মতিঝিলের ভুত

ঢাকার মতিঝিলের বেশ জনপ্রিয় আবাসিক এলাকা (ডঃ মোতালেব নামক একজন ডাক্তারের চেম্বারের ঠিক পিছনে তার বাড়ির সামনের

"দ্বীপটির নাম Island of the dolls বা পুতুলের দ্বীপ। মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটি থেকে ১৭ মাইল দক্ষিনে জোকি মিলকো জেলায় অবস্থিত এই দ্বীপটি দেখতে কেমন যেন গা শিউরে দেয়ার মতো। এই দ্বীপকে ঘিরে রয়েছে কিছু ভূতুড়ে কাহিনী। আজ থেকে ৮০ বছর আগের কথা তিন মেক্সিকান শিশু পুতুলের বিয়ে দিচ্ছিল গাছে ঢাকা শীতল অন্ধকার এই দ্বীপটিতে। খেলতে খেলতে তাদের একজন নিখোঁজ!পরবর্তী সময়ে দ্বীপের পাশেই একটি খালে পাওয়া গেল তার মৃতদেহ। এরপর থেকে ভয়ে কেউ ঐ দ্বীপের ত্রি-সীমানা মাড়য়নি। এ ঘটনার ৩০ বছর পরের কথা, ১৯৫০ সালের দিকে জুলিয়ান সানতানা নামের এক ধর্ম যাজক নিজর্নে তপস্যা করার জন্য দ্বীপটিকে বেছে নেন। জুলিয়ানের ভাষ্য অনুযায়ী দ্বীপটিতে আশ্রম গড়ে তোলার পর থেকে তার সঙ্গে মৃত শিশুটির আত্মার প্রায়ই কথা হয়! শিশুটির আত্মা তার কাছে পুতুলের বায়না ধরে। তবে যেমন তেমন পুতুল নয়, বীভত্স সব পুতুল চেয়ে বসতো সে। ওই আত্মার অনুরোদে জুলিয়ান তার আশ্রমে চাষ করা সবজির বিনিময় মানুষের কাছ থেক নস্ট পুতুল সংগ্রহ করতে থাকেন। এবং সেগুলো এনে গাছের ডালে বেঁধে রাখলেই খুশি হতো শিশুটির আত্মা। এমনিভাবে হাজার হাজার সংগ্রহ করা পুতুল দিয়ে জুলিয়ান গড়ে তোলে মৃত পুতুলের দ্বীপটি। কেউ কেউ বিশ্বাস করে মৃত শিশুটির আত্মা দ্বীপটিতে এখন ও ঘোরাঘুরি করে। মাঝে মাঝে শোনা যায় ভূতুড়ে আওয়াজ। এতসব রহস্যের কারণেই ১৯৯০ সালে মেক্সিকান সরকার দ্বীপটিকে National Heritage ঘোষণা করে। কিন্তু পর্যটকরা কদকার এসোব পুতুল দেখে বোধ হয় রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে চাননা। তাই একেক মৌসুমে ৬০ থেকে ৭০ জনের বেশি পর্যটক কখনো এই দ্বীপে আসেনা। এই দ্বীপের সর্বশেষ রহস্যজনক ঘটনা ঘটে ২০০১ সালে ২১ এপ্রিল। ঐ দিন জুলিয়ান তার বোনের ছেলেকে নিয়ে সেই অপয়া খালে মাছ ধরছিল। সে সময় তিনি তার ভাগ্নেকে বলে, পানির নিচ থেকে আমাকে কারা যেন ডাকছে, তারা আমাকে তাদের সাথে যেতে বলছে। এর কিছুদিন পরে ঐ খাল থেকে উদ্ধার করা জুলিয়ানের নিথর দেহ। "

আমি যখন ছোট তখনকার ঘটনা। একদিন রাতে আমার আব্বুর সাথে আম্মুর কি যেন নিয়ে ঝগড়া হয়। এবং আমার আম্মু কিছুক্ষন পরে কেঁদে কেঁদে বলে যে আমি তোমার বাড়ি থাকবো না। আমি আমার বাপের বাড়ি চলে যাব। এই বলে আমার সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তখন আনুমানিক রাত ১১.