অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে আশেপাশের সবকিছু এমনকি শহরের প্রতিটি মানুষের জীবনও গ্রাস করে ফেলল প্লেগ। একদিন উঠল প্রচণ্ড ঝড়, এবং প্লেগ-উপদ্রুত শহরের ওপর দিয়ে বয়ে চলল সেই ঝড়। ওরাওঁ-এর অধিবাসীরা ঝড়কে ভীষণ ভয় পায়, কেননা ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ঝড়ের গতিপথে বাধা দেয়ার মত প্রাকৃতিক কোন প্রতিবন্ধক নেই শহরে। গত কয়েক মাস ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় সবকিছুর ওপর ধুলোর একটা পুরু আস্তর জমে উঠেছিল। ঝড়ে সেগুলো হালকা মেঘের মত ওপরে উঠে উড়তে লাগল বাতাসের সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যে সমস্ত আকাশ ছেয়ে গেল ধুলার ধূসর মেঘে। মানুষের চারপাশে ঘুরতে লাগল অসংখ্য কাগজের টুকরো। এই দুই কারণে ক্রমেই জনশূন্য হয়ে পড়তে লাগল রাস্তাঘাট। কদাচিৎ কেউ বেরোলেও, রুমাল বা হাতে মুখ ঢাকা দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে তড়িঘড়ি হাঁটছে। রাত নামলে আগে যেমন চারদিকে মানুষের সমাগম হত, নিজেদের তারা। ডুবিয়ে দিত আনন্দ ফুর্তির ভেতর, এখন আর তেমন কিছু চোখে পড়ে না .এখন জনশূন্য রাস্তায় ঝড়ের একটানা ক্রুদ্ধ ফোঁসফোঁসানি ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। ঝড়ে আন্দোলিত বিক্ষুব্ধ সমুদ্র থেকে ভেসে আসে লবণাক্ত পানি আর পচা আগাছার গন্ধ। শহরটাকে মনে হয় অভিশপ্ত মানুষের বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ।
এতদিন প্লেগ তার শিকার খুঁজছে শহরতলির ঘিঞ্জি অঞ্চলে। কিন্তু এবার হামলা চালাল বাণিজ্যিক এলাকাগুলোয়, এবং সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে জাকিয়ে বসল। মানুষ বলল, বাতাস রোগের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।
কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলেন, এইসব এলাকাকে শহরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে ফেলা হবে, হাতে গোনা কিছু লোককে ছাড়া কাউকে আর বাইরে যাবার অনুমতি দেয়া হবে না।
ঠিক এই সময় থেকে পশ্চিম ফটক সংলগ্ন অঞ্চলগুলোয় আগুন লাগাটা অসম্ভব রকম বেড়ে গেল। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল যে সব মানুষকে সংক্রমণ এলাকার বাইরে রাখা হয়েছিল তাদের কেউ কেউ সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিল, এবং তারাই এইসব আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটাচ্ছে। প্রিয়জন বিয়োগের শোকে এরা মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে। ভাবছে, আগুন জ্বালিয়ে প্লেগের জীবাণু মেরে ফেলা যাবে। শহরে ঝড় বইতে থাকায় এই আগুন মানুষের মনে এক ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াল। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ এই অপরাধের জন্যে কঠোর শাস্তির বিধান জারি করলেন। শেষে ওই অপ্রকৃতিস্থ লোকগুলো শান্ত হয়ে এল। অবশ্য ওরা যে হাজতবাসের ভয়ে এই কাজ ছাড়ল, তা নয়। জেলখানায়ও এখন মৃত্যুর হার অকস্মাৎ বেড়ে গিয়েছে, বস্তুত এই ভয়েই কেউ জেলে যাওয়ার ঝুঁকি নিল না।
যেসব মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বাস করে-যেমন সৈনিক, কয়েদি, পাদ্রি এবং নান-প্লেগ প্রথমে তাদেরকেই আক্রমণ করে। জেলখানাগুলোয় সাধারণ কয়েদি মারা পড়ছে যে পরিমাণে, ওয়ার্ডাররাও পটল তুলছে সেইভাবে। প্লেগের কাছে ছোট-বড় কোনরকম ভেদাভেদ নেই। শহরে যে দুটো মঠ আছে, সেখান থেকে ধর্মযাজকদের সরিয়ে এনে ধার্মিক কিছু পরিবারের সঙ্গে সাময়িকভাবে তাদের থাকার বন্দোবস্ত করা হলো। ব্যারাক থেকেও কিছু সৈনিককে নিয়ে এসে রাখা হলো বিভিন্ন স্কুল এবং সরকারি অফিসে।
এইসব পরিবর্তন এবং একটানা ঝড়ো হাওয়ার কারণে কারও কারও মনে দেখা দিল দাঙ্গাবাজ মনোভাব। শহরের বিভিন্ন ফটকে প্রায়ই হামলা হতে লাগল। যারা আক্রমণ করে তাদের হাতে থাকে অস্ত্র। দুপক্ষের ভেতর রীতিমত গুলি বিনিময় হয়। তাই বাড়িয়ে দেয়া হলো গার্ডপোস্টের সংখ্যা। এর ফলে আস্তে আস্তে আক্রমণও থেমে গেল।
ফটকে আক্রমণ থেমে গেল বটে, কিন্তু কিছুদিন পর থেকে ছোট আকারে বল প্রয়োগের ঘটনা আরম্ভ হয়ে গেল। স্যানিটারি কর্তৃপক্ষ যে-সব বাড়ি সাময়িকভাবে বন্ধ করে রেখেছিলেন, সেসব বাড়িতে লুটতরাজ শুরু হলো। সাময়িক উত্তেজনার ঝোঁকে এইসব কাজে মেতে উঠল মানুষ। মাঝে মাঝে আজকাল হতবাক হয়ে যাবার মত দৃশ্য চোখে পড়ে। হয়তো একটি বাড়ি দাউদাউ আগুনে জ্বলছে, পাশে দাঁড়িয়ে শোকে দুঃখে মুহ্যমান মালিক তাকিয়ে আছেন আগুনের লেলিহান শিখার দিকে; এমন সময় কেউ সাময়িক