পরী আজকাল রাতে ওর একার রুমে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারে না, শুধু মনে হয় কেউ যেন সবসময়ই ওর ঘরের মধ্যে বিচরণ করছে, কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ পাই রাতে ঘুমানোর সময়, সেই সময় ঘরের লাইট অন্ করলে কাউকে দেখতে পাই না শুধু অনুভব করা যায়। এতে খুব ভয় করে ওর কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারে না। ..
না না এ কোনো রূপকথার গল্পের পরী নয়, আবার কোন আঠেরো বছরের যুবতীও নয়। এ হল একটা বছর পাঁচকের ছোট্ট দুষ্টুমিষ্টি মেয়ে পরিনীতা রায়চৌধুরী। বাড়ির সবাই ওকে পরী নামেই ডাকে। শুধু যে নাম পরী তা নয়, ওই বছর পাঁচেকের ছোট্ট মেয়ে রূপ সৌন্দর্যে অতুলনীয়, কোন রূপকথার গল্পের পরীর থেকে কম নয়। যেন মনে হয় কোনো স্বর্গের অপ্সরী জন্ম নিয়েছে। উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রঙ, টিকালো নাক, টানা টানা বড়ো বড়ো চোখ আর মুখে সুন্দর মায়াবী মিষ্টি হাসি। একটু হাসলেই যেন খুব আদর কর
কিন্তু পরিনীতার ঠাকুমা মৃনালিনী দেবী, পরিনীতার জন্মানোর পর ওকে দেখে একটুও খুশি হননি। কারণতাঁর একমাত্র ছেলে-বৌমা, পবন আর নীলিমার প্রথম সন্তান মেয়ে হয়েছে বলে, তিনি একটা নাতি পাওয়ার আশা করেছিলেন। কিন্তু যায় ই হোক অন্যদিকে মৃনালিনী দেবীর মনে একটু খটকা লেগেছিল, পরিনীতার জন্মের পর ওকে দেখে। তিনি ভেবেছিলেন এতো ফর্সা সুন্দরী মেয়ে ওদের বাড়িতে কীভাবে জন্মানো সম্ভব? কারণ ওনাদের বাড়ির প্রত্যেকের গায়ের রঙ এমনকি পরিনীতার বাবা পবনেরও গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ আর মা নীলিমা ফর্সা হলেও এতোটা ফর্সা নয়। কিন্ততার ভাবনাই ছেদ্ পড়ে, নবজাতক শিশু পরিনীতাকে দেখতে আসা কিছু প্রতিবেশীর কথায়তারা এতো সুন্দরী বাচ্চা পরিনীতার প্রশংসা করেন। এইসব দেখে মৃনালিনী দেবীর মন গলে যায় নাতনীর প্রতি। তিনি ধীরে ধীরে পরীকে ভালোবাসতে শুরু করেন। এবং তিনিই তাঁর ছেলে-বৌমার নাম মিলিয়ে অপ্সরী নাতনীর নাম রাখেন "পরিনীতা"। এই ছোট্টো পরী ধীরে ধীরে বাড়ীর সবার প্রাণ হয়ে ওঠে। পরীর জন্মের পর থেকেই রায়চৌধুরী বাড়ি আর্থিক দিক দিয়ে বিরাট উন্নতিকরতে থাকে, পবনের চাকরিতে প্রমোশন হয়। এই জন্য পরীর প্রতি ওর বাবার ভালোবাসা আর বেড়ে যায়, পবন সবসময়ই পরীকে "আমার পরীরানী" বলেই ডাকত। মা-বাবা, ঠাকুমা এবং বাড়ির অন্য সকলের আদরে পরীর শিশু জীবন আনন্দেই কাটতে থাকে। .........