খুঞ্চের উপর জলখাবার ও চায়ের সরঞ্জাম সাজাইয়া চাকরের হাতে দিয়া সুচরিতা ছাতে আসিয়া বসিল এবং সেই মুহূর্তে বেহারার সঙ্গে গোরাও আসিয়া প্রবেশ করিল। সুদীর্ঘ শুভ্রকায় গোরার আকৃতি আয়তন ও সাজ দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হইয়া উঠিল।
গোরার কপালে গঙ্গামৃত্তিকার ছাপ, পরনে মোটা ধুতির উপর ফিতা বাঁধা জামা ও মোটা চাদর, পায়ে শুঁড়তোলা কটকি জুতা। সে যেন বর্তমান কালের বিরুদ্ধে এক মূর্তিমান বিদ্রোহের মতো আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার এরূপ সাজসজ্জা বিনয়ও পূর্বে কখনো দেখে নাই।
আজ গোরার মনে একটা বিরোধের আগুন বিশেষ করিয়াই জ্বলিতেছিল। তাহার কারণও ঘটিয়াছিল।
গ্রহণের স্নান-উপলক্ষে কোনো স্টীমার-কোম্পানি কাল প্রত্যুষে যাত্রী লইয়া ত্রিবেণী রওনা হইয়াছিল। পথের মধ্যে মধ্যে এক-এক স্টেশন হইতে বহুতর স্ত্রীলোক যাত্রী দুই-এক জন পুরুষ অভিভাবক সঙ্গে লইয়া জাহাজে উঠিতেছিল। পাছে জায়গা না পায় এজন্য ভারি ঠেলাঠেলি পড়িয়াছিল। পায়ে কাদা লইয়া জাহাজে চড়িবার তক্তাখানার উপরে টানাটানির চোটে পিছলে কেহ বা অসম্বৃত অবস্থায় নদীর জলের মধ্যে পড়িয়া যাইতেছে; কাহাকেও বা খালাসি ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতেছে; কেহ বা নিজে উঠিয়াছে, কিন্তু সঙ্গী উঠিতে পারে নাই বলিয়া ব্যাকুল হইয়া পড়িতেছে– মাঝে মাঝে দুই-এক পসলা বৃষ্টি আসিয়া তাহাদিগকে ভিজাইয়া দিতেছে, জাহাজে তাহাদের বসিবার স্থান কাদায় ভরিয়া গিয়াছে। তাহাদের মুখে চোখে একটা ত্রস্তব্যস্ত উৎসুক সকরুণ ভাব; তাহারা শক্তিহীন, অথচ তাহারা এত ক্ষুদ্র যে, জাহাজের মাল্লা হইতে কর্তা পর্যন্ত কেহই তাহাদের অনুনয়ে এতটুকু সাহায্য করিবে না ইহা নিশ্চয় জানে বলিয়া তাহাদের চেষ্টার মধ্যে ভারি একটা কাতর আশঙ্কা প্রকাশ পাইতেছে। এইরূপ অবস্থায় গোরা যথাসাধ্য যাত্রীদিগকে সাহায্য করিতেছিল। উপরের ফার্স্ট ক্লাসের ডেকে একজন ইংরেজ এবং একটি আধুনিক ধরনের বাঙালিবাবু জাহাজের রেলিং ধরিয়া পরস্পর হাস্যালাপ করিতে করিতে চুরুট মুখে তামাশা দেখিতেছিল। মাঝে মাঝে কোনো যাত্রীর বিশেষ কোনো আকস্মিক দুর্গতি দেখিয়া ইংরেজ হাসিয়া উঠিতেছিল এবং বাঙালিটিও তাহার সঙ্গে যোগ দিতেছিল।
দুই-তিনটি স্টেশন এইরূপে পার হইলে গোরার অসহ্য হইয়া উঠিল। সে উপরে উঠিয়া তাহার বজ্রগর্জনে কহিল, “ধিক্ তোমাদের! লজ্জা নাই!”