৪৫ এরকম। আমার আব্বু রাগে কিছু না বলে ঘরে এসে ছিটকানি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। একটু পরে আমার যখন ঘুম আসছিল না তখন আমি আমার আব্বুর কাছে যেয়ে শুই। কিছুক্ষন পরে হঠাৎ বাহিরে আম্মুর ডাক। আম্মু আমাকে ডেকে ডেকে দরজা খুলতে বলছে। আব্বু নিজেই যেয়ে গেট খুলে দিয়ে আসে এবং আম্মুকে বলে ফিরে আসলে কেন? যাও বাপের বাড়ি যাও। আম্মু কিছু বলে না, চুপ করে ঘরে চলে আসে। এখানে বলে রাখা ভালো যে তখন বিদ্যুত্ ছিল না। ঘরে টিপ টিপ করে মোম বাতি জ্বলছে। তখন আম্মু ঘরে আসলো। এরপর আমি, আব্বু আর আম্মু একসাথে ঘুমাই। এবং একটু পরে আমি অনুভব করলাম কিসের যেন গন্ধ নাকে আসছে। তারপর আমি আব্বুকে চুপি চুপি বললাম এই কথা। আব্বু বললো চুপ করে থাকো। এরকম কিছুক্ষণ যাওয়ার পরে আব্বুর মোবাইলে কল আসলো এবং আব্বু ফোন ধরে বললো হ্যালো। তখন আমার নানা ফোনে বলল লিমনের আম্মুর সাথে আবার কি হয়েছে? লিমনের আম্মু এখানে বসে কান্না করতেছে। আব্বু থ মেরে গেলো এবং আমাকে চিমটি কাটলো। আমি তখন একটু উহ করে উঠলাম। আব্বু বললো, কিরে বাথরুমে যাবি? এই বলে আমাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আমার আম্মুর রুপে যে ছিল সে ঘর থেকে যাওয়ার সময় আব্বুকে বারবার বলতেছিলো, লিমন একাই বাথরুমে যাক, তুমি থাকো। তখন আব্বু বলে তুমি থাকো, আমি যা্ নয়তো লিমন ভয় পাবে। এই বলে আমাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আব্বু। তারপর পাশের বাড়িতে যেয়ে সেই রাতটি কাটাই। সকালে এসে দেখি ঘর একদম নোংরা হয়ে আছে। আর দেয়ালে শুধু আঁচড়ের দাগ। 

গাড়ি থেকে যখন এই স্টেশনে নামি রাত তখন ঠিক একটা। যাত্রিদের স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে রেল গাড়িটি আবার চলতে লাগলো। সঙ্গে থাকা ব্যাগটা কাঁদে ঝুলিয়ে স্টেশন মাস্টারের রুমের দিকে গেলাম। ভিতরে ঢুকতে দেখি সেখানে একজন লোক বসে আছে। উনি হয়তো স্টেশন মাস্টার। তাকে গিয়ে জিগাস করলাম এখান থেকে রসুলপুর কত দূর? তিনি উত্তর দিলেন এখান থেকে রসুলপুর ৬ কি:মি রাস্তা। কিন্তু এত রাতে এখান থেকে রসুলপুর যাওয়ার কোন ভ্যান পাওয়া যাবেনা। তাই রাতটা কষ্ট করে এখানে কাটাতে। তার সাথে কথা শেষ করে ঐ রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। বাহিরে এসে দেখি চারপাশটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা কোন মানুষ-জন নেই। পাশে যাত্রিদের ওয়েটিং রুম। সেখানে গিয়ে একটি চেয়ারে বসলাম। তারপরে চিন্তা করলাম কোন মতে আজ রাতটা এখানে কাটিয়ে কাল সকালের দিকে রসুলপুরের উদেশ্যে রওনা হব। দেয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দেড়টা বেজে গেছে। চোখে একটু একটু ঘুম ঘুম ভাব। তাই চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। হঠাত্ এমন সময় একজন লোক এসে উপস্থিত। এসে বলে স্যার কৈই যাইবেন? -রসুলপুর যাব। কিন্তু তুমি কে? -আমার নাম মতি এই এলাকায় ভ্যান গাড়ি চালাই। -ও তাই নাকি। আচ্ছা