এমনি করেই পরী যখন তিন বছরের তখন ওর ভাই ঋতমের জন্ম হয় আর ওর খুশিময় জীবনে ছেদ্ পরে। ঋতমের জন্মের পর থেকেই আদরের পরী সবার এমনকি ওর মা-বাবারও চক্ষুশূল হয়ে উঠতে থাকে দিসবার মুখে শুধু ঋতম আর ঋতম। ওই তিন বছরের ছোট্ট মেয়ে পরিনীতার ওপর কোনো নজরই নেই কারুর। অযত্নে পরীর সুন্দরতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল আর ও ক্রমেই শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সবাই দেখেও না দেখার ভান করত পরীকে। শুধু টাইমটা মেনেই খাবারটা খাইয়ে দেয় পরিনীতাকে আর সবসময়ই পরিনীতা উদ্দেশ্য করে বলে, " কেন যে এই মেয়েটা জন্মেছিল কে জানে? ? ফেলে দিতেও পারি নাযে মেয়েটা একদিন মা-বাবার মাঝখানে ঘুমাতো সেই মেয়েটাই তিন বছর বয়স থেকে পাশের ঘরে একা ঘুমাই। প্রথম প্রথম একা ঘুম আসতো না পরীর, ভয় পেয়ে ছুটে যেত মা-বাবার কাছে। আর ওই সময়ে ওর মা-বাবা ঋতমের কথা ভেবে একপ্রকার বিরক্ত হয়ে পরীকে ওর ঘরে জোর করে দিয়ে এসে, ওর ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে আসতো যাতে পরী যেন বাইরে আসতে না পারে.....একসময়ে ছোট্ট পরী ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েএই ভাবেই কেটে গেছে দুটো বছর। এখন আর পরী একা ঘরে শুতে কাঁদে না। এই পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটা যেন এই দু-বছরেই মানসিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়ে গেছে। এখন সে অনেক কিছুই বুঝতে পেরেছে। এখন পরী আর ওর মা-বাবার কাছে যাওয়ার জন্য কাঁদে না। কিন্ত ওর খুব কষ্ট হয়, যখন দেখে বাবা ওর ভাই ঋতমের জন্য নতুন খেলনা এনে দিচ্ছে, আর মা ঋতমকে আদর করে খাইয়ে দিচ্ছে। আর ঠাকুমা ঋতমকে কত সুন্দর সুন্দর গল্প বল আবার যখন খুব ঝড়বৃষ্টি হয়, বিদ্যুতের চমকানি আর বাজের শব্দে ভয়ে মাকে এখনও জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে পরীর কিন্তু কি আর করবে মাতো তাকে আর ভালোবাসে না। এই ভেবে ভয়ে পাশবালিশটাকে আঁকড়ে ধরে কিন্তু আবার পরী এটা দেখেও আশ্চর্য হয়ে যায় যে, বাড়িতে যখন কোন আত্মীয় বা প্রতিবেশী আসে তখন মা-বাবা আর ঠাকুমা ওকে এতো ভালোবাসে যেন মনে হয় পরী ছাড়া বাড়ির কেউই বাঁচবে না। আর যখনই আত্মীয়রা বাড়ি থেকে চলে যায়, আবার তখন থেকেই পরী মানে পরিনীতার পুরোনো জীবনপরী প্রতিদিন রাতে শুয়ে শুয়ে কাঁদে আর বলে, " আমার মা আর ভাই -এর মা যদি আলাদা হতো তাহলে আমার মা আমাকে খুবই আদর করত। আর বাবা আমার জন্য অনেক খেলনা এনে দিত, আর ঠাকুমাও অনেক গল্প শোনাত। " এই সব ভাবতে ভাবতে ছোট্ট পরিনীতা একসময়ে ঘুমিয়ে পড়তো। এই ভাবেই চলছিল ওর জীবএরমধ্যে একদিন পরী শুয়েছিল ওর বিছানায়, তখন রাত 2.00 am. কিন্তু ওর একদম ঘুম আসছিল না। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। হঠাৎই পরীর মনে হল কেউ ওর ঘরের দরজাটা খুলে ঘরের মধ্যে এল। ও ভাবল ওর মা, তাই ও উঠে ডাকল, "মা....!"