ফ্লাইট নাম্বার ১৪০৬

কুয়ালালামপুর থেকে এক ঘন্টার বিমান যাত্রায় পৌঁছে গেলাম লাংকাউই। প্লেন থেকে নেমেই গা ছম ছম করা অনুভূতি। অন্য ব??

কুয়ালালামপুর থেকে এক ঘন্টার বিমান যাত্রায় পৌঁছে গেলাম লাংকাউই। প্লেন থেকে নেমেই গা ছম ছম করা অনুভূতি। অন্য বিমান বন্দরগুলো থেকে এই এয়ারপোর্ট যেন ঠিক একেবারেই আলাদা। এয়ারপোর্টের চারপাশে তাকিয়ে যে জৌলুস চোখে পড়ে তা নেই এখানে। অরণ্য, পর্বত আর সাগরের মাঝখানে অবলীলায় নেমে গেলাম আমরা প্রায় তিনশ’ ট্যুরিস্ট। আমি যদি দৃষ্টিপাতের লেখক যাযাবরের মতো বাংলা লিখতে পারতাম তবে লাংকাউই বিমান বন্দরটিকে উইলিংডন এয়ারপোর্টের সাথে তুলনা করতে পারতাম। কিন্তু আমার বাংলা লেখার গাঁথুনি অতো শক্ত নয়। তাই অমন করে বর্ণনা করা আমার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। যাযাবর (বিনয় মুখোপাধ্যায়) তার দৃষ্টিপাতে লিখেছেন উইলিংডন এয়ারপোর্টটি বৃহৎ নয়। কিন্তু গুরুত্বে প্রধান, সংবাদপত্রে এর বহুল উল্লেখ। একথাটা লাংকাউই এয়ারপোর্টের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। ছোট্ট একটা দ্বীপের সাদামাটা একটা এয়ারপোর্ট। কিন্তু লাংকাউইয়ের গুণগান সকলের মুখে মুখে। লাংকাউই শুধু এশিয়ার নয় পৃথিবীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্যুরিস্ট স্পট। 

 

এখানে কোন ইমিগ্রেশন নেই কারণ আমরা একই দেশে ভ্রমণ করছি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। ছোট্ট এয়ারপোর্টের মূল ভবনে এসে এবার ভালো করে আমাদের সহযাত্রীদের মুখগুলোর দিকে একবার তাকালাম। প্রায় সবার চেহারাই ইউরোপীয় ধাঁচের। হাতে গোনা কয়েকজন চায়নিজ। অর্থাৎ বুঝাই গেল আমরা সবাই ট্যুরিস্ট। নিছক ভ্রমণের অভিপ্রায়েই আমরা সবাই এখানে এসেছি। ভ্রমণ ছাড়া অন্য কোন কাজে মানুষ লাংকাউই আসবেই বা কেন? ডিপারচার অর্থাৎ নির্গমন গেটের দিকে চাইতেই দেখলাম একজন নারীর বিশাল পোট্রেট সামনের দেয়ালে। বুঝতে চেষ্টা করলাম এই রমণীটি কে। জাতীয় পর্যায়ে কোন বিখ্যাত নারী ছাড়া এখানে কোন পোট্রেট থাকার কথা নয়। ছবিটির সামনে এগিয়ে গেলাম আমি আর আমার মেয়ে অনি। অন্য ট্যুরিস্টরা যে যার মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কোন তাড়া নেই। আর অজানাকে জানার জন্যই এই দ্বীপে এসেছি, যে দ্বীপটিকে তাবৎ চরাচর থেকে আলাদা বলেই অনুমান হয়। আমি আর অনি বেশ কিছুক্ষণ পোট্রেটটির নিচে এবং আশেপাশে মেয়েটির নাম অথবা পরিচিতি খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথাও তার পরিচয় লেখা নেই। 

 