তুমি কি রসুলপুর যাবে? -হ যামু স্যার চলেন। মনে মনে চিন্তা করলাম কষ্ট করে স্টেশনে রাত কাটার চেয়ে গন্তব্যে চলে যাওয়া ভালো। তাই ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলি চল মতি। হাটতে হাটতে মতির ভ্যান গাড়ির সামনে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি একজন লোক আগে থেকে ভ্যানের উপর বসে আছে। লোকটি সমস্ত শরীর চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে। চেহারাটা পর্যন্ত ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। আমি কোন কথা না বলে লোকটার পাশে গিয়ে বসলাম। তার পরে মতি ভ্যান গাড়ি চালাতে শুরু করে। কিছু দূর আসার পরে আমরা একটি মাটির রাস্তায় উঠলাম। সেই রাস্তার দুই পাশে ছিল বিস্তৃত ধান ক্ষেত। যত দূরে চোখ যায় শুধ হলুদ পাকা ধানের হাসি। মাঝে মাঝে রাস্তার দুই পাশে হালকা কিছু গাছ দেখা যাচ্ছে। আর খরা মৌসুমে চাষাবাদের জন্য এক পাশে একটি খাল খনন করা আছে। আকাশে হালল্কা চাদের আলো তার পরে ও চারপাশটা বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আশেপাশে কোন জনবসতি নেই তাই চারদিকে শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছেনা। মাঝে মাঝে দূর থেকে একটি খেঁক শেয়ালের ডাক কানে ভেসে আসছে। কার্তিক মাসের শেষের দিকে তাই হালকা একটু শীত পড়ছে। মাঝে মাঝে হিমেল হাওয়া শরীলে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। তাই ব্যাগ থেকে জ্যাকেট নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। একটু পরে মতি জিগাস করে স্যার রসুলপুর আপনার কে থাকে? 

 

রসুলপুর আমার এক বন্ধুর বাড়ি। কিছুদিন পরে তার বড় ভাইয়ের বিয়ে তাই যাচ্ছি। -ও আচ্ছ মাঝ পথে আসার পরে মতি বলে স্যার আপনারা বসেন আমি একটু আসি। বুঝতে পারলাম সে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাচ্ছে। মতি পিঁছনের দিকে একটু দূরে গিয়ে রাস্তার থেকে নিচে নেমে গেল। তাকে আর দেখা যাচ্ছেনা। অনেকক্ষন বসে থেকে আমার কোমরে ব্যথা হয়ে গেছে। তাই ভ্যান গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার মধ্যে হাটাচলা করতে লাগলাম। অনেক সময় হয়ে গেছে কিন্তু মতি এখনো ফিরে আসছে না। আমি তখন তার নাম ধরে ডাকতে দিলাম কিন্তু উত্তর পেলাম না। আমার মাঝে কেমন একটা টেনশন কাজ করছে। কিন্তু আমার পাশে বসা লোকটি কোন সাড়া-শব্দ নেই, চুপচাপ বসে আছে। ব্যাগ থেকে তখন টর্চলাইটটা নিয়ে আস্তে আস্তে ঐ দিকে গেলাম, কিন্তু সেখানে গিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। আস্তে আস্তে আরো একটু সামনে গেলাম। হঠাত্ লক্ষ্য করলাম খালের পাশে কার যেন লাশ পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখি এটি মতির লাশ। কে যেন তাকে গলা কেটে হত্যা করেছে। আর তার