ভূমধ্যসাগরের বুকের উপর দিয়ে ভেসে চলেছে বোম্বেটেদের “এমেলিয়া” জাহাজখানা। এডমন্ড ইতিমধ্যেই ভিড়ে গেছে তাদের দলে। তার জাহাজী-জ্ঞান ও জাহাজ চালাবার অভিজ্ঞতা দেখে বোম্বেটেরা খুশি হয়েছিল।
ওরা চলেছিল ফ্রান্সের সীমান্তে–জাহাজের বে-আইনী মালগুলো কোন নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দিতে। কয়েকদিন চলবার পর এডমন্ড একদিন দেখতে পেলো যে জাহাজখানা একটি দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। ওটা কোন দ্বীপ বুঝতে না পেরে জাহাজের কাপ্তেনকে সে জিজ্ঞাসা করলো–ওটা কোন দ্বীপ কাপ্তেন?
–মন্টিক্রিস্টো দ্বীপ।
–মন্টিক্রিস্টো দ্বীপ!
কাপ্তেনের মুখে এই কথা শুনেই এডমন্ডের বুকের ভিতর হঠাৎ যেন আলোড়ন আরম্ভ হয়ে গেল।
অতি কষ্টে মনের ভাব চেপে রেখে সে বললো–চলুন না, ওখানে কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম করে যাই!
কাপ্তেন হেসে বললো–খুব জায়গায় বিশ্রাম নেবার কথা বলেছো ভায়া! ওখানে কি মানুষ আছে নাকি?
–তার মানে?
–মানে, ঐ দ্বীপে আজ পর্যন্ত মানুষের বসতি হয়নি। তবে হ্যাঁ, শিকার যদি করতে চাও তাহলে যেতে পারি। প্রচুর শিকার পাওয়া যায় ওখানে।
জ্যাকোপো নামে ওদের মধ্যেকার একজন বোম্বেটে বলে উঠলো এইসময়–কথাটা মন্দ বলেননি। অনেকদিন মাংস খাওয়া হয়নি; চলুন দ্বীপে নেমে কিছু শিকার করে নেওয়া যাক।
কাপ্তেন বাধা দিলো না এই সাধু প্রস্তাবে।
জাহাজের গতি পরিবর্তিত হলো মন্টিক্রিস্টো দ্বীপের দিকে।
তীর থেকে বেশ কিছুটা দূরে নোঙর ফেলা হলো। জল কম বলে আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বোম্বেটেরা তখন একখানা বোটে করে চলতে লাগলো তীরের দিকে। বোটে উঠবার আগে তারা প্রয়োজনীয় গুলি, বারুদ, বন্দুক, কুড়ল, কাটারি, রান্না করবার বাসনপত্র আর মশলাপাতি তুলে নিলো বোটে। বলা বাহুল্য, এডমন্ড চললো তাদের সঙ্গে। তারপর তীরে নেমে কথা হতে লাগলো, কে শিকার করতে যাবে।
এডমন্ড বললো–আমি যাব।
জ্যাকোপো বললো–আমিও যাব তোমার সঙ্গে।
এডমন্ডের ইচ্ছা ছিল, সে একাই যাবে, তাই জ্যাকোপো যেতে চাওয়ায় সে একটু বিরক্তই হলো মনে মনে। কিন্তু মনের বিরক্তি মুখে প্রকাশ না করে সে যেন খুব খুশি হয়েছে এই রকম ভাব দেখিয়ে জ্যাকোপোর সঙ্গে এগিয়ে চললো।
কিছুদূর যাবার পর একটা নধর পাঁঠা দেখতে পেয়ে এডমন্ড গুলি করে মেরে ফেললো সেটাকে। জ্যাকোপো মনের আনন্দে ছুটে গিয়ে পাঁঠাটাকে টানতে টানতে নিয়ে এসে বললো– চলো ভাই, আর শিকারের দরকার হবে না।
এডমন্ড বললো–না ভাই, তুমি বরং এটাকে নিয়ে গিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করো। আমি দেখি আরও দু’ একটা পাই কি না। খাওয়ার আগে আমি যদি না এসে পৌঁছাই তাহলে একটা ফাঁকা আওয়াজ করো। বন্দুকের আওয়াজ শুনলেই আমি চলে আসবো। জ্যাকোপোর তখন জিভ দিয়ে জল পড়ছে। কতক্ষণে পাঁঠাটাকে রোস্ট করা হবে, তার মনে তখন কেবল সেই চিন্তা। সে তাই আনন্দের সঙ্গেই রাজী হলো এডমন্ডের প্রস্তাবে।
