আমার দুর্বল স্বাস্থ্যের পক্ষে সকালবেলাটা তাই খুবই শ্রমটা একটু বেশীই হয়েছিল। বিকেলবেলাটা তাই খুবই ক্লান্ত লাগছিল। হোমস কনসার্টে চলে গেল, আমি সোফায় শুয়ে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সকালবেলাকার ঘটনাবলীতে আমার মন খুবই সেখানে ঢুঁ মেরে চলেছে। যতবার চোখ বুজি, চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিহত লোকটির বিকৃত বেবুনের মত মুখ। ঐ মুখটা আমার মনের উপর এমন একটা অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছিল যার ফলে ঐ মুখের মালিককে যে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু অনুভব করা আমার পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। মানুষের মুখে যদি জঘন্যতম কোন পাপের প্রকাশ হয়ে থাকে তবে সে মুখ ক্লিভল্যান্ডের এনক জে, ড্রেবারের। তথাপি আমি স্বীকার করি, ন্যায় বিচার অবশ্য হওয়া উচিত; মৃতের দুশ্চরিত্রতার জন্য আইনের চোখে অপরাধীর কোন ক্ষমা থাকতে পারে না।
যতই ভেবেছি ততই মানে হয়েছে, লোকটিকে বিষ-প্রয়োগ করা হয়েছে বলে আমার সঙ্গী যে মত প্রকাশ করেছে সেটা অসাধারণ। মনে পড়ছে, সে মৃতের ঠোঁট দুটো শুঁকেছিল: নিশ্চয় এমন কিছু সে পেয়েছে যার ফলে তার মনে এই ধারণা জন্মেছে। তাছাড়া, বিষপ্রয়োগ না হলে আর কিভাবে লোকটির মৃত্যু হতে পারে? মৃত-দেহে আঘাতের বা শ্বারোধের কোন চিহ্ন নেই। আবার ভেবে দেখতে হবে, তাহলে কার রক্ত মেঝের উপর পুরু হয়ে ছড়িয়ে ছিল? ধৃস্তাধৃস্তির কোন চিহ্ন পাওয়া যায় নি, বা নিহতের কাছে এমন কোন অস্ত্র ছিল না যা দিয়ে সে প্রতিপক্ষকে আঘাত করতে পারে। এসব প্রশ্নের মীমাংসা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ হোমস বা আমি কারও পক্ষেই ঘুমানো সহজ নয়। তার শান্ত আত্মবিশ্বাসের ভাব দেখে মনে হচ্ছে এমন একটা সিদ্ধান্ত যে কি এক পলকের জন্যও আমি তা ভাবতে পারছি না। তার ফিরতে বেশ দেরী হয়েছিল—এত দেরী যে আমি জানতাম ঐ কনসার্ট তাকে এতক্ষণ আটকে রাখতে পারে না। তার আসার আগেই টেবিলে রাতের খাবার দেওয়া হয়েছিল।
আসন গ্রহণ করতে করতে সে বলল, অপূর্ব! সঙ্গীত সম্পর্কে ডারুইন কি বলেছেন তোমার মনে পড়ে? তিনি বলেছেন, কথা বলতে শেখার আগেই মানুষ গান গাইতে ও গান ভালবাসতে শিখেছিল। সেইজন্যই বোধ হয় গানের দ্বারা আমরা এতটা প্রভাবিত হই। যে কুয়াসাচ্ছন্ন শতাব্দীতে পৃথিবী তার শৈশব অবস্থায় ছিল তার অস্পষ্ট স্মৃতি এখনও আমাদের বাসা বেঁধে আছে।’
‘ওটা তো খুব বড় কথা,’ আমি মন্তব্য করলাম।
সে বলল, ‘প্রকৃতিকে জানতে হলে আমাদের ধারণাকেও প্রকৃতির মত বড় হতে হবে। ব্যাপার কি বল তো? তোমাকে যেন কেমন দেখাচ্ছে। ব্রিক্সটন রোডের ব্যাপারটা দেখছি তোমাকে খুবই বিচলিত করেছে।’
আমি বললামি, ‘সত্যি তাই: আফগানিস্থানের অভিজ্ঞতার পরে আমার মনটা আরও শক্ত হওয়া উচিত ছিল। মাইওয়ান্দে নিজের চোখে আমার সঙ্গীদের কুচকাটা হতে দেখেছি। তাতে তো এমন বিচলিত হই নি।’
‘বুঝতে পারছি। এখানে এমন একটা রহস্য রয়েছে যা কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করে। যেখানে কল্পনা নেই, সেখানে ভয়ও নেই। সন্ধ্যার কাগজটা পড়েছ কি?’
