" বাহ্! খুব সুন্দর হয়েছে। এক কথায় দারুন। "
" Fantastic! Mind blowing! কিচ্ছু বলার নেই। আমি জাস্ট আপনার ফ্যান হয়ে গেছি। "
" সত্যিই আপনি অনবদ্য। আপনার লেখার জবাব নেই। "
এইরকম ভাবেই সন্ধ্যের থেকে প্রশংসার ঝড় আছড়ে পড়ছে আমার উপর। সত্যি বলতে আমার বেশ ভালোই লাগছে। একজন শিল্পীর এর থেকে বেশী আর কি চাই! শিল্পী এইজন্যই বলছি কারন সম্প্রতি আমার একখানি বই বেড়িয়েছে, নাম : A Lady with A Dark Tell। তারই সাফল্যতায় আমার প্রকাশক পার্ক স্ট্রিটের এক খ্যাতনামা পাঁচ তারা হোটেলে আজকের এই পার্টির আয়োজন করেছে। চারিদিকের জাঁকজমক, আলোক সাজ সরঞ্জাম, মানুষের কোলাহল, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ - এই সবকিছু নিয়েই যেন এখানে ছোটখাটো একপ্রকার উৎসব বসে গেছে, আর আমি হলাম সেই উৎসবের একমাত্র মধ্যমনি। কিন্তু এতকিছু হওয়া সত্ত্বেও একটা অন্যমনস্কতা বারবার আষাঢ়ের মেঘের মতো জমা হচ্ছিলো আমার মনের মধ্যে। এই যে এতকিছু, এত জাঁকজমক, এত মানুষের প্রশংসা, চর্চার শিরোনামে থাকা - এই সবকিছু আমার একার নয়। জানি সে হয়তো কোনোদিনই এই কৃতিত্বের ভাগ চাইতে আসবে না। তবুও সে না থাকলে হয়তো আমার এই গল্পখানি লেখাই হতো না। এবার আপনারা ভাবতেই পারেন যে, এই গল্পটা কি আমার নয়! আমি বলবো, না। জানি আপনারা শুনে অবাক হচ্ছেন। আমিও হয়েছিলাম সেদিন। হয়তো আপনাদের থেকে আরও অনেক বেশি। যেদিন ঘটনাটা ঘটেছিল। আমি নিজেও জানিনা সেদিন আসলে কি হয়েছিলো! সেদিনকার ঘটনার কোনো ব্যাখ্যাই আমার কাছে নেই।
আমি দীপরাজ। কলকাতার একটা বেসরকারি ইন্জিনিয়ারিং সংস্থায় মোটামুটি বেতনের একটা চাকরি করি। বুঝতেই তো পারছেন, বেসরকারি সংস্থা মানেই অত্যাধিক কাজ আর অত্যাধিক কাজ মানেই অত্যাধিক চাপ। তো এই অত্যাধিক কাজের চাপের মধ্যেও আমার যে সত্ত্বাটাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছি তা হলো আমার লেখন। যাইহোক এবার আসল কথায় আসি। কলকাতায় আমি কর্মসূত্রে থাকলেও আমার আসল বাড়ী হলো ফুলসূড়ীতে। ফুলসূড়ীর ভৌগোলিক অবস্থান এক্ষেত্রে নিষ্প্রয়োজন, তাই আর সেটা উল্লেখ করছিনা। তবে ফুলসূড়ীতে আমাদের যৌথ পরিবার। সবাই একসাথে, মিলেমিশে থাকি। কিন্তু বছর দশেক হলো আমাকে চাকরির জন্য কলকাতায় চলে আসতে হয়েছে। তবে এই কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝে হারিয়ে গেলেও রোজ রাতে বাড়ি ফিরে বাড়ির লোকের সাথে ফোনে কথা বলতে কখনই ভুলিনা। এরকমই একদিন রাতে বাড়িতে ফোন করে কথা বলছি, মায়ের কাছ থেকে খবর পেলাম যে, ঠাকুমার নাকি ভীষন শরীর খারাপ। তাই আর থাকতে না পেরে পরেরদিনই অফিস থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়ে তারপরের দিনই সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম ফুলসূড়ীর উদ্দেশ্যে।
হাওড়া থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ট্রেনে সফর করে যখন প্ল্যাটফর্মে নামলাম দেখি পংকা নিতে এসেছে। পংকা আমার কাকার ছেলে অর্থাৎ খুড়তুতো ভাই। ওকে দেখে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। সটান ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম, " কিরে ভাই, কেমন আছিস? " পংকাও হেসে বললো, " হ্যাঁ দাদা ভীষণ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস রে? " এরকম কিছু ক্ষুদ্র কথোপকথনের পর পংকা আমার ব্যাগটা নিয়ে " চল দাদা" বলে এগিয়ে যেতে লাগলো। আমিও ওর পিছু পিছু প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে একটা ভ্যানে গিয়ে চড়লাম। ভ্যানে চড়ে আসতে আসতে পংকার সাথে আরও অনেক কথা হলো। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে ভ্যানের ঝাঁকুনি খাওয়ার পর আমরা অবশেষে পৌঁছালাম। ভ্যান থেকে নেমে যখন বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম আমায় দেখে বাড়ির মধ্যে যেন একপ্রকার হুলস্থুল পড়ে গেলো। মা তো আমাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কেঁদেই ফেললো, " বাবা, কেমন আছিস তুই? কতদিন পর তোকে দেখলাম!" একে একে বাবা, কাকা, কাকি এমনকি যার জন্য এতদূর থেকে ছুটে আসা অর্থাৎ ঠাকুমা, সবার সাথেই দেখা হলো। কিছুক্ষণ ঠাকুমার পাশে বসে কথা বললাম। দেখলাম ঠাকুমা আগের তুলনায় একটু সুস্থ আছে।
রাতের বেলা আমরা সবাই মিলে খেতে বসেছি। আমাদের বাড়িতে ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়ার রেওয়াজ কোনোদিনই ছিল না। আমরা আগাগোড়াই নীচে আসন পেতে তার উপর বসেই খাই। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মা আমার পাতে আরেকটা মাছের টুকরো দিয়ে বললো, " তা বাবু বললিনা তো মাছের কালিয়াটা কেমন হলো!" আমি খেতে খেতে বললাম, " উহু! তোমার কোনো জবাব নেই মা! সেই স্বাদ! এখনও একটুও পাল্টায়নি। " বাবা বললো, " সে না হয় হলো। তা বল কলকাতায় কাজ কেমন চলছে? "
- সব ঠিকই আছে। তবে কি জানোতো কাজের প্রচন্ড চাপ। মাঝে মাঝেতো দম নেওয়ার ফুরসৎ-ই পাইনা।
- সেতো নিশ্চয়ই। মনে রাখবি সব সময় সৎ পথে পয়সা কামাতে গেলে কষ্ট করতেই হবে।
বাবার কথা শেষ হতেই কাকি বলে উঠলো, " তা দীপু বাবা! অনেক দিনতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরলে। এবার বিয়েটা করে ফেলো দেখিনি। আমারও তো সখ হয় একটু কাকি শ্বাশুড়ি হওয়ার। " কথাটা শুনে সকলে হেসে উঠলো। মা বললো, " হ্যাঁ রে বাবা! কাকিমা তো ঠিক কথাই বলেছে। " আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলাম। এর মাঝে আবার কাকাও ফোড়ন কেটে উঠলো। বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, " দেখো দাদা! দীপু আবার যেন শহরের প্যান্ট জামা পড়া কোনো মেয়েকে না বিয়ে করে নিয়ে আসে!" আবার সবার সমবেত হাসি। আমি চুপচাপ মাথা নিচু করেই খেতে লাগলাম। আঁর চোখে দেখলাম পংকা সবার কথা শুনে মিচকি মিচকি হাসছে। হঠাৎ বাইরে থেকে কিসের একটা হট্টগোল ভেসে এলো। মনে হলো যেন কিছু মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে চেঁচামেচি করছে। ঘরে উপস্থিত সকলেই তাদের হাসি থামিয়ে দিয়ে সরব হয়ে উঠলো। বাবা বললো, " কি ব্যাপার! এত চিৎকার চেঁচামেচি কিসের!" বলেই উঠে পড়লো। আমিও বাবাকে দেখে আর চুপচাপ বসে থাকতে পারলাম না। বাবার পিছন পিছন আমিও উঠে পড়লাম। বাইরে এসে দেখলাম যে, আমাদের পাশের বাড়ি মানে বিশু কাকাদের বাড়িতে বেশ কিছু লোক দাঁড়িয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছে এবং একে অপরের সাথে কথা বলছে। প্রত্যেকের মুখেই উত্তেজনার ছাপ। আমি আর বাবা এগিয়ে গেলাম কি হয়েছে ব্যাপারটা দেখতে। " দাঁড়া দাদা" বলে পংকাও আমাদের পিছন পিছন আসলো। বিশু কাকার বাড়ির