কিন্তু কোন উত্তর পেল না। ওর একটু ভয় লাগল। সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের লাইটটা অন্ করে দেখল ঘরের মধ্যে কেউ নেই, ঘরের দরজাটা বন্ধই আছে। ভয়ে গা টা ছমছম করে উঠল পরকিন্তু কাউকে কিছু বলার নেই, বলতে গেলেই তো কেউ না কেউ বলবে ও নাটক করছে, আর বলেই ওকে নিয়ে এসে ঘরে আটকে রেখে যাবেতাই কি আর করবে, লাইটটা অফ্ করে চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ল। এখন প্রায় রাতেই ওই একই ঘটনা ঘটছে আর এখন আর পরীর আগের মতো ভয় লাগে না। ও অনুভব করতে পারে ঘরে কেউ একটা বিচরণ করছে। রাতে বছর পাঁচকের পরীর ঘুমই আসে না। শুধু অপেক্ষা করে থাকে, যে ওর ঘরে অদৃশ্য হয়ে বিচরণ করছে, তাকে একবার চোখে দেখার জন্য। .........এমনি করে রাতে জেগে অপেক্ষা করতে করতে এক মাস পার হয়ে যায়, কিন্তু ঘরের মধ্যে অদৃশ্য বিচরণকারীর দেখা পাই না পরী। কিন্তু শুধু অনুভব করতে পারে কেউ একজন আছে এই ঘরেহঠাৎই একদিন সন্ধ্যাবেলা পরী ওর ঘরে ঢুকতে গিয়ে ভয় পেয়ে, চিৎকার করে ওর মা-বাবার ঘরে ছুটে যায়, মা কে সব কিছু বলার জন্য। নীলিমাও ঘরেই ছিল, পরীর এতো জোরে চিৎকার ওর মা নীলিমা একটু ভয় পেয়ে গেল এবং পরীকে জিজ্ঞাসা করল, " কী রে পরী? ? ? কি হল তোর? এতো চ্যাচাচ্ছিস পরীর ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে, ওর মুখে কথাও বের হচ্ছে না। তাও পরী বলতে চেষ্টা করল, " মা... আমার ঘরে..........." পরীর কথার মধ্যেই মায়ের পাশে শুয়ে থাকা ঋতম কাঁদতে শুরু করল। আর ঋতমের কান্না শুনতে পেয়ে বাইরে থেকে পরীর বাবা পবনে দৌড়ে ঘরে ঢুকল আর ঘরে পরীকে দেখে তার মাথায় আগুন জ্বলে গেল। এবং চিৎকার করে বলল, " এই শয়তান মেয়েটা এখানে কি করছে? এর জন্য আমার ছেলেটা কাঁদতে লাগল... এই মেয়েটাই আমার ছেলেটাকে একটু সুস্থ থাকতে দেবে না.....! তোকে এই ঘরে কে ঢুকতে বলেছে পরী? ? ? ....তোকে বলেছি না, তুই তোর ঘর থেকে বাইরে বেরবি না। আর খবরদার যদি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এই ঘরে আর কখনোও ঢুকেছিস! তাহলে তোকে আমি মেরকথাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে পবন, ওই পাঁচ বছরের ছোট্ট পরীকে অতিরিক্ত মারতে শুরু করল এবং ওকে জোর করে এক প্রকার মাটিতে ঘষতে ঘষতে এই ঘর থেকে বের করে পরীর ঘরের দিকে নিয়ে যেতে থাকল। ................আর পরী চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, " বাবা....! আমকে ছেড়ে দাও.....আমাকে মেরো না.....আমি আর ওই ঘরে যাব না....আমকে আর আমার ঘরে আটকে রেখে দিও না বাবা .....আমার ভয় লাগে........মা।। ....."