‘না।’
‘তাতে এ বিষয়ে একটা মোটামুটি ভাল বিবরণ দিয়েছে। তবে লোকটিকে তুলবার সময় একটি বিয়ের আংটি যে মেঝেতে পড়েছিল, সেকথা লেখে নি। না লিখে ভালই হয়েছে।’
‘কেন?’
‘এই বিজ্ঞাপনটা দেখ। ঘটনার ঠিক পরে সকালেই এটি সব কাগজে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলাম।’
কাগজটা সে আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। তার নির্দেশ মত জায়গাটা পড়লাম। ‘প্রাপ্তি’ স্তম্ভে সেটি প্রথম ঘোষণা। তাতে লেখা, ‘ব্রিকসটন রোডে আজ সকালে হোয়াইট হার্ট ট্যাভার্ন ও হল্যান্ড গ্রোভের মধ্যবর্তী রাস্তায় একটি নিরেট সোনার বিয়ের আংটি পাওয়া গিয়াছে। আজ সন্ধ্যা আটটা থেকে ন’টার মধ্যে ২২১ বি, বেকার স্ট্রীটে ডঃ ওয়াটসনের নিকট আবেদন করুন।’
‘তোমরা নামটা ব্যবহার করেছি বলে ক্ষমা করো। আমার নাম ব্যবহার করলে ওই সব আহাম্মকদের কেউ কেউ হয় তো চিনে ফেলত আর অকারণে নাক গলাত।’
‘ঠিক আছে।’ আমি বললাম, ‘কিন্তু ধরো যদি কেউ আসে, আমার কাছে তো আংটি নেই।’
আমার হাতে একটি আংটি দিয়ে সে বলল, ‘আলবৎ আছে। এতেই কাজ চলবে। এটা অবিকল একই রকম।’
‘এই বিজ্ঞাপনের ফলে কে আসবে তুমি আশা কর?’
‘কেন? বাদামী কোট পরা লোকটি—চৌকো ডগা-ওয়ালা জুতোপরা আমাদের সেই লালমুখ বন্ধু। স্বয়ং না এলে কোন স্যাঙাৎকে পাঠাবে।’
‘একজটাকে সে কি খুব বিপজ্জনক বলে মনে করবে না?’
‘মোটেই না। এই কেস সম্পর্কে আমার অভিমত যদি সত্য হয়,–অবশ্য এবিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই—কোন ঝুঁকি নেবেই। আমার মতে ড্রেবারের মৃতদেহের উপর ঝুঁকে পড়বার সময় সে আংটি হারানোর পরিবর্তে যে কোন ঝুঁকে পড়বার সময় সে আংটিটি ফেলে দেয়, কিন্তু তখন বুঝতে পারে না। বাড়ি থেকে চলে যাবার পর সেটা বুঝতে পেরেই আবার ফিরে আসে। কিন্তু নিজের নিবুদ্ধিতায় মোমবাতিটা জ্বেলে রেখে যাওয়ায় ততক্ষণে সেটা পুলিশের হাতে চলে গেছে। গেটের কাছে তার উপস্থিতিতে পাছে কোনরকম সন্দেহ হয়, তাই সে মাতা-লের ভান করে। এইবার ওই