লোকালয় থেকে তেপান্তরে এসে হঠাৎ কোন নারীকে চেনাও প্রায় অসাধ্য। ব্যাংকক শহরে যদি আপনি ট্যাক্সিতে এক চক্কর দেন তবে দেখবেন প্রতিটি হাইরাইজ ভবনে রাজা-রানীর যুগল কিংবা একক পোট্রেট লাগানো আছে। রাজকীয় ঢং-এর পোট্রেট। দেখলেই বুঝা যায় এটি রানী কিংবা রাজকুমারী। কিন্তু যে পোট্রেটটির সামনে আমরা দাঁড়ালাম তাকে অতি সাধারণ নারী বলে অনুমান হয়। একে রাজকুমারী ভাবার কোন অবকাশ নেই। ব্যর্থ হয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এলাম। কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম মেয়েটির পরিচয়। কিন্তু শুরুতেই এতো অনুসন্ধিৎসা দৃষ্টিকটু বলে মনে হলো। যখন ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছি তখন সুদি বললো ঐ মেয়েটির আরো। বেশ ক’টি ছবি আছে আশেপাশে। অনি বললো, মেয়েটি নিশ্চয়ই এই দ্বীপের কোন নামকরা হিরোইন অথবা মডেল। তাই তার ছবি সব জায়গায় ডিসপ্লে করা হয়েছে। তবে আমার মনে খটকা লেগেই থাকলো। কারণ মেয়েটির বেশভূষা মোটেই মডেল কিংবা নায়িকাদের মতো নয়। তবে ইচ্ছা থাকলো পরে এই নারীর রহস্যটি উদঘাটন করতে হবে। ট্যাক্সিতে উঠলাম আমরা চারজন। হোটেল বুকিং করা আছে আগে থেকেই। আমরা যখনই বিদেশে ভ্রমণ করি, তখন সব সময়ই আমাদের ভ্রমণ সঙ্গী মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন। যেখানেই আমাদের ডেসটিনেশন হোক না কেন আমাদের যাওয়া আসা সব সময় কুয়ালালামপুর দিয়ে। মাত্র দুদিন আগেই আমরা কুয়ালালামপুর এসে পৌঁছেছি সিডনি থেকে। কেএল’এ এক রাত থেকে আজ এসেছি লাংকাউইতে। সিডনিতে ডাক্তারি কনফারেন্স থাকলেও লাংকাউইতে এসেছি নিছক ভ্রমণে। আমাদের মালয়েশিয়া ভ্রমণের ইটিনারারি ঠিক করে দিয়েছেন মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনের ঢাকা অফিসের বিপ্লব চক্রবর্তী। প্রতিবারই কম ভাড়ায় বিমান টিকেট এবং কম দামে ফাইভ স্টার হোটেলে থাকার ব্যবস্থা বিপ্লব দা’ই করেন। লাভ শুধু এটুকুই না, বিপ্লব দার বদন্যতায় ইকোনোমি ক্লাসের টিকিট কেটে আমরা বিজনেস ক্লাসেও ভ্রমণ করেছি দু একবার। বিজনেস ক্লাসে সিটখালি থাকলেই আমাদের টিকিটটা আপগ্রেডেড হয়ে যায় অবলীলায়। এতো সুযোগ দেয়ায় আমরাও অন্য এয়ারলাইনের দিকে ঝুঁকি না। এবারও ঠিক একইভাবে ভ্রমণে বের হয়েছি। লাংকাউই হোটেল বুকিং-এর ভাউচার আমাদের সাথে। 

 