জ্যাকোপো চলে যেতেই এডমন্ড চললো পুবের দিকে। পুবের ঐ পাহাড়টার উপরে যেতেই হবে তাকে। পাহাড়ের কাছে হাজির হয়ে এডমন্ড লক্ষ্য করলো যে, একটা শুকনো খাল এঁকে-বেঁকে চলে গেছে সমুদ্রের দিকে। খালটি দেখে এডমুন্ডের মনে হলো যে একসময় হয়তো ওটা নদী ছিল। মহাকালের হস্তক্ষেপে আজ শুকিয়ে গেছে। নদীর ধার দিয়ে পাহাড়ের দিকে চলতে লাগলো সে।
অনেকক্ষণ চলবার পর পাহাড়ের নিচে এসে গেল এডমন্ড। এইবার শুরু হলো চড়াই। কোথাও খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে, গাছের ডাল লতা গুল্ম ধরে, কোথাও বা হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলো সে। চড়াই শেষ হতেই আরম্ভ হলো উতরাই। এইভাবে বহু চড়াই-উতরাই ভেঙে পাহাড়ের চূড়াগুলি গুনতে গুনতে চলেছে সে। তার লক্ষ্য কুড়ি নম্বর চূড়ার দক্ষিণ দিকের সেই গুহাটি–যার মধ্যে সঞ্চিত আছে স্পাডা পরিবারের অতুল ঐশ্বর্যরাশি।
কিন্তু এখনও যে দশটি চূড়াও পার হয়নি সে! এইভাবে চললে কুড়ি নম্বর চূড়ায় পৌঁছাতে বেলা শেষ হয়ে যাবে নিশ্চয়ই! ওদিকে তার দেরি দেখে তার সঙ্গীরা হয়তো খুঁজতে আসবে তাকে! তারা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে তার উদ্দেশ্যের কথা তাহলে সব পণ্ড হবে।
এইসব কথা চিন্তা করে এডমন্ড ফিরে আসাই ঠিক করলো তখনকার মতো। সে ভাবলো সঙ্গীদের কোন রকমে এখান থেকে বিদায় করতে পারলে হয়।
যাবার সময় সে পথের দুই দিকে চিহ্ন রাখতে রাখতে চললো। কোথাও পাহাড়ের গায়ে দাগ কেটে, কোথাও গাছের ডাল কেটে পথে রেখে নিশানা ঠিক করে রাখতে লাগলো সে।
অনেকক্ষণ চলবার পর সমুদ্রের দিকের প্রথম চুড়াটার উপর উঠে সে দেখতে পেলো তার সঙ্গীদের। তারা তখন খাবার ব্যবস্থায় উন্মত্তপ্রায়। হঠাৎ জ্যাকোপো তার বন্দুকটা আকাশের পানে তুলে ধরে একটা আওয়াজ করলো। এডমন্ড বুঝতে পারলো, খাবার তৈরি হয়ে গেছে, তারই সংকেত করলো জ্যাকোপো। এডমন্ড পাহাড়ের উপর থেকে হাত তুলে ইশারায় উত্তর দিল–সে আসছে।
জ্যাকোপো দেখতে পেলো তাকে। সেও হাত তুলে ইশারা করলো।
এডমন্ড তখন লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে লাগলো সেই চুড়া বেয়ে।
হঠাৎ তার সঙ্গীরা দেখলো যে এডমন্ড পড়ে গেল। হয়তো পা পিছলে পড়ে গেছে, হয়তো খুব আঘাত পেয়েছে সে–এই ভেবে চারজন লোক ছুটে আসতে লাগলো সেই পাহাড়ের দিকে।
কিছুক্ষণ পরেই এডমন্ডকে দেখতে পেলো তারা। পাহাড়ের উপরে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে ছিল সে।
ওরা তখন এডমন্ডের কাছে গিয়ে তাকে ধরে তুলবার চেষ্টা করতেই যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো সে।
জ্যাকোপো বললো–খুব লেগেছে বুঝি?
যন্ত্রণাকাতর-কণ্ঠে এডমন্ড বললো–হ্যাঁ!
–যেতে পারবে না?