সামনে যেতেই এক বিকট কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা তিনজনেই তাড়াতাড়ি করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ভেতরে ঢুকেই দেখলাম বিশু কাকা বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁপছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত এবং স্হির। তাঁর পাশেই বিশু কাকার স্ত্রী মানে কাকিমা বিশু কাকার হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে চলেছে, " একি হলো গো তোমার!" একটু ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, " কি হলো গো! কথা বলছো না কেন! কি হয়েছে তোমার? " ব্যাপারটা যে কি তা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঘরে উপস্থিত বাকি আর সবার দিকে তাকালাম। তাদের মুখেও উদ্বেগের চাহনী। বাবা পাশেই দাঁড়ানো একটা মাঝ বয়সী লোককে জিজ্ঞেস করলো, " হারাণ, কি হয়েছে রে বিশুর? ওর বউ ওমন করে কাঁদছে কেন? শরীর টরীর খারাপ করলো নাকি? " লোকটি বেশ হতাশ হয়েই বললো, " দাদা কি আর বলি! শরীর খারাপ করলেও না হয় হতো! কিন্তু সে সব তো কিছুই হয়নি। ওকে বোধহয়..." লোকটি তাঁর কথা শেষ করার পূর্বেই " দেখি দেখি সরুন। রাম গুনিন এসেছেন" বলে বিশু কাকার ছেলে আরেকটি লোককে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। লোকটিকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি একজন ভূত বিশেষজ্ঞ মানে ওঝা। গায়ে একটা কালো আলখাল্লা, কাঁধে একটা লাল রঙের পুঁটলি এবং গলায় অজস্র রং বেরঙের পুঁতির মালা। বিশু কাকার ছেলে লোকটিকে একটা টুল এগিয়ে দিলো। লোকটি টুলটি টেনে একদম বিশু কাকার মুখের সামনে গিয়ে বসলেন। ততক্ষণে বিশু কাকার বউও একটু শান্ত হয়েছে। লোকটি প্রথমে বিশু কাকার কপালে হাত রেখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। দেখে মনে হলো তিনি বোধহয় বিশু কাকার চোখে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ উঁকি ঝুঁকি করার পর কপাল থেকে হাত সরিয়ে বিশু কাকার বউকে বললেন, " ভয় নেই মা। তোর স্বামীর তেমন কিছুই হয়নি। সামান্য দৃষ্টি লেগেছে মাত্র। তবে আজ কিন্তু ও বেশ বড়সড় বিপদে পড়তে যাচ্ছিলো। শুধু সঠিক সময়ে ওকে পাওয়া গেছে বলে ও এইবারের মতো রক্ষা পেলো। " কথাটা শোনার পর বিশু কাকার বউ চোখ বন্ধ করে কপালে হাত ঠুকে বেশ কয়েকবার প্রনাম করলো। লোকটি " দাঁড়া" বলে নিজের পুঁটলিটাতে হাতরে একটা মাদুলি গোছের কিছু একটা বার করলেন। তারপর সেটা মুখের সামনে ধরে বিড়বিড় করে বেশ কিছুক্ষন কি সব বলে সেটাতে পরপর তিনবার ফুঁ দিয়ে বললেন, " এই নে মা! এই মাদুলিটা আজ মধ্যরাতে ওকে পড়িয়ে দিবি। তাহলেই ওর সব বিপদ কেটে যাবে। " এই বলে লোকটি আবার বিশু কাকার কপালে হাত রেখে আবার মুখ দিয়ে কি সব বিড়বিড় করে বিশু কাকার আপাদমস্তক লম্বা লম্বা তিনটে ফুঁ দিয়ে উঠে পড়লেন। বিশু কাকার ছেলে এগিয়ে এলো তাঁকে বাহির অবধি ছেড়ে দেবে বলে। ওরা বেড়িয়ে যাওয়ার পর লক্ষ্য করলাম বিশু কাকাকে আগের তুলনায় একটু স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। চোখে মুখে সেই ভয় ভাবটা আর নেই। বাবা এবার টুলটা টেনে নিয়ে বিশু কাকার সামনে গিয়ে বসে বললো, " হ্যাঁ রে বিশু! কি হয়েছিল রে তোর? " বিশু কাকা একটু থেমে থেমে বললো, " আর