গোরা ০৪

মত হিসাবে একটা কথা যেমনতরো শুনিতে হয়, মানুষের উপর প্রয়োগ করিবার বেলায় সকল সময় তাহার সেই এ

মত হিসাবে একটা কথা যেমনতরো শুনিতে হয়, মানুষের উপর প্রয়োগ করিবার বেলায় সকল সময় তাহার সেই একান্ত নিশ্চিত ভাবটা থাকে না– অন্তত বিনয়ের কাছে থাকে না, বিনয়ের হৃদয়বৃত্তি অত্যন্ত প্রবল। তাই তর্কের সময় সে একটা মতকে খুব উচ্চস্বরে মানিয়া থাকে, কিন্তু ব্যবহারের বেলা মানুষকে তাহার চেয়ে বেশি না মানিয়া থাকিতে পারে না। এমন-কি, গোরার প্রচারিত মতগুলি বিনয় যে গ্রহণ করিয়াছে তাহা কতটা মতের খাতিরে আর কতটা গোরার প্রতি তাহার একান্ত ভালোবাসার টানে তাহা বলা শক্ত।

 

গোরাদের বাড়ি হইতে বাহির হইয়া বাসায় ফিরিবার সময় বর্ষার সন্ধ্যায় যখন সে কাদা বাঁচাইয়া ধীরে ধীরে রাস্তায় চলিতেছিল তখন মত এবং মানুষে তাহার মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব বাধাইয়া দিয়াছিল।

 

এখনকার কালের নানাপ্রকার প্রকাশ্য এবং গোপন আঘাত হইতে সমাজ যদি আত্মরক্ষা করিয়া চলিতে চায় তবে খাওয়া ছোঁওয়া প্রভৃতি সকল বিষয়ে তাহাকে বিশেষ ভাবে সতর্ক হইতে হইবে এই মতটি বিনয় গোরার মুখ হইতে অতি সহজেই গ্রহণ করিয়াছে, এ লইয়া বিরুদ্ধ লোকদের সঙ্গে সে তীক্ষ্ণভাবে তর্ক করিয়াছে; বলিয়াছে, শত্রু যখন কেল্লাকে চারি দিকে আক্রমণ করিয়াছে তখন এই কেল্লার প্রত্যেক পথ-গলি দরজা-জানলা প্রত্যেক ছিদ্রটি বন্ধ করিয়া প্রাণ দিয়া যদি রক্ষা করিতে থাকি, তবে তাহাকে উদারতার অভাব বলে না।

 

কিন্তু আজ ঐ যে আনন্দময়ীর ঘরে গোরা তাহার খাওয়া নিষেধ করিয়া দিল ইহার আঘাত ভিতরে ভিতরে তাহাকে কেবলই বেদনা দিতে লাগিল।

 

বিনয়ের বাপ ছিল না, মাকেও সে অল্পবয়সে হারাইয়াছে; খুড়া থাকেন দেশে এবং ছেলেবেলা হইতেই পড়াশুনা লইয়া বিনয় কলিকাতার বাসায় একলা মানুষ হইয়াছে। গোরার সঙ্গে বন্ধুত্বসূত্রে বিনয় যেদিন হইতে আনন্দময়ীকে জানিয়াছে সেই দিন হইতে তাঁহাকে মা বলিয়াই জানিয়াছে। কতদিন তাঁহার ঘরে গিয়া সে কাড়াকাড়ি করিয়া উৎপাত করিয়া খাইয়াছে; আহার্যের অংশবিভাগ লইয়া আনন্দময়ী গোরার প্রতি পক্ষপাত করিয়া থাকেন এই অপবাদ দিয়া কতদিন সে তাহার প্রতি কৃত্রিম ঈর্ষা প্রকাশ করিয়াছে। দুই-চারি দিন বিনয় কাছে না আসিলেই আনন্দময়ী যে কতটা উৎকন্ঠিত হইয়া উঠিতেন, বিনয়কে কাছে বসাইয়া খাওয়াইবেন এই প্রত্যাশায় কতদিন তিনি তাহাদের সভাভঙ্গের জন্য উৎসুকচিত্তে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিতেন, তাহা বিনয় সমস্তই জানিত। সেই বিনয় আজ সামাজিক ঘৃণায় আনন্দময়ীর ঘরে গিয়া খাইবে না ইহা কি আনন্দময়ী সহিতে পারেন, না বিনয় সহিবে!

