জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে একটা ঠাণ্ডা আবহাওয়া টানা বেশ কয়েকদিন আঁকড়ে ধরে রাখল শহরটাকে। ধবধবে হয়ে উঠল রাস্তাঘাটের চেহারা। হিম শীতল বাতাসে ঝিমিয়ে পড়ল প্লেগের প্রকোপ। পরপর তিন সপ্তাহের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেল মৃত্যুর হার সত্যিই কমে গেছে। মনে হলো প্লেগ তার স্বৈরাচারী ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ডাক্তার ক্যাসেল-এর তৈরি সিরাম ব্যবহার করলে এখন অনেক ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এই চরম প্রত্যাশার মুহূর্তেও কেউ কেউ প্রাণ হারায়। কোয়ারেনটাইন ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়া ম্যাজিস্ট্রেট মঁসিয়ে অথন তাদেরই একজন।
আগের মত এখনও দিনের বেলায় রাস্তাঘাট শূন্য থাকে। কিন্তু রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে আবার লোকজনে ভরে ওঠে ওগুলো। সবার গায়ে ওভারকোট। একটু ভালভাবে লক্ষ করলে চোখে পড়ে, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার ছাপ মুছে গেছে সবার চেহারা থেকে। মাঝে মাঝে হাসতে দেখা যায় ওদের। তবে এখনও কিছু কিছু লোক ফটকের পাহারাদারদের দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে শহর থেকে পালাবার চেষ্টা করে।
জিনিসপত্রের দাম খুব তাড়াতাড়ি নামতে শুরু করল। যেসব মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল তাদের আবার এক সঙ্গে বাস করার সুযোগ দেয়া হলো। সৈনিকরা ফিরে গেল ব্যারাকে।
পঁচিশ তারিখের আগেই সাপ্তাহিক মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেল। কর্তৃপক্ষ মেডিকেল বোর্ডের সঙ্গে পরামর্শ করে ঘোষণা করলেন: মহামারীকে আমরা সম্পূর্ণরূপে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এসেছি। সরকারি ইস্তেহারে বলা হলো: আরও দুসপ্তাহের জন্যে শহরের ফটক বন্ধ রাখা হবে; এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যেসব বিধিনিষেধ এতদিন ধরে চালু রয়েছে, সেগুলো আরও এক মাস বলবৎ থাকবে। পঁচিশ জানুয়ারির রাত একটা উৎসবের রাতে পরিণত হলো।
প্রিফেক্ট নিজেও এই আনন্দে যোগ দিলেন এবং ঘোষণা করলেন: আজ থেকে রাস্তার সমস্ত আলো জ্বালানো হবে।
আলোকিত শহরের রাস্তায় দলে দলে নেমে পড়ল কোলাহল মুখর উষ্ণু জনতা। প্রচণ্ড উল্লাসে গান ধরল ওরা। কল্পনায় ওরা শুনতে পেল: হুইসেল দিতে দিতে ট্রেন ছুটে চলেছে শহর ছেড়ে বাইরের পৃথিবীতে, সীমাহীন দূরত্বের সন্ধানে; হুঙ্কার দিতে দিতে বন্দর ছেড়ে জাহাজ ভেসে যাচ্ছে ইস্পাতের মত চকচকে সমুদ্রের বুকে।
সেদিন রাতে, তারিউ, রিও, র্যাঁবেয়া এবং ওদের অন্যান্য সহকর্মী এসে দাঁড়াল ওই আনন্দমুখর জনতার মাঝে। তখন ওদের মনে হলো একটা শূন্যতার ভেতর দিয়ে ভেসে চলেছে ওরা। বাড়ি ফেরার সময়েও ওদের কানে বাজতে লাগল জনতার উল্লাস।
এক সময় দূরে, বড় রাস্তার ওপর, জনতার উল্লাসধ্বনি ফেটে পড়ল সমুদ্র গর্জনের মত। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল তারিউ। দেখতে পেল ছোট্ট একটা উজ্জ্বল চকচকে প্রাণী লাফিয়ে লাফিয়ে পার হচ্ছে বড় রাস্তাটা। বিড়াল। বসন্তের পর এই প্রথম। বিড়াল চোখে পড়ল ওর। বিড়ালটা রাস্তার মাঝখানে থামল একবার, ইতস্তত করল কিছুক্ষণ, একটা পা তুলে চাইল কয়েকবার, তারপর সেই পা-টাকে ডান কানের ওপর দিয়ে খুব দ্রুত ঘুরিয়ে আনল; আবার এগুতে লাগল সামনের দিকে এবং হারিয়ে গেল অন্ধকারে। হাসল তারিউ। ভাবল: ব্যালকনির সেই বুড়ো দৃশ্যটা দেখতে পেলে নিশ্চয় খুব খুশি হতেন।
.
৫.০২
পঁচিশ জানুয়ারির কয়েকদিন পর তারিউ এক দুপুরে সেই ছোট্ট রাস্তাটার মোড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কখন বুড়ো, ভদ্রলোক ব্যালকনিতে বেরিয়ে আসবেন। বিড়ালগুলোকে দেখতে পেল ও। নিজের জায়গায় আবার ফিরে এসেছে ওরা, ব্যালকনির ছায়ায় শুয়ে শুয়ে বোদ পোয়াচ্ছে। কিন্তু এ সময় ব্যালকনির আশেপাশের যে জানালাগুলো খোলা থাকার কথা, সেগুলো তখনও বন্ধ আছে। তারিউ আর কোনদিন জানালাগুলোকে খুলতে দেখেনি। এ থেকে ও ধারণা করে বুড়ো ভদ্রলোক হয় মারা গেছেন, নয়তো অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন।
সবাই যখন ভাবছেন প্লেগ পরাজিতের মত পিছু হটতে শুরু করেছে, আত্মগোপন করতে চাইছে পালিয়ে,