দাদা কি বলবো! আজকে আমাদের কারখানায় কাজের চাপটা একটু বেশি থাকায় আমাদের সকলকেই একটু বেশীক্ষন থাকতে হয়েছিল। রাত সাড়ে আটটার সময় কারখানা থেকে সাইকেল চালিয়ে ফিরছিলাম। গাঁয়ে ঢুকেই কি মনে হতে ভাবলাম একেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে ফিরতে, তাই আর ঘুরে যাবো না। এই ভেবে আমি গড়কড়িদের বাড়ির রাস্তাটা ধরলাম। দিব্যি গুনগুন করতে করতে সাইকেল চালিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ গড়কড়িদের বাড়ির গেটের সামনে আসতেই স্পষ্ট দেখলাম কেউ একজন সাদা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখেই আমি অজ্ঞান হয়ে সাইকেল থেকে মাটিতে পড়ে গেলাম। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। " পিছন থেকে হারাণ নামক লোকটি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলো, " হ্যাঁ দাদা! অনেক রাত হচ্ছে দেখে বিশুর বউ আমার বাড়িতে এসে কান্নাকাটি করতে থাকে। তখন আমি, বিশুর ছেলে এবং পাড়ার কয়েকজন মিলে বিশুকে খুঁজতে বের হই। সারা পাড়া জুরে খোঁজাখুঁজি করার পর শেষমেশ ওকে খুঁজে পাই ওই গড়কড়িদের বাড়ির গেটের সামনে। দেখি বিশু সেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। পাশে ওর সাইকেলটাও পড়ে। তারপর তো আমরা সবাই মিলে ওকে ধরে ঠরে নিয়ে আসি। " বাবা সব শুনে বললো, " হুম সত্যিই বিশু আজ তুই বড়ো বিপদ থেকে বেঁচে গেছিস। ওরা না খুঁজে পেলে যে কি হতো; সেটাই ভাবছি... আচ্ছা তুই শুয়ে থাক একটুক্ষণ। আমি এখন যাই বুঝলি। " তারপর বিশুর বউর দিকে তাকিয়ে বললো, " আচ্ছা বৌমা যদি কিছু অসুবিধা হয় তাহলে আমাকে ডেকো কেমন!" বলে বাবা টুল ছেড়ে উঠে বেড়িয়ে পড়লো। পিছন পিছন আমি আর পংকাও বেড়িয়ে পড়লাম।
রাত্রিবেলা অনেকক্ষণ ধরেই এপাশ ওপাশ করে চলেছি। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আর আসছে না। বারবার গড়কড়িদের বাড়িটার কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এই আদিম বাড়িটার কথা আমি একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু বিশু কাকাদের বাড়িতে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার পর থেকেই আবার সবকিছু মনে পড়ে যেতে লাগল। সত্যি বলতে ছোটবেলা থেকেই এই বাড়িটাকে ঘিরে অনেক গল্প আমি শুনেছি। রীতিমতো হানাবাড়ি বলেই এটি খ্যাত। শুনেছিলাম তাদের বাড়ির বড় বৌ নাকি ভীষন দুশ্চরিত্রা ছিলেন। নিজের দেওরের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তারপর হঠাৎ একদিন নাকি তাঁর মৃতদেহ ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁরই ঘর থেকে পাওয়া যায়। সবাই বলে সে আত্মহত্যা করেছিলেন। আর তারপর থেকেই তাঁর আত্মা নাকি সেই বাড়িতেই ঘোরাঘুরি করে। এই সবই আমার শোনা কথা মাত্র। এতবছরে আমি কোনদিনই চাক্ষুষ কোনো ভূতকে প্রত্যক্ষ করিনি সেখানে। যাইহোক কাল একবার ওই বাড়িটাতে যাবো ভাবছি। কারন মনের মধ্যে ভীষণ কৌতুহল হচ্ছে।
পরেরদিন সকালে আমি আর পংকা কি একটা কাজে স্টেশন গিয়েছিলাম। ফেরার পথে বললাম, " চল ভিতরের রাস্তা দিয়ে যাই। তাড়াতাড়ি হবে। " পংকা একটু থেমে গিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বললো, " কিন্তু দাদা ভিতরের রাস্তাটাতো..."
- গড়কড়িদের বাড়ির সামনে দিয়ে যায় তো!