রক্ত গড়িয়ে খালের জলে মিশে সেটি ও লাল হয়ে গেছে। এমন সময় লক্ষ্য করলাম ধান ক্ষেতের মাঝখান থেকে কিছু একটার শব্দ হচ্ছে। একসময় শব্দের তীব্রতা বাড়তে থাকে। বুঝতে পারলাম ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে কিছু একটা এদিকে আসছে। ভয়ে তখন দৌড় দিয়ে ভ্যান গাড়ির সামনে চলে আসি। কিন্তু এখানে এসে দেখি চাদর গায়ে দেয়া সে লোকট নেই। আমি চারপাশ ভাল করে দেখলাম কিন্তু কোথাও লোকটিকে দেখা পেলাম না। হঠাত্ লক্ষ্য করলাম দূর থেকে কতগুলো কুকুর শব্দ করতে করতে এদিকে ছুটে আসছে। কুকুর গুলোকে দেখে আমি দূত ভ্যানের উপর উঠে গেলাম। কুকুর গুলো ভ্যান গাড়ির সামনে এসে কান্নার সুরে ডাকেতে শুরু করে। মনে হচ্ছে কুকুর গুলো কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে। তাই ঐ দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এমন সময় খেয়াল করলাম ঐ দিকে নিচ থেকে কেউ একজন রাস্তার উপরে উঠেছে। হাতে থাকা টর্চলাইটটি সে দিকে ধরলাম। দেখি রাস্তার উপর এক মধ্যে বয়সী মানুষ দাড়িয়ে আছে। মুখে আর পোষাকে রক্ত মাখা দাগ। চোখ যেন জ্বল জ্বল করছে আর এক দৃষ্টিতে এদিকে তাকিয়ে আছে। লোকটিকে দেখে কুকুর গুলো ভয়ে সামনের দিকে দৌড় দিল। আমি তখন কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। চিন্তা করলাম ভাগ্যে যা থাকে থাকুক ব্যগটা নিয়ে সামনের দিকে দৌড় দেব। তাই ব্যগটি হাতে নিয়ে দিলাম একটা দৌড়। কিছু দূর আসার পরে খেয়াল করলাম সামনে দিয়ে একজন লোক হেটে যাচ্ছে। দূত তার কাছে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি এটি ভ্যানের সেই চাদর গায়ে দেয়া লোকটি। তাকে দেখে মনে কিছুটা সাহস পেলাম। লোকটিকে বললামভাই আপনি হেটে চলে আসলেন ঐ দিকে কে যেন মতি ড্রাইভার কে খুন করেছে। লোকটি গম্বীর গলায় উত্তর দিল-তাই নাকি? এই প্রথম আমি লোকটির গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিন্তু আওয়াজটি আমার কাছে অতি পরিচিত মনে হচ্ছে। মনের মাঝে কেমন একটা খটকা লাগে। তাই লোকটিকে বলি ভাই আপনি চাদর দিয়ে এভাবে মুখ ঢেকে রেখেছেন কেন? আপনে কি আপনার চেহারাটা দেখাবেন। আমার কথা শেষ হওয়ার পরে লোকটি তার মুখ থেকে চাদর সরালেন। চেহারাটা দেখে আমি হতভাগ হয়ে গেলাম। এটা কিভাবে সম্ভব! একটু আগে মারা যাওয়া মানুষটি জিন্দা হলো কিভাবে। আমার মুখ থেকে তখন আর কোন কথা বের হচ্ছিলো না। একসময় মনে হচ্ছে শরীল দূর্বল হয়ে আসছে আর আমি জ্ঞান হারাতে যাচ্ছি। তার পরে আর কিছু মনে নেই। হুশ আসার পরে দেখি আমার বন্ধু সহ তার পরিবারের লোকজন আমার চারপাশে বসে আছে। আর কে যেন আমার মাথায় পানি ঢালছে। 