কিন্তু এই পরী এই করুন অবস্থা দেখে নীলিমার মনে একটু কষ্টও হল না। নীলিমা একটা কথাও বলল না এইসব দেখে। শুধু ঋতমকে আদর করে ঘুম পাড়াতে শুরু করল। আর পরীর অবস্থা দেখে মৃনালিনী দেবী মনে মনে হাসলেন আর বারবার বলতে থাকলেন, " ঠিক হয়েছে। বদমাশ মেয়ে! তোর এই রকমই হওয়া উচিতপবন, ছোট্ট পরিনীতা কে ঘরে নিয়ে গিয়ে, বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এল। বাইরে এসে পবন একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে, নিজের ঘরে চলে গেল। বন্ধী হয়ে পরী কাঁদতে কাঁদতে দেখল, ঘরে কেউ নেই। এই দেখে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল এবং বাবার মারের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে কাঁদতেথাকল। রাতের খাবারটাও আজ তাকে কেউ দেয়নি। এটাই নাকি ওর মা-বাবার ঘরে যাওয়ার শাস্তি। ক্ষিদের-তেষ্টায় কাতর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল এই বছর পাঁচেকের ছোট্ট পরিনীতা।
হঠাৎই মাথায় একটা ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে পরীর ঘুম ভেঙে গেল, তখন ঘড়িতে রাত 2 টো। পরী জেগে উঠে যা দেখল, তাতে ও ভয়ে চিৎকারও করতে পারল না.....অনেক কষ্টে জিজ্ঞাসা করল, " তুমি কে.....? ? ..
পরীর কথার উত্তরে সে কিছুই বলল না, আবার পরী কিছুটা ঢোক গিলে, জিজ্ঞাসা করল, "তুমি কে? ? ....."এবার সে উত্তর দিল, "আমি নীহারিকা। তোর মা....। কথাটা শুনে পরিনীতা চমকে উঠল এবং তাড়াতাড়ি ঘরের লাইটটা অন্ করে যা দেখল, তাতে পরীর চোখ যেন ঝলসে গেল,, বড়ো বড়ো চোখ করে সেদিকে তাকিয়ে রইল। দেখল একটা অপরূপ সুন্দরী মেয়ে ওর বিছানায় বসে আছে। ঠিক যেন ছবির বইয়ে দেখা রাজকুমারীর মতো। রাজকুমারীদের মতো সাজশয্যা, গোটা শরীর স্বর্ণ অলংকৃত। এবং তার শরীর থেকে নানা রঙের আলোক বর্ণালী বেরিয়ে এসে পরীর ঘরটাকে আলোকিত করে দিয়েছে। ...পরীর এই রকম অবস্থা দেখে নীহারিকা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো এবং বলল, " আমিই তোর মা, আমার কাছে আই.....। " কিন্তু পরী চুপ করে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। এই দেখে নীহারিকা ওর কাছে গিয়ে আদর করে কোলে তুলে নিল। এবং বলল, " ওরা তোকে খেতে দেয়নি তাই না? তোর ক্ষিদে পেয়েছে? ? ...." এতো দিন পর পরীকে কেউ মাতৃস্নেহে কোলে তুলে নিল আর এতে পরী মনে মনে অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করতে এবার পরী মুখ খুলল এবং বলল, " আমাকে ওরা খুব মেরেছে.....কিছু খেতেও দেয়নি....আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে....."তুই কি খাবি বল আমাকে, আমি তাই ই এনে দেব......" নীহারিকা বলল।
"তুমি যা ই দেবে আমি তাই ই লক্ষ্মীসোনার মতো খেয়ে নেব..." পরী করুন স্বরে বলল। কথাগুলো শুনে নীহারিকার চোখে জল এসে গেল এবং নীজের শক্তির প্রয়োগ করে অনেক খাবার দিয়ে পরিনীতার ঘর পরিপূর্ণ করে দিল। এইসব দেখে পরীর অবাক হয়ে গেল। এবং পরী একদৃষ্টে চেয়ে রইল ওই খাবারগুলোর দিয়ে। এই দেখে নীহারিকা একটু হাসল, এবং তার নিজের হাতে, যত্ন সহকারে পরীকে খাবার গুলো খাওয়াতে শুরু করল। আর আবার এতো দিন পর পরিনীতা মায়ের আদরের স্পর্শ অনুভব করতে লাগল। খাওয়া শেষ হলে, নীহারিকা পরীকে বলল, " তোর যা দরকার তুই আমাকে বলবি। আমিই তোকে সব কিছু এনে দেব। ওদের কারুর কাছে আর কিছুই চাইবি না। "....
