেছি এবং বেশ গুরুত্বপূর্ণ লোকের কাছ থেকেই শুনেছি যে সে আমাদের লোক। আমরা তাকে পয়সা দিচ্ছি, এবং ঐ শিপগুলো সম্ভবত আমরাই তৈরি করে দিয়েছি। অবশ্যই ফাউণ্ডেশনকে সে পরাজিত করতে পারবে না, কিন্তু একটু নড়বড়ে অবস্থায় ফেলে দিতে পারবে, আর সেই অবস্থাতেই আমরা নিজেদের কাজ সেরে ফেলব।”

 

বিপরীত দিকে বসা তরুণী বলল, “যুদ্ধ ছাড়া তোমাদের আর কোনো আলোচনা নেই, ক্লেভ? বিরক্ত হয়ে গেছি।”

 

“বিষয় পাল্টানো যাক। মেয়েদের বিরক্ত করে লাভ নেই।” অতিরিক্ত ভদ্রতার সাথে বলল হেভেনের পাইলট।

 

সুযোগটা লুফে নিল একজন, একটা মগে তাল ঠুকল সে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দুজনের ছোট ছোট দলগুলো খিলখিল হাসিতে গড়িয়ে পড়ল, একইরকম আরো কয়েকটা দল বেরিয়ে এল পিছনের সান হাউস থেকে।

 

তারপরের আলোচনা হয়ে গেল অতি সাধারণ, বিভিন্নমুখী এবং অর্থহীন—

 

আর আছে তারা যারা কিছুটা কম জানে এবং কিছুটা কম আত্মবিশ্বাসী।

 

যেমন এক হাতঅলা ফ্র্যান, হেভেনের অফিসিয়াল প্রতিনিধি, এবং সে নতুন নতুন মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব পাতানো নিয়ে ব্যস্ত-ঠেকায় পড়ে দু-একজন পুরুষের সাথে বন্ধুত্ব করতে বাধ্য হচ্ছে।

 

সেরকমই একজন বন্ধুর পাহাড়


Rx Munna

447 Blog posts

Comments