পংকা কিছু বললোনা। কেবল উপর নীচ মাথা নাড়লো। আমি একটু ধমকের সুরে বললাম, " তাতে কি হয়েছে! এই সাত সকালে বুঝি তোর জন্য ওখানে ভূত অপেক্ষা করছে! ভীতু কোথাকার! নে চল এবার। " এই বলে আমি হাঁটতে শুরু করলাম। দেখলাম পংকা সেই একই রকম কাচুমাচু মুখ করে আমার পিছন পিছন হাঁটছে। মিনিট দশেক হাঁটার পর ভগ্নপ্রায় পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একখানি বিরাট আকারের বাড়ি চোখে পড়লো। বলাই বাহুল্য, এইটিই হলো সেই গড়কড়িদের বাড়ি। শুনেছি একটা সময়ে তারা নাকি খুব বিত্তশালী ছিলেন। সেই ছাপটা আজও সেই আদিম দশাসই বাড়িটিতে স্পষ্ট। বাড়িটার মেইন গেটটার সামনে আসতেই আমার পা নিজের থেকেই থেমে গেলো। পংকা আমাকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে উদ্বিগ্ন ভাবে বললো, " এই দাদা! তুই দাড়িয়ে গেলি কেন এখানে? " আমি পংকার সেই কথায় কোনোরকম কর্ণপাত না করে বাড়ির গেটটার দিকে একটুখানি এগিয়ে গেলাম। পংকা আরও বললো, " এই দাদা! তুই কি করছিস? এবার ঢুকবি নাকি বাড়িটার ভেতরে!" আমি পংকার দিকে তাকিয়ে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে ওর ভাবনাটাকে সম্মতি জানালাম। পংকা আবারও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু ওকে থামিয়ে দিলাম। বাড়িটাকে বাইরে থেকে দেখলেই গাটা বেশ ছমছম করে ওঠে। পাঁচিল ঘেরা জমিটার মধ্যে ঝোঁপ ঝারের সমাবেশ। দেখলেই বোঝা যায় বহুদিন এখানে কোনো মানুষের পা পড়েনি। সেই অবিন্যস্ত ঝোঁপ ঝাড়গুলির মধ্যেই যেন ভগ্নদশা সম্পন্ন আদিম বাড়িখানি আপন মনে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্বকে জাহির করে যাচ্ছে। মনুষ্যহীন কঙ্কালসার বাড়িটিকে দেখলেই মনে হয় যে, কতো গল্প, কতো রহস্যই না লুকিয়ে রেখেছে সে তার নিজের অভ্যন্তরে। আমি যেন মনে মনে এক চরম কৌতুহল অনুভব করছিলাম বাড়িটার প্রতি। তাই আমি আর দেরি না করে বাড়ির মেইন গেটটা খুলতে গেলাম। দেখলাম সেটা ভীষণ শক্ত। দীর্ঘদিন ধরে অপব্যবহারের ফলে এবং বৃষ্টির জল লেগে সেটি শক্ত হয়ে গিয়েছে। বেশ কয়েকবার ঠেলাঠেলি করতেই সেটি একটা বিকট শব্দ করে খুলে গেলো। আমি মনে মনে একটু বিজয়ীর হাসি হাসলাম। আর সময় নষ্ট না করে ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকতে লাগলাম। পেছন থেকে বেশ কয়েকবার ফিসফিসিয়ে গলায় পংকা " দাদা! দাদা" করলো বটে কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার ওই বাড়ির প্রতি অসীম কৌতুহলের কাছে পংকার সাবধান বানী অতি তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছিলো। আগেই বলেছি বাড়িটা আকারে বিশাল। তেতলা বিশিষ্ট বিরাট বাড়িখানির সামনে একটা লম্বা টানা বারান্দা। তার ধারেই চারটে বিশাল উঁচু ও মোটা গোছের থাম। সেগুলি আবার লোহার তৈরি রেলিং দিয়ে একে অপরের সাথে যুক্ত। মাঝখান বরাবর একটি ছয় ধাপের সিঁড়ি উঠে গেছে বারান্দার দিকে। তারপরই এক বিরাট কাঠের তৈরি দরজা। যদিও সেখানে এখন লতা জাতীয় উদ্ভিদগুলি নিজেদের অধিকার জমিয়ে সেই জায়গাটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। আমি সেই দিকে ধীরে পায়ে এগোতে লাগলাম। অতি সাবধানে পা ফেলে এগোচ্ছি কারণ এই পোড়ো বাড়িটিতে ভূতের থেকেও যেটা বেশি বিপদজনক তা হলো সাপ। এখানে ভূত থাকুক ছাই না থাকুক তবে এই ঘন আগাছার জঙ্গলে সাপ থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পিছন পিছন পংকাও আমার শার্টটাকে খামচে ধরে এগোতে লাগলো। বেশ কিছুটা এগোতেই হঠাৎ সামনের দিকে একটা ঝোঁপ একটু নড়ে উঠলো। পংকা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, " দাদা চলনা। বাবা জানতে পারলে খুব রাগ করবে। " আমি আবার একটা চাপা ধমক দিয়ে বললাম, " চুপ! আগে দেখতে দে। " বুঝতে পারলাম পংকা আমার শার্টটাকে আরও জোড়ে খামচে ধরেছে। আমরা আবার চলতে শুরু করলাম সেই একইরকম ধীরে ধীরে। আমার চোখ কিন্তু সেই দিকেই স্থির। আবারও ঝোপটা নড়ে উঠলো। এবার যেন মনে হলো ঝোঁপটা ওই জায়গায় নয় তার থেকে একটু সরে গিয়ে নড়ে উঠলো। বুক যে আমারও ঢিপঢিপ করছিলো না তা নয়। কিন্তু পংকার সামনে সেই ভাবটাকে মুখে আনা একদম চলবে না। চলতে চলতে যখন আমরা আরেকটু এগিয়েছি তখনই হঠাৎ ঝোঁপটা তীব্র বেগে নড়ে উঠতে শুরু করল। তবে সেটা এক জায়গায় স্থির নয়। সেটা বিদ্যুৎ-এর গতির মতোই এগিয়ে আসছে আমাদেরই পথের দিকে। বুঝলাম পংকা আমার বাঁ হাতের কনুইটাকে শক্ত করে চেপে ধরেছে। আমিও আমার হাতের মুঠি দুটোকে শক্ত করে নিলাম। একটা আশঙ্কা যেন মাথায় ভারী হয়ে উঠছে ক্রমাগত। স্থির দৃষ্টিতে অপেক্ষা করে আছি সেই অজানা বস্তুটির জন্য। ঝোঁপের একদম শেষ দিকটা নড়ে উঠতেই পংকা তারস্বরে চিৎকার করে উঠলো, " ওরে বাবা রে!" আর ঠিক তখনই ঝোঁপ থেকে ক্ষীপ্র বেগে বেড়িয়ে এলো একটি বিড়াল। সাদা ধবধবে রং। তবে লেজের দিকটা লালচে। আমাদের দেখেই বিড়ালটি আবার তার গতি পরিবর্তন করে গড়কড়িদের বাড়ির বারান্দাটার দিকে দৌড়াতে শুরু করলো। দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির পিছনের দিকটায় গিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে মিলিয়ে গেলো। আমি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। তারপর একটু থেমে থেমে হেসে বললাম, " কিরে, তোর প্যান্ট ভেজেনিতো!" পংকা আমার কনুই থেকে হাতটা সরিয়ে বললো, " দাদা! বাজে কথা বলিসনা তো। " এবার আমি আরেকটু জোরে হেসে উঠলাম, " দেখলিতো তোর ভূত! বিড়াল হয়ে কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে! ভীতুর ডিম একটা! আমি যদি এখানে না থাকতাম তাহলে তো তোর..." বাড়িটার বারান্দার একদম ডানদিকে চোখ যেতেই আমার বুকটা ধক করে নড়ে উঠলো। মনে হলো কোনো মহিলা বোধহয় সেখানটাতে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি কথাগুলো শেষ না করেই দৌড়ে সেদিকে যেতে লাগলাম। পংকা উদ্বিগ্ন ভাবে বললো, " আরে দাদা, কোথায় যাচ্ছিস? কি রে!" আমি পংকার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে কয়েকটা ঝোঁপ টপকিয়ে যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছালাম দেখলাম কেউ নেই। বেশ অবাক হলাম। এইমাত্র তো কাউকে দেখলাম বলেই মনে হলো... তাহলে কি ভুল দেখলাম! পংকাও দেখলাম " এই দাদা" করতে করতে অতি সাবধানে ঝোঁপগুলো কে পেড়িয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। চোখে মুখে কৌতুহল স্পষ্ট, " দাদা কি হয়েছে? ওমন করে দৌড়ালি কেন? " আমি আবার এদিক ওদিক ভালো করে তাকিয়ে নিয়ে বললাম, " নারে কিছু না, চল। "
- তাহলে ওমন করে দৌড়ালি যে!
এবারে পংকাকে মৃদু ধমক দিয়ে বললাম, " বললাম না, কিছু না। " বলেই মেইন গেটটার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। পংকাও আমার পিছু ধরলো।