কোনদিন এতো নির্জন দ্বীপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। এদেশটা যদি মালয়েশিয়া না হতো তবে হয়তো ভয়ই লাগতো। কারণ মালয়েশিয়ার প্রায় সব ট্যুরিস্ট স্পটই আমাদের দেখা। এশিয়ান কিংবা ওয়েষ্টার্ন সব কিছুই আছে এ দেশটিতে। কিন্তু তার সাথে আছে নিèিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তাই সারা দুনিয়ার ট্যুরিস্টরা নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায় মালয়েশিয়ার প্রত্যন্ত এলাকায়। কোন ট্যুরিস্ট স্পটে যদি নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর না হয় তবে সে দেশে কোন ট্যুরিস্ট যাবে না কখনো। সেই দিক থেকে মালয়েশিয়ার সাফল্য একশতে একশ। ট্যাক্সিতে উঠেই ড্রাইভারকে বললাম, হলিডে ভিলা বীচ রিসোর্টে যেতে কতোক্ষণ লাগবে। ড্রাইভার জানালো পৌনে এক ঘন্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে যাবো হোটেলে। হোটেলের নামই বীচ রিসোর্ট। অর্থাৎ বুঝতেই পারলাম সমুদ্রের পাড় ঘেঁষেই হবে আমাদের লাংকাউইর নিবাস। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই বুঝলাম, এটি জনশূন্য একটি প্রত্যন্ত দ্বীপ, যাকে সমগ্র চরাচর থেকে বিচ্ছিন্ন বলেই বিভ্রম হয়। হয় পাহাড় না হয়তো সাগরের পাশ ঘেঁষে আমাদের গাড়ি শাঁ শাঁ করে এগিয়ে যাচ্ছে হলিডে-ইন ভিলার দিকে। আশপাশে সমুদ্র সৈকতের ছড়াছড়ি। গোয়া কিংবা আমেরিকার মাওয়ি দ্বীপের সাথে লাংকাউই’র মিল রয়েছে অনেকাংশে। দূর থেকে দেখে মনে হলো মাওয়ি’র বিশ্ববিখ্যাত পাপালুয়া, কাপালনি, কাহানা কিংবা কাপালুয়া বীচের চাইতে লাংকাউই’র সৈকতগুলো কোন অংশে কম সুন্দর নয়। প্রায় দেড় যুগ আগে মাওয়ি’র কাপালুয়া বীচের পাড়ে এক রিসোর্টে আমি থেকে এসেছি এক সপ্তাহ। পাহাড়ের ওপরের হোটেল কিংবা সৈকত লাগোয়া রিসোর্টে রাত্রি যাপনের অভিজ্ঞতা সবসময়ই রোমাঞ্চকর। 

 

কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট্ট একটা শহরের উপস্থিতি টের পেলাম। বলা যায় একদম বিরান ভূমি থেকে জনারণ্যে প্রবেশ করলাম। সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে চলতেই হঠাৎ চোখে পড়লো একটি বিশাল রিসোর্ট। চোখ ফেরাতেই দেখলাম গেটে লেখা হলিডে ভিলা বীচ রিসোর্ট ও স্পা। বুঝতে পারলাম হোটেলে পৌঁছে গেছি। গাড়ি থেকে নেমেই বুঝলাম এ হোটেলের আদব-কায়দা ট্র্যাডিশনাল। অর্থাৎ অন্য পাঁচ তারকা হোটেলের সাথে এর কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। বুঝা গেল, এ দ্বীপের ঐতিহ্যগত ভাবধারায় গড়ে তোলা হয়েছে এই রিসোর্টটিকে। হোটেল রিসেপশনে এসে আমাদের ভাউচারটি দিলাম। প্রত্যেক হোটেল কাউন্টারে যেয়ে আমি সচরাচর যে কথাটি সব সময় রিসেপশনিষ্টকে বলি সেই কথাটি এখানেও বললাম। অর্থাৎ আমি অভ্যর্থনাকারিনীকে অনুরোধ করলাম যাতে সে যতোটা সম্ভব উঁচু ফ্লোরে আমাদের রুমটির বরাদ্দ দেয়। কারণ কুড়ি তলা কিংবা পঁচিশ তলা হোটেলের জানালা দিয়ে রাতের অচেনা শহরগুলোকে স্বপ্নের মত লাগে। গতকাল রাতেই থেকে এসেছি কুয়ালালামপুরের জালান ইসমাইল রোডের রেনেসাঁ হোটেলের তেইশতম ফ্লোরের একটি ডিলাক্স রুমে। রেনেসাঁ হোটেলের জানালা দিয়ে চাইলে মনে হয় হয়তো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে টুইন টাওয়ার। তারকা হোটেলের উঁচু তলায় থাকার ব্যাঞ্জনাই আলাদা। তাই লাংকাউই এসেও উঁচু ফ্লোরে থাকার বায়না ধরলাম রিসেপশনিষ্টের কাছে। আমাদের যাঞ্চা শুনে অভ্যর্থনাকারিনীকে একটু অবাক হতে দেখলাম। সহাস্যে পুতুলের মতো চায়নীজ মেয়েটি বললো, আমাদের হোটেলে তো হাইরাইজ ফ্লোর নেই। আমাদের হোটেলটিই তো মাত্র দোতলা। অর্থাৎ হাইরাইজ বলতে সেকেন্ড ফ্লোর। মনে মনে লজ্জা পেলাম এই ভেবে, যে হোটেলে এসেছি সেই হোটেল সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। যদি নিজে কখনো ইন্টারনেটে হোটেল বুক করি তবে তখন হোটেলের রুম সংখ্যা, হোটেলটি কতো তলা কিংবা ব্রেকফাস্ট ফ্রি কিনা এসব বিষয়-আশয়গুলো ভালো মতো দেখে নেই। কিন্তু এবারের ভ্রমণে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। আমাদের হোটেল বুকিং, সাইট সিটিং সবকিছু ঠিক করে দিয়েছেন বিপ্লব দা মালয়েশিয়ান এয়ার লাইনের প্যাকেজের ভেতর। তাই হোটেল সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার দরকার হয়নি। মেয়েটি আমাকে হেসে জানালো, উঁচু তলাতে থাকতে পারবো না কিন্তু ঘর থেকে হাত বাড়ালেই সমুদ্রের জল ছুঁতে পারবো। হোটেলের লবিটি এমন ঢং-এ বানানো যে, সেখানে দাঁড়িয়ে কারু পক্ষেই বুঝা সম্ভব নয় হোটেলটি কতো বড় এবং এটি কতো তলা হোটেল। হলিডে ভিলার রুম খুলেই আমার বৌ চন্দনার মুখে চাঁদের হাসি। এমন দৃশ্য কোথায় গেলে আর দেখা যাবে? ঠিক যেন রুমের দোরগোড়ায় সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। লবিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ফোঁপানি শোনা যায়নি। কিন্তু এখন তা স্পষ্ট। 