বাড়িটি ভাড়া নিলাম। বিরাট বড় বাড়ি। বাড়িটার বাইরের পরিবেশ দেখলেই গাঁ ছমছম করে। বাড়ির দক্ষিণ দিকে বড় বাঁশ ঝাড়, উত্তর দিকে বেশ বড়সড় একটা পুকুর। পুকুরটার পানি খুবই পরিষ্কার। গরমের সময়। তাই বেছে বেছে দক্ষিণ দিকের রুমটাই থাকার জন্য ঠিক করলাম। আমাকে সব সময় সাহায্য করার জন্য গ্রামে একটা সাহসি ছেলেকে কাছে রাখলাম। ১৭ বছর বয়সি ছেলেটার নাম কাদের। সুঠাম দেহ। কোন কাজেই অনিহা নেই। সারা দিন কাজ করলেও ক্লান্তি তার শরীরে ভর করতে পারে না। ও আমার পাশের রুমটাতে থাকে। ৫-৭ দিন বেশ নির্বিঘ্নেই কাটিয়ে দিলাম। প্রথম অস্বাভাবি ঘটনার কথা বলছি। সেদিন অফিস থেকে ফিরলাম সন্ধ্যা ৭টার দিকে। এসে জামা কাপড় ছেড়ে বেসিনে গেলাম চোখে মুখে পানি দিতে। পানি ছেড়ে আয়নাতে তাকাতেই মনে হল একটা আলোর রেখা পিছন থেকে সরে গেল। পিছনে তাকিয়ে কিছুই পেলাম না। ভাবলাম দেখার ভুল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর একই ঘটনা আবার ঘটল। আলোটা একদেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে যেয়ে মিলিয়ে গেল। যেহেতু এটা ছিল আমার দেখা প্রথম অস্বাভাবিক ঘটনা তাই কেমন জানি একটা শিহরণ অনুভব করলাম। কাদের একটু পরেই বাজার থেকে আসল। দুজন মিলে রান্নার কাজটা সেরে খাওয়া দাওয়া করতে সাড়ে ১০টা বেজে গেল। খাওয়া শেষ করেই ও ঘুমাতে গেল। শুয়ে শুয়ে সন্ধ্যার ঘটনার পিছনে কারণ সন্ধান করছি। এমন সময় কারেন্ট চলে গেল। আমার খাটটা উত্তর দক্ষিণ ভাবে সে করায় দক্ষিণ দিকে পা দিয়ে শুয়ে আছি। কারেন্ট যাওয়া বাইরে থেকে চাঁদের আলো দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে ভিতরে এসে একটা অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হল জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশটা দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে। বাঁশ বাগানের আলো ছায়ার খেলা দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। আমার একটা অভ্যাস হল শত গরমের মধ্যেও ঘুমানোর সময় হাটু পর্যন্ত কাথা টেনে ঘুমানো। ঘুমে এক পর্যায়ে টের পেলাম পায়ের উপর কাথা নেই, সরে গেছে। কাথাটা হাটু পর্যন্ত টেনে আবার চোখ বুজলাম। কিছুক্ষণ পর মনে হল কাথাটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। শরীরের ক্লান্তির জন্য চোখুলতে ইচ্ছা হল না। ভাবলাম মনের ভুল। কিন্তু হঠাত্ করেই মনে হল কাথাটা দ্রুত সরে যাচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে বসতেই জানালায় চোখ গেল। মনে হল একটা ছায়া দ্রু সরে গেল। কাথার একটা অংশ জানালার মধ্যে ঢুকে আছে। হেচকা টানে কাথা ভিতরে নিয়ে নিলাম। সাথে সাথে বাঁশ বাগানের ভিতর থেকে খলখল হাঁসির শব্দ ভেসে এল। মেরুদণ্ডের উপর দিয়ে একটা ঠাণ্ডা শ্রোত বয়ে গেল। সারা শরীর অবস হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি। অসাড় দেহ নিয়ে আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি। এসময় দুরে বাঁশবাগানের মধ্যে একটা স্পষ্ট নারী ছায়ার সরে যাওয়া দেখলাম। হারিয়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে সে আমার দিকে একঝলক তাকালো। তার চাহনিতে যেন ক্রোধ ফুটে উঠেছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না এ মুহূর্তে আমার করণীয় কি। এনেকক্ষণ যাবত চুপচাপ বসার পর একটু নড়েচড়ে বসলাম। ঠিক তখনই দেখলাম পাশের চেয়ারে ঘটে চলা অপার্থিব এক ঘটনা। চেয়ারটা ১ইঞ্চি উপর দিয়ে ভেসে ভেসে নড়াচড়া করছে। একটা ছন্দে চেয়ারটা ঘুরছে। হঠাত্ করে চেয়ারটা ফুট দুয়েক উপরে উঠে গেল এবং চেয়ারটার পিছনে থাকা অদৃশ্য কেউ চেয়ারটাকে স্বশব্দে মাটিতে ছুড়ে দিল। গলা থেকে একটা ভয়াল আর্তচিত্কার বেরিয়ে এল। সাথে সাথে পাশের রুম থেকে কাদের ছুটে এল। কি হইছে ভাইয়া, খারাপ স্বপ্ন দেখছেন? আমি কোন কথা বলতে পারছিনা। কোন রকমে উচ্চারণ করলাম পানি। পানি খাওয়ার পরপরই কারেন্ট এসে গেল। কাদের রুমে চলে গেল। জানালা বন্ধ করে বাতি জ্বালিয়ে সারা রাত মিউজিক শুনলাম। বিষয়টা জানতে পারলে কলিগদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যাবে। এটা ভেবেই আমি কাউকে কিছু বললাম না এমনকি কাদেরকে ও না। বিকালে বাসায় ফিরে যতক্ষণ সম্বব কাদেরের সাথে থাকার চেষ্টা করলাম। রাত ১১টার দিকে কাদের শুতে গেল। আজ জানালা বন্ধ রাখলাম এবং সারা রাত বাতি জ্বালানো ব্যবস্থা করলাম। সে রাতে বিশেষ কিছু ঘটলনা। তবে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। পরের দিন বিকালে অফিস থেকে ফিরে যথারীতি বেসিনে হাতমুখ ধুতে গেলাম। ট্যাপ ছাড়লাম কিন্তু পানি পড়ছে না। ভাবলাম পানি নেই। কাদেরকে মটরটা ছাড়তে বলব তখন দেখি ফুল স্পিডে পানি পড়ছে। পানিতে হাত দিতেই পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেল। ট্যাপ বন্ধ করে যখন রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি তখন কোথা থেকে একঝাপটা পানি এসে সমস্ত শরীর ভিজিয়ে দিল। আমি দ্রুত রুমে চলে গেলাম। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। কাদেরকে ডেকে একটু কথা বলায় ভয়টা হালকা কমলো। রাত ১১টার দিকে কাদের ঘুমাতে যাওয়ার পর আমারো হালকা তন্দ্রা আসলো। একটা অদ্ভূত শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হল কেউ নুপুর পায়ে হাটছে। প্রায় ১ঘন্টা জেগে শব্দটি আবার শোনার জন্য অপেক্ষা করলাম। কিন্তু কোন শব্দ শুনলাম না। এবার ঘুমানোর চেষ্টা করবো ঠিক তখন স্পষ্ট শুনলাম আমার মাথাথেকে একটা নুপুরের শব্দ পায়ের পাশদিয়ে জানালা পর্যন্ত যেয়ে থেমে গেল। 

 