পরী বলল, " আচ্ছা। ....কিন্তু তুমি কে হও আমার? আমি তোমাকে কি বলে ডাকব? ? "...
নীহারিকা হেসে বলল, " আরে বললাম না....!আমি তোর মা হই পরী, তুই আমাকে মা বলেই ডাকবি। ".....
" তুমি কি করে আমার মা হবে? ওই ঘরে শুয়ে আছে, নীলিমা রায়চৌধুরী। ও ই তো আমার মা। ..."পরীর কথা শুনে নীহারিকা বলল, " আমি জানি নীলিমা তোকে জন্ম দিয়েছে কিন্তু আমিই তোর আসল মা।। তুই যেদিন বড়ো হবি, সব বুঝতে শিখবি সেদিন তোকে সব বলব। আর একটা কথা তুই কোন দিনই আমার কথা কাউকে বলবি না। ".
পরী বলল, " আচ্ছা ঠিকাছে, তুমি আমার মা। আর আমি তোমার কথা কাউকে বলব না। "
নীহারিকা পরীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। আর পরীও নীহারিকার মাতৃস্নেহে ঘুমিয়ে পড়ল। ..................এর পর থেকে পরিনীতার জীবনে মায়ের অভাব পূরণ হতে লাগল অশরীরী মা নীহারিকার মাতৃস্নেহে। পরী আর তার মা-বাবার কাছে যাওয়ার জন্য জেদ্ করে না। সব সময়ই নিজের ঘরেই থাকে। শুধু খাবার সময় খাবার খেতে ঘরের বাইরে বের হয় আর খাওয়া শেষ হলে ঘরের মধ্যে চলে আসে। নীহারিকাও পরীকে খুব ভালোবাসে। স্নান করিয়ে দেয়, চুল আঁচড়ে দেয়, পরী যখন যা চাই তাই ই এনে দেয়। ..........পরীও নীহারিকার কথা কাউকে জানালোঅন্যদিকে পরীর পরিবারের লোকজন পরীর এই রকম ব্যাবহারে একটু অবাক হলেও খুশি ছিল। কারন পরী আর তাদের জ্বালাতন করত না। তাদের ঘরেও আসত না। .....
একদিন পবন তার মা মৃনালিনী দেবীর সাথে কথা বললেন পরীকে স্কুলে ভর্তি করার ব্যাপারে। কিন্তু কারুরই এই ব্যাপারে কোনো মত ছিল না। কিন্ত বাইরে লোকের সামনে তারা পরিনীতাকে খুব ভালোবাসত, তাই মেয়েকে স্কুলে ভর্তি না করলে বাইরের লোক কি বলবে এই ভেবে একপ্রকার বাধ্য হয়েই পবন পরীকে স্কুলে ভর্তি করল। শুরু হল পরিনীতার স্কুল জীবন। .......পরী আস্তে আস্তে বড়ো হতে লাগল। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে পরী পড়াশুনায় ভাল হতে লাগল। স্কুলেও ফাস্ট গার্ল নামে পরিচিত হয়ে গেল পরিনীতা রায়চৌধুরী। কিন্তু এতে পরীর বাড়ির লোকজন একটুও খুশি হল না। কারণ পরীর ভাই ঋতম একদমই পড়াশুনায় ভালো ছিল না। তাই বাড়ির লোকজন, ছেলের থেকে মেয়ে পড়াশুনায় ভাল, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারলো নাআবার তারা এটা ভেবেও অবাক ছিল যে, ঋতমকে দশটা টিউশন পড়তে দিয়েও সে পরীক্ষা ফেল করত বছর বছর। আর পরীকে একটাও টিউশন না দিয়েও পরী প্রত্যেক বছর ক্লাসে ফার্স্ট হত। আর এই সব পরীর বাবা পবন ও ঠাকুমা মৃনালিনী দেবীর সহ্য হল না। তারা প্ল্যান করে পরীকে দিয়ে বাড়ির সমস্ত কাজ করানো শুরু করল, যাতে ও পড়াশুনার জন্য একটুও সময় না পাই। কিন্তু পরী খুব কষ্ট হতে শুরু হল। কারণ পরীও খুব ভালো করেই জানত যে তার স্কুলে ভালো রেজাল্ট কোনো ম্যাজিক নয় এটা একমাত্র ওর কঠোর পড়াশুনার ফল। তাই ও জানত বাড়ির কাজ করলে ওর পড়াশুনা শেষ হয়ে যাবে। পরী কাঁদতে শুরু করল, এই সময় নীহারিকা এল এবং পরীকে কান্নার কারণজিজ্ঞাসা করল। পরীও নীহারিকাকে সব কিছু জানাল। সব কথা শুনে আগুনের মতো জ্বলতে লাগল নীহারিকা এবং বলল " ওদের সামনে আমি তুই সেজে কাজ করব আর তুই এই ঘরে পড়া করবি। " পরীও খুব খুশি হল এই কথাগুলো