 

পানটাই তেনঘা সী বীচের ওপর চৌদ্দ একর জমির উপর গড়ে উঠেছে এই হোটেল। হোটেলটি গড়ে তোলা হয়েছে গ্রামের আদলে। লাংকাউই দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে এটি একটি পশ রিসোর্ট। তিনশ আধুনিক রুমের এক বিশাল সমাহার এই রিসোর্টে। আমাদের রুমের ঠিক সামনেই বিশাল সুইমিংপুল, আর তার পাশ ঘিরে তিনটি লন টেনিস কোর্ট। জামা কাপড় পাল্টে বেরিয়ে গেলাম হোটেল পর্যবেক্ষণে। অনি-সুদি দুজনেই চাইছিল সুইমিংপুলে নামতে। কিন্তু চন্দনার আপত্তিতে তা হলো না। তখন চারদিকে আঁধার নামছে গুঁড়ি গুঁড়ি। সন্ধ্যায় সাঁতরালে যদি ঠান্ডা লাগে, সেই ভয়ে কাউকেই সুইমিংপুলে যেতে দেয়া হলো না। লবিতে নেমে হোটেলের চারপাশ ভাল মতো পর্যবেক্ষণ করলাম বেশ কিছুক্ষণ। বুঝতে পারলাম লাংকাউই শহর থেকে এই রিসোর্টটি প্রায় বিচ্ছিন্ন। আশপাশে কোন লোকালয় চোখে পড়লো না। হোটেলের সামনে জঙ্গলের ভেতর দু’ একটা ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট আছে ট্যুরিস্টদের জন্য। সাহেবরা অনেক সময়ই ফাইভ ষ্টার হোটেলে বসে খেতে পছন্দ করে না। তাই রুচি পাল্টাতে আসে এসব ঘুপচি ঘরে। সুইমিংপুলের পাশ ঘেঁষে চলে এলাম সী বীচে। সী বীচে তখনও অতি উৎসাহী সাহেব মেমরা স্নানে ব্যস্ত। সী বীচের চারপাশে তখন বীয়ার আর স্যাম্পেনের ফোয়ারা। হোটেলের ট্রপিক্যাল বীচ বার তখন পরিপূর্ণ। এ দৃশ্য দেখলে কে বলবে মালয়েশিয়া মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ। আপনার মনে হবে এটি হাওয়াই দ্বীপের ওয়াইকিকি বীচ। 