সারা রাতে আর কিছুই ঘটেনি। তবে সেই অদ্ভুত স্বপ্নটা আজো দেখলাম। ৬-৭ টা রাত পার হয়ে গেলো। রাত গুলোতে মাঝে মাঝে আমি গভীর কান্নার শব্দ শুনেছি। তবে প্রতিরাতেই আমি ঐ অদ্ভুত স্বপ্নটা দেখেছি। স্বপ্নটা ছিল এরকমঃ বাড়িটার সামনে শতশত লোক। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। বাড়িয়লার চোখ অশ্রুসিক্ত। সে সবাইকে কিছু একটা বলছে। এই স্বপ্নটাই প্রতিদিন দেখেছি। তবে আজ রাতের স্বপ্নটার কথা মনে হলেই গা শিউরে উঠছে, অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। আজ দেখলামঃ বাড়িটার সামনে শতশত লোক। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। বাড়িয়লা অশ্রুসিক্ত চোখে বলছে আমি ওকে বাড়ি ভাড়া দিতে চাই নি, আমার কথা শোনে নি, এখানে আসার পর এত কিছু ঘটলকিন্তু আমাকে কিছুই জানায় নি” সবাই দুটি কাফনে মোড়া লাশকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। কারো কারো মুখে বেশ কয়েকবার সুইসাইট কথাটা শুনলাম। সবচেয়ে স্পষ্ট যে কথাটা শুনলাম সেটা হল অমাবস্যা। কেউ কেউ বলছে অমাবস্যা রাতে এ বাড়িতে এমনই হয়। স্বপ্নটা দেখে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। কপালে হাত দিয়ে বুঝলাম জ্বর হয়েছে। থার্মোমিটারে ১০৪ ডিগ্রী শো করল। অসুস্থ্য শরীর নিয়েই অফিসে গেলাম। কোন কাজেই মন বসাতে পারলাম না। থেকে থেকে আমার শুধু অমবস্যা রাতের কথা মনে আসছে। আমার এক ঘনিষ্ট কলিগকে জিগগেস করলাম ” আচ্ছা ভাই, অমবস্যা রাত কবে বলতে পারবে? ” “কেন ভুত ধরবা নাকি” বলে হাসতে হাসতে চলে গেল। বিকালে বাসায় ফিরে দেখি কাদের বাজার করেই ফিরেছে। আমি জামা কাপড় ছেড়ে ওর কাছে গিয়ে বসলাম। আচ্ছা এই বাড়িতে কি ঘটেছিল জানো? হুম, এখানে একটা বড় ফ্যামিলি থাকত। রাতুল সাহেব, তার স্ত্রী, ২ ছেলে ও ১মেয়ে। অভাব অনাটন সব সময় লেগেই থাকত। মেয়েটা কলেজে পড়ত। টাকার অভাবে বেতন দিতে পারত না। সংসারে সারা দিন অশান্তি লেগেই থাকত। তারপর এক অমাবস্যা রাতে সবাই এক সাথে সুইসাইট করল। বাবা মা আর মেয়েটা গলায় দড়ি দিল। ছেলে দুইটাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছিল। কাহিনিটা একনিঃশ্বাসে বলে থামল কাদের। প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য আমার দিকে তাকাল। ভয়ে চাদরটা জোরে আকড়ে ধরে আছি। কাপাকাপা গলায় জিগগেস করলামঃ “তোমার ভয় করেনা? ” “নাঃ” “এতো দিন এখানে থাকলে, কিছু দেখেছো? ” “হুম” “কি দেখেছ? ” “পায়ের ছাপ। প্রায় প্রতিদিন সকালেই অসংখ্য ছোট বাচ্চার পায়ের ছাপ দেখেছি। ” “আর? ” “কান্নার শব্দ শুনতাম। বাচ্চার কান্নার শব্দ। ” “আচ্ছা, অমাবস্যা রাতে এ বাড়িতে অনেক কিছু ঘটে তাইনা? ” “হুম” “আমাদের তো মেরেও ফেলতে পারে তাই না? ” “হুম” আমি আর একটা কথা অনেক সাহস করে জিগগেস করলাম “অমাবস্যা কবে? ” এ প্রশ্নে ও কিছুটা চমকে উঠল। বেশকিছু সময় পর মাথা নেড়ে বলল “জানি না” সাড়ে ১০টার দিকে