 

“ইহার পর হইতে ভালো বামুনের হাতে মা আমাকে খাওয়াইবেন, নিজের হাতে আর কখনো খাওয়াইবেন না– এ কথা মা হাসিমুখ করিয়া বলিলেন; কিন্তু এ যে মর্মান্তিক কথা।’ এই কথাটাই বিনয় বারবার মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে করিতে বাসায় পৌঁছিল।

 

শূন্যঘর অন্ধকার হইয়া আছে; চারি দিকে কাগজপত্র বই এলোমেলো ছড়ানো; দিয়াশালাই ধরাইয়া বিনয় তেলের শেজ জ্বালাইল– শেজের উপর বেহারার করকোষ্ঠী নানা চিহ্নে অঙ্কিত; লিখিবার টেবিলের উপর যে একটা সাদা কাপড়ের আবরণ আছে তাহার নানান জায়গায় কালি এবং তেলের দাগ; এই ঘরে তাহার প্রাণ যেন হাঁপাইয়া উঠিল। মানুষের সঙ্গ এবং স্নেহের অভাব আজ তাহার বুক যেন চাপিয়া ধরিল। দেশকে উদ্ধার, সমাজকে রক্ষা এই-সমস্ত কর্তব্যকে সে কোনোমতেই স্পষ্ট এবং সত্য করিয়া তুলিতে পারিল না– ইহার চেয়ে ঢের সত্য সেই অচিন পাখি যে একদিন শ্রাবণের উজ্জ্বল সুন্দর প্রভাতে খাঁচার কাছে আসিয়া আবার খাঁচার কাছ হইতে চলিয়া গেছে। কিন্তু সেই অচিন পাখির কথা বিনয় কোনোমতেই মনে আমল দিবে না, কোনোমতেই না। সেইজন্য মনকে আশ্রয় দিবার জন্য, যে আনন্দময়ীর ঘর হইতে গোরা তাহাকে ফিরাইয়া দিয়াছে সেই ঘরটির ছবি মনে আঁকিতে লাগিল।

 

পঙ্খের-কাজ-করা উজ্জ্বল মেজে পরিষ্কার তক্‌ তক্‌ করিতেছে; এক ধারে তক্তপোশের উপর সাদা রাজহাঁসের পাখার মতো কোমল নির্মল বিছানা পাতা রহিয়াছে; বিছানার পাশেই একটা ছোটো টুলের উপর রেড়ির তেলের বাতি এতক্ষণে জ্বালানো হইয়াছে; মা নিশ্চয়ই নানা রঙের সুতা লইয়া সেই বাতির কাছে ঝুঁকিয়া কাঁথার উপর শিল্পকাজ করিতেছেন, লছমিয়া নীচে মেজের উপর বসিয়া তাহার বাঁকা উচ্চারণের বাংলায় অনর্গল বকিয়া যাইতেছে, মা তাহার অধিকাংশই কানে আনিতেছেন না। মা যখন মনে কোনো কষ্ট পান তখন শিল্পকাজ লইয়া পড়েন– তাঁহার সেই কর্মনিবিষ্ট স্তব্ধ মুখের ছবির প্রতি বিনয় তাহার দৃষ্টি নিবদ্ধ করিল; সে মনে মনে কহিল, এই মুখের স্নেহদীপ্তি আমাকে আমার সমস্ত মনের বিক্ষেপ হইতে রক্ষা করুক


Md Nafiz

136 Blog posts

Comments