 

সন্ধ্যা গড়ালো। অনি তাড়া দিচ্ছিল ডিনারের জন্য। কোথায় ডিনার খাবো তা নিয়ে বিভ্রান্তি। সুদি বললো চলো ট্যাক্সি ভাড়া করে শহরের ভেতর যাই। চন্দনা সায় দিলো না। এ হোটেল থেকে মূল শহরের দূরত্ব কতোটুকু, তা আমাদের ধাতে নেই। বিদেশ বিভূই। কাউকে এখানে জানি না – চিনিও না। তাই রাতে আর বেরুলাম না। ডিনার করবো এ হোটেলেই। কোথায় ডিনার সারবো। তাতেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব। লাগেন্ডা রেস্টুরেন্ট, মারিও ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট, সানসেট টেরেসে তখন মহাধূমধামে ডিনার চলছে। ইতালিয়ান খাবার আমাদের পছন্দ নয়। খোদ রোমে যেয়েও আমরা পিজা-পাস্তা খেতে চাইনি। অনির মহাপছন্দ পিজা। ও আমাদের জোর করেই ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টের দিকে নিয়ে যেতে চাইলো। আমরা সায় দিলাম না। বিদেশে গেলেই আমরা বাফেট ডিনার কিংবা লাঞ্চ খুঁজি। কারণ এতে খাবার সিলেকশনের স্বাধীনতা থাকে। হোটেলের একজন কর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম এই হোটেলে কিংবা আশপাশে বুফে ডিনারের ব্যবস্থা আছে কিনা? সে বললো মিড নাইট পর্যন্ত লাগেন্ডা রেস্টুরেন্টে বারবিকিউ ডিনার চলবে। বারবিকিউ ডিনার মানে আগুনে ঝলসানো মাংস কিংবা মাছের ডিনার। ঢুকে গেলাম লাগেন্ডাতে। খাসী, গরু, সামুদ্রিক মাছ কিংবা গলদা চিংড়ির বারবিকিউ। তবে ওটি পারফেক্ট বারবিকিউ ডিনার ছিল না। ঝলসানো খাবারের সাথে ছিল শতেক রকমের এশিয়ান, আমেরিকান কিংবা জাপানী খাবার দাবার। মাথাপিছু মাত্র বিশ ডলারে অমন ডিনার ইউরোপ আমেরিকাতে কেন সিঙ্গাপুরেও চিন্তা করা যায় না। বড় বড় গলদা চিংড়ি, কুককে বলা সাথে সাথে হয়ে যায় ফ্রাই। যতো খুশী খাও। কেউ বাধা দিবে না। যতো খুশী খাও আর যতোক্ষণ খুশী ততোক্ষণ খাও এদুটোই বুফে ডিনারের বাড়তি চার্ম। খেতে খেতে হঠাৎ করেই অনি বললো বাবা দ্যাখো, ঐ মেয়েটির ছবি এই হোটেলেও আছে। চেয়ে দেখি সত্যিই তাই। এই একই নারীর পোট্রেট আমরা এয়ারপোর্টে ও বিভিন্ন জায়গায় দেখে এসেছি। কিন্তু কোথাও এই নারীর পরিচয় লেখা নেই। এখানেও নেই। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েই দেখলাম শুধু এক জায়গায় নয় বিভিন্ন জায়গায় এই রমণীর পোট্রেট শোভা পাচ্ছে। অনুসন্ধিৎসাটা আর চেপে রাখতে পারলাম না। রিসেপশনিষ্ট মেয়েটির কাছে এসে ঐ নারীর পোট্রেটটির দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলাম তার পরিচয়। চাইনীজ মেয়েটি আমার প্রশ্নটি শুনে বোধহয় বেশ অবাকই হলো। এমনিতেই ফকফকা সুন্দরী মংগল মেমদের মুখ দেখতে অনেকটা পুতুলের মতো। আর এখন আমার প্রশ্ন শুনে ঐ মেমটির মুখ যেন পুরোপুরি বার্বিডল হয়ে গেল। চোখে কোন নড়ন-চড়ন নেই। একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকলো আমার মুখের দিকে। বুঝতে পারলাম তৈলচিত্রের ঐ নারী মূর্তিটি সম্পর্কে না জেনে এই দ্বীপে আসা আমার উচিত হয়নি। বাকিংহাম প্যালেসের সামনে দাঁড়িয়ে কোন পর্যটক যদি রাণীমাতার পোট্রেটের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে কোন বৃটিশ মেমের কাছে জানতে চায় ঐ ছবিটি কার তবে ঐ মেম সাহেবের মুখের আদল বিস্ময়ে যেমন বদলে যাবে ঠিক তেমনি অবস্থা তখন চাইনীজ মেয়েটির। সে সোজা সাপটা আমার প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না। ড্রয়ার থেকে একটা বই বের করে তা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। শুধু আলতো করে বললো লাংকাউই দ্বীপ মানেই ঐ নারী। বাকীটা বই থেকে পড়ে নিতে। বইটা হাতে নিলাম। ডিসকভারি সিরিজের বই। প্রচ্ছদে লেখা লাংকাউই – আইল্যান্ড অব লিজেন্ড। অর্থাৎ অলৌকিক কাহিনীর দ্বীপ লাংকাউই। চন্দনা, সুদি আর অনির চোখে তখন অনেক ঘুম। গত দুদিনে টায়ারিং জার্নি করেছি আমরা চারজন। মেলবোর্ণ থেকে সিডনি, সিডনি থেকে কুয়ালালামপুর তারপর এক রাত না পেরুতেই লাংকাউই। ওরা চলে গেল ঘরে। আমার তখনও ঘুম বা ক্লান্তি আসেনি। নতুন কোন কিছু জানার থাকলে আমার চোখে কখনো ঘুম আসে না। 