শুয়ে পড়লাম। বাইরে একটা ডাহুক পাখি ঘনঘন ডাকছে। ১১টার দিকে কারেন্ট চলে গেল। উঠে মোমবাতিটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখে ঘুম ঘুম ভাব এসেছে। ঠিক তখনই মনে হল আমার মাথার কাছে কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। আমি নড়েচড়ে উঠলাম। এসময় চোখ গেল ফ্যানের দিকে। দেখি সেটার পাখা গুলো জোরে জোরে কাপছে। ঠিক এমন সময় পাশের রুম থেকে কাদেরের ভয়াল চিত্কার শুনে আমিও চিত্কার করে ওর রুমে ছুটে গেলাম। যেয়ে দেখি ও মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর ওর কানের নিচ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আমাকে দেখামাত্রই আমার পা জড়িয়ে ধরে বলল “ওরা আমাকে মেরে ফেলবে আমাকে বাচান”। শক্ত কিছুদিয়ে মারার চিহ্ন দেখলাম। ওকে আমার রুমে নিয়ে এসে ক্ষত জায়গাটা গামছা দিয়ে বেধে দিলাম। দুজন পাশাপাশি বসে আছি। কারো মুখে কোন কথা নেই। পাশে টেবিলে রাখা মোমবাতিটা টিম টিম করে জ্বলছে। হঠাত্ করে দরজার পাশ দিয়ে নুপুরের স্পষ্ট শব্দ শোনা গেল। মনে হল নুপূর পায়ে কেউ দৌড়ে গেল। ও আমার আরো কাছে সরে এল। সাথে সাথে পাশের ঘরের আয়নাটা সশব্দ ভেঙে পড়ল। আবার নুপুরের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমার দরজা পর্যন্ত এসে থেমে গেল। এবার মনে হচ্ছে আমাদের দিকেই আসছে। ঝুম, ঝুম, ঝুম। হঠাত্ করেই মোমবাতিটা নিভে গেল। অন্ধকারের একছত্র অধিপত্য কায়েম হল। অন্ধকারের বুকচিরে আবার নুপুরে শব্দ এদিকেই এগিয়ে আসছে। কাদের আমাকে জড়িয়ে ধরল। হঠাত্ কাদের গগন বিদারি চিত্কার দিয়ে রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। মোবাইলের আলো জ্বেলে ওর পিছনে দৌড়াতে যেয়ে কিছু একটাতে বেধে পড়েই জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরল দেখি মোবাইলের টর্চটা তখনো জলছে। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার। একটা ভেজা ফ্লোরে আমি পড়ে আছি। প্রচণ্ড দূর্বল শরীরটাকে কোন রকমে টেনে তুললাম। টর্চের আলোতে দেখি ফ্লোরটা রক্তে ভিজে গেছে। কপালে প্রচণ্ড ব্যাথা। ধীরে ধীরে কাদেরের রুমে ঢুকলাম। ঢুকে এক বিভত্স দৃশ্য দেখে চিত্কার দিয়ে বেরিয়ে এলাম। কি মনে করে ঐ ঘরে আবার ঢুকলাম। ফ্যানের সাথে দড়ি দিয়ে ঝুলে আছে দেহটা। চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। জিহ্বাটা ইঞ্চি তিনেক বাইরে বেরিয়ে আছে। মাথাটা ঘুরে নিচে পড়ে গেলাম। একটা সাদা কাগজের উপর মোবাইলটা ছিটকে পড়ল। সেখানে অস্পষ্ট ভাবে লেখা “আপনি পালান, আজই অমাবস্যা” অনুভূতিহীন চোখে mobile screen এ দেখলাম battery low shut down. আবার অন্ধকার নেমে এল। অন্ধকারের বুক চিরে নুপুরের শব্দটা আবার শোনা যাচ্ছে।।। 


Tanvir Arafat

93 Blog posts

Comments