শুনে এবং পরক্ষণেই নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরল। আগুনের মতো জ্বলতে থাকা নীহারিকা এক নিমিষেই জল হয়ে গেল মেয়ের সাথেওদের কথা মতোই কাজ চলতে লাগল। এবং পরীর পড়াশুনার কোন ক্ষতি হল না। এর মধ্যেই পরিনীতা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল এবং একই সঙ্গে ঋতম দিল মাধ্যমিক পরীক্ষা। সবাই জানত পরীতো সারাদিন বাড়ির কাজ করত, পড়াশুনার জন্য সময় পেত না তাই সে উচ্চ মাধ্যমিকে ফেল করবে। কিন্তু ফল হল ঠিক উল্টো। আগে উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হল, পরিনীতা 98% নম্বর পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে পাশ করল। পরী আর ওর অশরীরী মা নীহারিকা খুবই খুশি হল। কিন্ত বাড়ির সবাই পরিনীতার উপর ক্ষেপে গেল। পরীকে জোর করেই নিয়ে গিয়ে ঘরে বন্ধ করে দিল ওর বাবা পবন, ঠিক যেমন বারো বছর আগে এর ঠিক দুই দিন পর মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হল, আর ঋতম সব চেয়ে কম নম্বর পেয়ে ফেল করল। বাড়ির সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আর পবন ঋতমের ফেলের জন্য সতেরো বছরের পরিনীতাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসেঅসম্ভব ভাবে মারতে শুরু করল। আর পরিনীতার অবস্থা করুণ হয়ে উঠল। ও চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। .....ঋতম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগলো ......কেউ আটকানো তো দুরের কথা, মা নীলিমা, ঠাকুমা মৃনালিনী দেবীও পরিনীতাকে পুড়িয়ে মারতে কেরোসিন তেল আর দেশলাই নিয়ে এল। এই সব দেখে নীহারিকা রাগে আগুনের মতো জ্বলতে লাগলো, এবং দেখতে দেখতে বাড়ির সিলিং- এর কাঁচের ঝাড়বাতিটা হঠাৎই মৃনালিনী দেবীর উপর ভেঙে পড়ল। মৃনালিনী দেবীর রক্তের সারা বাড়িতে রক্তের নদী বইতে লাগলো। এই আকস্মিক ঘটনায় সবাই চমকে গেল। পবন আর নীলিমা পরিনীতাকে ফেলে মৃনালিনী দেবীকে ওই অবস্থায় নিয়ে হসপিটাল ছুটল। ঋতম ওদের সাথেই গেল। আর পরিনীতাও হতবাক হয়ে নীহারিকার দিকে তাকিয়ে রইল। নীহারিকা পরিনীতাকে কোলে করে তুলে ওরনীহারিকা, পরিনীতাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে অতিযত্নে মাতৃস্নেহ ওর শুশ্রূষা করতে লাগল। কারন অতিরিক্ত মারের ফলে পরিনীতার অবস্থা করুণ হয়ে উঠেছিল। বার বার পরী যন্ত্রণায় কেঁদে উঠছিল। কিছুক্ষণ পর পরী একটু সুস্থ হল। এবার সে নীহারিকাকে বলল, " তুমি, ঠাকুমার সঙ্গে এরকম কেন করলে মা? ? ...পরীর এই রকম কথাই নীহারিকা চিৎকার করে উঠলো এবং বলল, " ওই শয়তান! মৃনালিনী, তোর ঠাকুমা, তোকে পুড়িয়ে শেষ করতে চেয়েছিল, তাই আমি ওকেই শেষ করে দিলাম। ..ও আমার মেয়েকে কষ্ট দেবে আর আমি ওকে ছেড়ে দেব? তুই ভাবলি কী করে পরী? ...."কথাগুলো বলে নীহারিকা গজগজ করতে শুরু করল। .......পরিনীতা জানত যে নীহারিকা কোন মানুষ নয়, ও হল মানুষ রূপী শক্তিশালী একজন অশরীরী। কিন্তু নীহারিকা যে এতো ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেটা পরিনীতার কাছে ধারনার বাইরে ছিলএবার শান্ত ভাবেই সে নীহারিকাকে জিজ্ঞাসা করল, " মা। তুমি ছোটবেলায় বলতে, তুমিই নাকি আমার নিজের মা। ....কিন্তু ....."