 

একা একা চলে গেলাম সী সাইড বারে। তখনো জোড়ায় জোড়ায় বিদেশীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের পাড়ে। সাগরের পাড় ঘেঁষে ওপেন স্টেইজ বানানো ডিনার ডান্সের জন্য। প্রতি শনিবার সারারাত এখানে কনসার্ট হয় আর তার সাথে ডিনার আর ডিসকো। হোটেলের পেছনে এক জায়গায় একটা সাইনবোর্ড দেখলাম। তাতে লেখা আছে খবঃ ঁং সধহলধ ুড়ঁ. মাঞ্জা কথাটা বাংলা না ইংরেজি তা বুঝতে পারলাম না। ছোটবেলায় যারা ঘুড়ি উড়িয়ে অভ্যস্ত তারা সবাই মাঞ্জা কথাটার সাথে পরিচিত। সুতাকে ধারালো করার জন্য বার্লি আর কাঁচের গুঁড়া দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর সূতাতে মাঞ্জা দেয়া হয়। বার কয় চোখ কচলে ভাল করে তাকিয়ে দেখি ঐ সাইনবোর্ডটির পাশেই গুপ্তঘরের মতো একটি দরজা। নীল আলোর দরজা, স্পষ্টতই বুঝা গেল এটা হোটেলের মাসাজ পার্লার। চীনা, মালয়ি, ইতালি ও বাহারি মেয়ের সমাবেশ আছে এখানে। লেখা আছে মাসাজ করার ফি আশি রিংগিত। কিন্তু আমি জানি আশি রিংগিতই শেষ কথা নয়। মাসাজ রুমে একবার কোন পর্যটককে ঢুকাতে পারলেই কম্ম ফতে। একেক কাজের জন্য একেক রকমের চার্জ। মালয়েশিয়ান মেয়েরা এ কাজে মহা পটু। কি করে সাহেবদের কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আহোরণ করতে হয় তা তারা জানে। শুধু জানে বললে ভুল হবে, খুব ভালো জানে। পেনাং শহরের মাসাজ পার্লারগুলো একবার ঘুরে দেখলেই বুঝা যাবে এরা সিঙ্গাপুর তো কোন ছাড়, কোন কোন ক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের পাটায়া পুখেতকেও হার মানিয়ে দিবে। মাসাজ পার্লারের কাণ্ড কাহিনী সবই আমি জানি। তবে মানুষকেও যে মাঞ্জা দেয়া যায় তা আজ রাতেই

প্রথম জানলাম। 


Tanvir Arafat

93 Blog posts

Comments