প্রথম পর্ব – মা মারা গেলেন আজ

আউটসাইডার – আলবেয়ার কাম্যু
অনুবাদ মুনতাসীর মামুন

মুখবন্ধ

আলবেয়ার কাম্যু জন্মগ্রহণ করেছিলেন আলজিরিয়ায়, ১৯১৩ সনে। কৈশোর যৌবনের কিছুটা কেটেছিল তাঁর উত্তর আফ্রিকায় এবং প্যারিসে পা দেয়ার আগে জীবিকা অর্জনের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিভিন্ন উপায়। এর মধ্যে একটি ছিল আলজিয়ার্স ফুটবল দলের গোলরক্ষক।

 

প্যারিসে এসে বৃত্তি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি সাংবাদিকতাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ফ্রান্স অধিকার করলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি প্রতিরোধযুদ্ধে। ঐ সময় তিনি বের করেছিলেন প্রতিরোধযুদ্ধের একটি মুখপত্র ‘কমব্যাট’। ইতিমধ্যে যুদ্ধের আগেই প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম গ্রন্থ, একটি নাটক ‘ক্যালিগুলা’ (১৯৩৯)। যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় প্রকাশিত হয়েছিল দুটি গ্রন্থ ‘দি আউটসাইডার’ এবং ‘মিথ অফ সিসিফাস’। এর মধ্যে প্রথমোক্তটি তাঁকে এনে দিয়েছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি।

 

পরবর্তীকালে কাম্যু রাজনীতি ও সাংবাদিকতা ত্যাগ করে সম্পূর্ণ সময়ের জন্যে লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ফরাসি সাহিত্যে নতুন বাস্তবতা ও নতুন দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে জাঁ পল সার্ত্রর সঙ্গে তাঁর নামও উচ্চারিত হত। সাহিত্যের জন্যে ১৯৫৭ সনে কাম্যু লাভ করেছিলেন নোবেল পুরস্কার। কাম্যু পরলোকগমন করেছিলেন ১৯৬০ সনের জানুয়ারি মাসে, এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায়।

 

‘দি আউটসাইডার’-এর নায়ক মারসো। আলজিয়ার্সে সে সামান্য এক চাকুরি করে। ফরাসি আলজিরীয় মধ্যবিত্ত অবিবাহিত যুবক হিসেবে তার দিন কেটে যায় নিরানন্দ ফ্ল্যাটে, সপ্তাহান্তে মেয়েবন্ধুকে নিয়ে। কিন্তু সমাজের চোখে সে দোষী, কারণ সমাজ মনে করে তার মধ্যে অভাব আছে মৌল আবেগ ও প্রতিক্রিয়ার। দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে সে পর্যবেক্ষণ করে জীবন, যৌনতা, মৃত্যু। তারপর ঘটনাচক্রে সে খুন করে, সোপর্দ করা হয় তাকে আদালতে। আদালতের বিচার ও অন্তিমে মুত্যুদণ্ডের রায় পর্যবেক্ষণ করে সে নিরাসক্তভাবে। এ-সম্পর্কে সিরিল কনোলি লিখেছিলেন, ‘সে (মারসো) একটি নেতিবাচক ধ্বংসাত্মক শক্তি, যে তুলে ধরে বুর্জোয়া এথিকসের অবাস্তবতা।’

 

মূল বইটি লেখা হয়েছিল ফরাসিতে, নাম ‘ল্য এত্রানজার’। ১৯৪৬ সনে স্টুয়ার্ট গিলবার্ট ‘দি আউটসাইডার’ নামে তা অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজিতে। বর্তমান অনুবাদক উপরোক্ত ইংরেজি অনুবাদ (পেঙ্গুইন ১৯৬১) ব্যবহার করেছেন। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব ইংরেজি অনুবাদের রীতিটি অনুসরণের চেষ্টা করা হয়েছে, তবে সবক্ষেত্রে যে সে-প্রচেষ্টা সম্ভব হয়েছে এমন কথা বলা যায় না। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে ‘দি আউটসাইডার’ নামটিই ব্যবহৃত হল কারণ এ-নামেই গ্রন্থটি সমধিক পরিচিত।

 

অনুবাদ ও প্রকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাকে সাহায্য করেছেন সর্বজনাব বশীর আলহেলাল, আবুল হাসানাত ও মুহম্মদ নুরুল হুদা। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।

 

মুনতাসীর মামুন

ঢাকা, ১৯৭৩

 

.

 

প্রথম পর্ব

 

১.

 

মা মারা গেলেন আজ। হয়তোবা গতকাল; আমি ঠিক জানি না। আশ্রম থেকে টেলিগ্রাম এসেছে : তোমার মা মারা গেছেন। আগামীকাল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। গভীর সমবেদনা। সুতরাং ব্যাপারটা ঘোলাটে; হয়তো তিনি মারা গেছেন গতকাল।

 

বৃদ্ধদের জন্যে আশ্রমটি আলজিয়ার্স থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে, মারেনগোতে। যদি দুপুরের বাস ধরি তবে হয়তো রাত হবার আগেই সেখানে পৌঁছে যাব। তা হলে শবদেহের পাশে প্রথামতো পুরো রাতটা জেগে আগামীকাল বিকেলে আবার। ফিরে আসতে পারব। কর্তাকে বলে দুদিনের ছুটি নিলাম আর স্বাভাবিকভাবে এ অবস্থায় তিনি ‘না’ও করতে পারেন না। তবুও মনে হল তিনি যেন খানিকটা বিরক্ত হয়েছেন এবং আমি কিছু না-ভেবেই তখন তাকে বললাম : ‘দুঃখিত স্যার, কিন্তু আপনি জানেন দোষটা আমার নয়।’

 

পরে অবশ্য আমার মনে হল, কথাটা না-বললেও চলত। কৈফিয়ত দেয়ার কোনো কারণই আমার থাকতে পারে না; বরং তারই উচিত ছিল আমাকে সমবেদনা ইত্যাদি জানানো। বোধহয় পরশু তিনি তা আমাকে জানাবেন যখন দেখবেন আমি কালো। পোশাক পরে অফিসে এসেছি। কিন্তু এখন প্রায় মনে হচ্ছে মা যেন মরেননি। এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, এই মারা যাওয়াটা সবার কাছে পরিষ্কার করবে।

 

দুটোর বাস ধরলাম। দুপুরটি ছিল গনগনে। রোজকার মতো, দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছিলাম সেলাস্তির রেস্তোরাঁয়। সবাই দুঃখ প্রকাশ করল এবং সেলাস্তি বলল, ‘মার মতো পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।’ বিদায় নেওয়ার সময় সবাই আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল। রওনা দেওয়ার তাড়াহুড়োয়, শেষমুহূর্তে ইমানুয়েলের বাসায় যেতে হল কালো টাই আর শোকের কালো ফিতে ধার নেওয়ার জন্যে। মাত্র মাসখানেক আগে তার চাচা মারা গেছেন।

 

ছুটতে হয়েছিল বাস ধরার জন্যে। মনে হয়, অমনভাবে তাড়াহুড়ো করার জন্যে, এবং রাস্তা ও আকাশ থেকে ছিটকে-আসা আলোক-ঝলক, পেট্রোলের গন্ধ, বাসের ঝাঁকি সব মিলে আমাকে করে তুলেছিল তন্দ্রালস। যাহোক, প্রায় পুরোটা পথ ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখি পাশে এক সৈনিকের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছি। হেসে সে জিজ্ঞেস করল, আমি বহুদূর থেকে আসছি কি না। কথা কমাবার জন্যে খালি মাথা নাড়লাম। কথা বলার ইচ্ছে তখন আমার ছিল না।

 

আশ্রমটি গ্রাম থেকে মাইলখানেকের কিছু বেশি দূরে। হেঁটেই চলে গেলাম সেখানে। পৌঁছেই ঠিক তখন-তখনই আমি মাকে দেখতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু দারোয়ান জানাল, প্রথমে আমাকে ওয়ার্ডেনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। ওয়ার্ডেন তখন ব্যস্ত, সুতরাং আমাকে অপেক্ষা করতে হবে খানিকটা। দারোয়ান এ সময়টুকু আমার সঙ্গে কথা বলে কাটাল, তারপর নিয়ে গেল অফিসে। ওয়ার্ডেন মানুষটি ছোটখাটো, মাথার চুল ধূসর আর বাটন-হোলে লাগানো লিজিয়ন অফ অনারের গোলাপ। তিনি তাঁর টলটলে নীল চোখ মেলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর আমরা হাত মেলালাম এবং এত দীর্ঘক্ষণ তিনি। আমার হাত ধরে রাখলেন যে রীতিমতো অস্বস্তি লাগছিল। তারপর এক অফিস রেজিস্টার বের করে আমার সামনে রেখে বললেন :

 

‘মাদাম মারসো এ-আশ্রমে ভরতি হয়েছিলেন তিন বছর আগে। তার নিজের কোনো সামর্থ্য ছিল না এবং সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন তিনি তোমার ওপর।‘

 

আমার মনে হল, তিনি বোধহয় আমাকে কোনোকিছুর জন্যে দোষ দিতে চাচ্ছেন, সুতরাং কৈফিয়ত দেয়া শুরু করলাম। কিন্তু আমাকে তিনি থামিয়ে দিলেন, “তোমায় কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না হে! আমি পুরো কাগজপত্র দেখেছি, তোমার এমন কোনো ভালো অবস্থা ছিল না যে তুমি তোমার মা’র যত্ন নিতে পারো ভালোভাবে। সবসময় দেখাশোনার জন্যে তাঁর একজনের দরকার ছিল। আর তোমরা ছেলে-ছোকরারা যা চাকরি করো তাতে মনে হয় না তো খুব একটা রোজগার করো। যাহোক তোমার মা এখানে বেশ সুখী ছিলেন।

 

‘জি স্যার, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত।’ বললাম আমি। তারপর তিনি যোগ করলেন : ‘এখানে তাঁর ভালো কিছু বন্ধু ছিল, তার মতোই বৃদ্ধ সব। আর বোধহয় জানো, সবাই নিজ নিজ জেনারেশনের লোকদেরই পছন্দ করে বেশি। বয়স তোমার কম সুতরাং তুমি তার খুব ভালো সঙ্গী হতে পারতে না।’

 

কথাটা আসলে ঠিক। যখন


Rx Munna

447 Blog posts

Comments