নীহারিকা মেয়ের কথায় একটু হেসে বলল, "" নীলিমা তোকে জন্ম দিয়েছে.....তাহলে আমি কী করে তোর নিজের মা হলাম? এটাই তো বলতে চাইছিস তুই? তাহলে শোন, ..আজ তোকে আমি সবকিছুই বলল......................নীলিমাই তোর জন্মদাত্রী মা..তোর জন্মের প্রায় পাঁচ বছর আগে নীলিমা আর পবনের বিয়ে হয়ে ছিল। কিন্তু বিয়ের তিন বছর পরও ওদের কোন বাচ্চা জন্মায় নি। ওদের আর্থিক অবস্থা একবারেই ভালো ছিল না ওই সময়। তবুও ওরা সবরকম চিকিৎসা করাচ্ছিল শুধু মাত্র একটি সন্তান পাওয়ার জন্য। সেই সময়ে কেউ একজন ওদের বলে যে, গঙ্গা নদীর যেখানে উৎপত্তি স্থল সেখানে একটা অনেক বড়ো শিব মন্দির আছে। ওখানে গিয়ে পুজো দিলে, নীলিমার সন্তান হতে পারে। এই কথা শুনে পবন আর নীলিমা ওখানে যেতে আর এক দিনও দেরি করেনি। ওরা যখন পুজো দিয়ে বাড়ি ফিরছিল তখন ওরা এক তপস্বিনী মাতাকে দেখতে পেয়ে তার কাছে যায়। এবং ওরা একটা সন্তান চেয়ে তার কাছে পার্থনা করে। কিন্তু ওই তপস্বিনী জানান যে তাদের সন্তান জন্মানো সম্ভব নয়। কিন্তু একটা উপায় আছে, যদি কোন নারীর গর্ভে বড়ো হতে থাকা তিন মাসের ভ্রুনকে যদি নীলিমার গর্ভে রোপন করা হয়। তবেই সেই সন্তান জন্মানোর পরই, নীলিমা যতবার ইচ্ছা ততবারই মা হতে পারবে। কিন্তু প্রথম সন্তানকে ওই ভাবেই জন্ম দিতে হবে। এর পর পবন আর নীলিমা ওই তপস্বিনীর কাছ থেকেকিন্তু পবন ভাবে তপস্বিনী যেটা বলল তাতে কোটি টাকা খরচ হবে, যেটা কোনো দিনই পবন আর নীলিমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর কোন মেয়েই বা নিজের সন্তান তাদেরকে দেবে? ..এই ভেবে নীলিমা পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করে, আর পবনও ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্য ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না। ...........
সেই সময় আমিও ওই মন্দিরের কাছেই থাকতাম। নীলিমাকে ওই ভাবে কাঁদতে দেখে আমার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আমি ছিলাম এক অশরীরী। তাই ওরা আমাকে কেউ দেখতে পাবে না। কিন্ত সেই সময় আমিও ছিলাম তিন মাসের অন্তঃস্বত্তা। তাই নিজের কথা না ভেবে