ইংরেজটা কঠোর দৃষ্টিতে গোরার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল। বাঙালি উত্তর দিল, “লজ্জা! দেশের এই-সমস্ত পশুবৎ মূঢ়দের জন্যই লজ্জা।”
গোরা মুখ লাল করিয়া কহিল, “মূঢ়ের চেয়ে বড়ো পশু আছে– যার হৃদয় নেই।”
বাঙালি রাগ করিয়া কহিল, “এ তোমার জায়গা নয়– এ ফার্স্ট ক্লাস।”
গোরা কহিল, “না, তোমার সঙ্গে একত্রে আমার জায়গা নয়– আমার জায়গা ঐ যাত্রীদের সঙ্গে। কিন্তু আমি বলে যাচ্ছি আর আমাকে তোমাদের এই ক্লাসে আসতে বাধ্য কোরো না।”
বলিয়া গোরা হন হন করিয়া নীচে চলিয়া গেল। ইংরেজ তাহার পর হইতে আরাম-কেদারায় দুই হাতায় দুই পা তুলিয়া নভেল পড়ায় মনোনিবেশ করিল। তাহার সহযাত্রী বাঙালি তাহার সঙ্গে পুনরায় আলাপ করিবার চেষ্টা দুই-একবার করিল, কিন্তু আর তাহা তেমন জমিল না। দেশের সাধারণ লোকের দলে সে নহে ইহা প্রমাণ করিবার জন্য খানসামাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মুরগির কোনো ডিশ আহারের জন্য পাওয়া যাইবে কিনা। খানসামা কহিল, “না, কেবল রুটি মাখন চা আছে।”
শুনিয়া ইংরেজকে শুনাইয়া বাঙালিটি ইংরেজি ভাষায় কহিল, “creature comforts সম্বন্ধে জাহাজের সমস্ত বন্দোবস্ত অত্যন্ত যাচ্ছেতাই।”
ইংরেজ কোনো উত্তর করিল না। টেবিলের উপর হইতে তাহার খবরের কাগজ উড়িয়া নীচে পড়িয়া গেল। বাবু চৌকি হইতে উঠিয়া কাগজখানা তুলিয়া দিল, কিন্তু থ্যাঙ্ক্স্ পাইল না।
চন্দননগরে পৌঁছিয়া নামিবার সময় সাহেব সহসা গোরার কাছে গিয়া টুপি একটু তুলিয়া কহিল, “নিজের ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত– আশা করি আমাকে ক্ষমা করিবে।” বলিয়া সে তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল।
কিন্তু শিক্ষিত বাঙালি যে সাধারণ লোকদের দুর্গতি দেখিয়া বিদেশীকে ডাকিয়া লইয়া নিজের শ্রেষ্ঠতাভিমানে হাসিতে পারে, ইহার আক্রোশ গোরাকে দগ্ধ করিতে লাগিল। দেশের জনসাধারণ এমন করিয়া নিজেদের সকলপ্রকার অপমান ও দুর্ব্যবহারের অধীনে আনিয়াছে, তাহাদিগকে পশুর মতো লাঞ্ছিত করিলে তাহারাও তাহা স্বীকার করে এবং সকলের কাছেই তাহা স্বাভাবিক ও সংগত বলিয়া মনে হয়, ইহার মূলে যে-একটা দেশব্যাপী সুগভীর অজ্ঞান আছে তাহার জন্য গোরার বুক যেন ফাটিয়া যাইতে লাগিল; কিন্তু সকলের চেয়ে তাহার এই বাজিল যে, দেশের এই চিরন্তন অপমান ও দুর্গতিকে শিক্ষিত লোক আপনার গায়ে লয় না– নিজেকে নির্মমভাবে পৃথক করিয়া লইয়া অকাতরে গৌরব বোধ করিতে পারে। আজ তাই শিক্ষিত লোকদের সমস্ত বই-পড়া ও নকল-করা সংস্কারকে একেবারে উপেক্ষা করিবার জন্যই গোরা কপালে গঙ্গামৃত্তিকার ছাপ লাগাইয়া ও একটা নূতন অদ্ভুত কটকি চটি কিনিয়া পরিয়া বুক ফুলাইয়া ব্রাহ্ম-বাড়িতে আসিয়া দাঁড়াইল।
বিনয় মনে মনে ইহা বুঝিতে পারিল, গোরার আজিকার এই-যে সাজ ইহা যুদ্ধসাজ। গোরা কী জানি কী করিয়া বসে এই ভাবিয়া বিনয়ের মনে একটা ভয়, একটা সংকোচ এবং একটা বিরোধের ভাব জাগিয়া উঠিল।
বরদাসুন্দরী যখন বিনয়ের সঙ্গে আলাপ করিতেছিলেন তখন সতীশ অগত্যা ছাতের এক কোণে একটা টিনের লাটিম ঘুরাইয়া নিজের চিত্তবিনোদনে নিযুক্ত ছিল। গোরাকে দেখিয়া তাহার লাটিম ঘোরানো বন্ধ হইয়া গেল; সে ধীরে ধীরে বিনয়ের পাশে দাঁড়াইয়া একদৃষ্টে গোরাকে দেখিতে লাগিল এবং কানে কানে বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিল, “ইনিই কি আপনার বন্ধু?”
বিনয় কহিল, “হাঁ।”
গোরা ছাতে আসিয়া মুহূর্তের এক অংশ কাল বিনয়ের মুখের দিকে চাহিয়া আর যেন তাহাকে দেখিতেই পাইল না। পরেশকে নমস্কার করিয়া সে অসংকোচে একটা চৌকি টেবিল হইতে কিছু দূরে সরাইয়া লইয়া বসিল। মেয়েরা যে এখানে কোনো-এক জায়গায় আছে তাহা লক্ষ্য করা সে অশিষ্টতা বলিয়া গণ্য করিল।
বরদাসুন্দরী এই অসভ্যের নিকট হইতে মেয়েদিগকে লইয়া চলিয়া যাইবেন স্থির করিতেছিলেন এমন সময় পরেশ তাঁহাকে কহিলেন, “এঁর নাম গৌরমোহন, আমার বন্ধু কৃষ্ণদয়ালের ছেলে।”
তখন গোরা তাঁহার দিকে ফিরিয়া নমস্কার করিল। যদিও বিনয়ের সঙ্গে আলোচনায় সুচরিতা গোরার কথা পূর্বেই শুনিয়াছিল, তবু এই অভ্যাগতটিই যে