মহিম সেদিন গোরাকে কিছু না বলিয়া তাহার পরের দিন তাহার ঘরে গেলেন। তিনি মনে করিয়াছিলেন গোরাকে পুনর্বার রাজি করাইতে বিস্তর লড়ালড়ি করিতে হইবে। কিন্তু তিনি যেই আসিয়া বলিলেন যে বিনয় কাল বিকালে আসিয়া বিবাহ সম্বন্ধে পাকা কথা দিয়া গেছে ও পানপত্র সম্বন্ধে গোরার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিতে বলিয়াছে, গোরা তখনই নিজের সম্মতি প্রকাশ করিয়া বলিল, “বেশ তো, পানপত্র হয়ে যাক্-না।”
মহিম আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “এখন তো বলছ “বেশ তো’। এর পরে আবার বাগড়া দেবে না তো?”
গোরা কহিল, “আমি তো বাধা দিয়ে বাগড়া দিই নি, অনুরোধ করেই বাগড়া দিয়েছি।”
মহিম। অতএব তোমার কাছে আমার মিনতি এই যে, তুমি বাধাও দিয়ো না, অনুরোধও কোরো না। কুরুপক্ষে নারায়ণী সেনাতেও আমার কাজ নেই, আর পাণ্ডবপক্ষে নারায়ণেও আমার দরকার দেখি নে। আমি একলা যা পারি সেই ভালো– ভুল করেছিলুম– তোমার সহায়তাও যে এমন বিপরীত তা আমি পূর্বে জানতুম না। যা হোক, কাজটা হয় এটাতে তোমার ইচ্ছা আছে তো?
গোরা। হাঁ, ইচ্ছা আছে।
মহিম। তা হলে ইচ্ছাই থাক্, কিন্তু চেষ্টায় কাজ নেই।
গোরা রাগ করে বটে এবং রাগের মুখে সবই করিতে পারে সেটাও সত্য– কিন্তু সেই রাগকে পোষণ করিয়া নিজের সংকল্প নষ্ট করা তাহার স্বভাব নয়। বিনয়কে যেমন করিয়া হউক সে বাঁধিতে চায়, এখন অভিমানের সময় নহে। গতকল্যকার ঝগড়ার প্রতিক্রিয়ার দ্বারাতেই যে বিবাহের কথাটা পাকা হইল, বিনয়ের বিদ্রোহই যে বিনয়ের বন্ধনকে দৃঢ় করিল, সে কথা মনে করিয়া গোরা কালিকার ঘটনায় মনে মনে খুশি হইল। বিনয়ের সঙ্গে তাহাদের চিরন্তন স্বাভাবিক সম্বন্ধ স্থাপন করিতে গোরা কিছুমাত্র বিলম্ব করিল না। কিন্তু এবার দুজনকার মাঝখানে তাহাদের একান্ত সহজ ভাবের একটুখানি ব্যতিক্রম ঘটিল।
গোরা এবার বুঝিয়াছে দূর হইতে বিনয়কে টানিয়া রাখা শক্ত হইবে– বিপদের ক্ষেত্র যেখানে সেইখানেই পাহারা দেওয়া চাই। গোরা মনে ভাবিল, আমি যদি পরেশবাবুদের বাড়িতে সর্বদা যাতায়াত রাখি তাহা হইলে বিনয়কে ঠিক গণ্ডির মধ্যে ধরিয়া রাখিতে পারিব।
সেই দিনই অর্থাৎ ঝগড়ার পরদিন অপরাহ্নে গোরা বিনয়ের বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল। আজই গোরা আসিবে বিনয় কোনোমতেই এমন আশা করে নাই। সেইজন্যই সে মনে মনে যেমন খুশি তেমনি আশ্চর্য হইয়া উঠিল।
আরো আশ্চর্যের বিষয় গোরা পরেশবাবুদের মেয়েদের কথাই পাড়িল, অথচ তাহার মধ্যে কিছুমাত্র বিরূপতা ছিল না। এই আলোচনায় বিনয়কে উত্তেজিত করিয়া তুলিতে বেশি চেষ্টার প্রয়োজন করে না।
সুচরিতার সঙ্গে বিনয় যে-সকল কথার আলোচনা করিয়াছে তাহা আজ সে বিস্তারিত করিয়া গোরাকে বলিতে লাগিল। সুচরিতা যে বিশেষ আগ্রহের সহিত এ-সকল প্রসঙ্গ আপনি উত্থাপিত করে এবং যতই তর্ক করুক-না কেন মনের অলক্ষ্য দেশে সে যে ক্রমশই অল্প অল্প করিয়া সায় দিতেছে, এ কথা জানাইয়া গোরাকে বিনয় উৎসাহিত করিবার চেষ্টা করিল।
বিনয় গল্প করিতে করিতে কহিল, “নন্দর মা ভূতের ওঝা এনে নন্দকে কী করে মেরে ফেলেছে এবং তাই নিয়ে তোমার সঙ্গে কী কথা হয়েছিল তাই যখন বলছিলুম তখন তিনি বললেন, “আপনারা মনে করেন ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে মেয়েদের রাঁধতে-বাড়তে আর ঘর নিকোতে দিলেই তাদের সমস্ত কর্তব্য হয়ে গেল। এক দিকে এমনি করে তাদের বুদ্ধিশুদ্ধি সমস্ত খাটো করে রেখে দেবেন, তার পরে যখন তারা ভূতের ওঝা ডাকে তখনো আপনারা রাগ করতে ছাড়বেন না। যাদের পক্ষে দুটি-একটি পরিবারের মধ্যেই সমস্ত বিশ্বজগৎ তারা কখনোই সম্পূর্ণ মানুষ হতে পারে না– এবং তারা মানুষ না হলেই পুরুষের সমস্ত বড়ো কাজকে নষ্ট করে অসম্পূর্ণ করে পুরুষকে তারা নীচের দিকে ভারাক্রান্ত করে নিজেদের দুর্গতির শোধ তুলবেই। নন্দর মাকে আপনারা এমন করে গড়েছেন এবং এমন জায়গায় ঘিরে রেখেছেন যে, আজ প্রাণের দায়েও আপনারা যদি তাকে সুবুদ্ধি দিতে চান তো সেখানে গিয়ে পৌঁছবেই না।’ আমি এ নিয়ে তর্ক করবার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু সত্য বলছি গোরা, মনে মনে তাঁর সঙ্গে মতের মিল হওয়াতে আমি জোরের সঙ্গে তর্ক করতে পারি নি। তাঁর সঙ্গে তবু তর্ক চলে, কিন্তু ললিতার সঙ্গে তর্ক করতে আমার সাহস হয় না। ললিতা যখন ভ্রূ তুলে বললেন, “আপনারা মনে করেন, জগতের কাজ আপনারা করবেন, আর আপনাদের কাজ আমরা করব! সেটি হবার জো নেই। জগতের কাজ হয় আমরাও চালাব, নয় আমরা বোঝা হয়ে থাকব; আমরা যদি বোঝা হই– তখন রাগ করে বলবেন : পথে নারী বিবর্জিতা! কিন্তু নারীকেও যদি চলতে দেন, তা হলে পথেই হোক আর ঘরেই হোক নারীকে বিবর্জন করার দরকার হয় না।’ তখন আমি আর কোনো উত্তর না করে চুপ করে রইলুম। ললিতা সহজে কথা কন না, কিন্তু যখন কন তখন খুব সাবধানে উত্তর দিতে হয়। যাই বল গোরা, আমারও মনে খুব বিশ্বাস হয়েছে যে আমাদের মেয়েরা যদি চীন-রমণীদের পায়ের মতো সংকুচিত হয়ে থাকে তা হলে আমাদের কোনো কাজ এগোবে না।”
গোরা। মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া হবে না, এমন কথা তো আমি কোনোদিন বলি নে।
বিনয়। চারুপাঠ তৃতীয় ভাগ পড়ালেই বুঝি শিক্ষা দেওয়া হয়?
গোরা। আচ্ছা, এবার থেকে বিনয়বোধ প্রথম ভাগ ধরানো যাবে।
সেদিন দুই বন্ধুতে ঘুরিয়া ফিরিয়া কেবলই পরেশবাবুর মেয়েদের কথা হইতে হইতে রাত হইয়া গেল।
গোরা একলা বাড়ি ফিরিবার পথে ঐ-সকল কথাই মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করিতে লাগিল এবং ঘরে আসিয়া বিছানায় শুইয়া যতক্ষণ ঘুম না আসিল পরেশবাবুর মেয়েদের কথা মন হইতে তাড়াইতে পারিল না। গোরার জীবনে এ উপসর্গ কোনোকালেই ছিল না, মেয়েদের কথা সে কোনোদিন চিন্তামাত্রই করে নাই। জগদ্ব্যাপারে এটাও যে একটা কথার মধ্যে, এবার বিনয় তাহা প্রমাণ করিয়া দিল। ইহাকে উড়াইয়া দিলে চলিবে না, ইহার সঙ্গে হয় আপস নয় লড়াই করিতে হইবে।
পরদিন বিনয় যখন গোরাকে কহিল, “পরেশবাবুর বাড়িতে একবার চলোই-না–অনেকদিন যাও নি– তিনি তোমার কথা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেন”, তখন গোরা বিনা আপত্তিতে রাজি হইল। শুধু রাজি হওয়া নহে, তাহার মনের মধ্যে পূর্বের মতো নিরুৎসুক ভাব ছিল না। প্রথমে সুচরিতা ও পরেশবাবুর কন্যাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে গোরা সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল, তাহার পরে মধ্যে অবজ্ঞাপূর্ণ বিরুদ্ধ ভাব তাহার মনে জন্মিয়াছিল, এখন তাহার মনে একটা কৌতূহলের উদ্রেক হইয়াছে। বিনয়ের চিত্তকে কিসে যে এত করিয়া আকর্ষণ করিতেছে তাহা জানিবার জন্য তাহার মনে একটা বিশেষ আগ্রহ জন্মিয়াছে।
উভয়ে যখন পরেশবাবুর বাড়ি গিয়া পৌঁছিল তখন সন্ধ্যা হইয়াছে। দোতলার ঘরে একটা তেলের শেজ জ্বালাইয়া হারান তাহার একটা ইংরেজি লেখা পরেশবাবুকে শুনাইতেছিলেন। এ স্থলে পরেশবাবু বস্তুত উপলক্ষমাত্র ছিলেন– সুচরিতাকে শোনানোই তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। সুচরিতা টেবিলের দূরপ্রান্তে চোখের উপর হইতে আলো আড়াল করিবার জন্য মুখের সামনে একটা তালপাতার পাখা তুলিয়া ধরিয়া চুপ করিয়া বসিয়া ছিল। সে আপন স্বাভাবিক বাধ্যতাবশত প্রবন্ধটি শুনিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছিল, কিন্তু থাকিয়া থাকিয়া তাহার মন কেবলই অন্য দিকে যাইতেছিল।
এমন সময় চাকর আসিয়া যখন গোরা ও বিনয়ের আগমন-সংবাদ জ্ঞাপন করিল তখন সুচরিতা হঠাৎ চমকিয়া উঠিল। সে চৌকি ছাড়িয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই পরেশবাবু কহিলেন, “রাধে, যাচ্ছ কোথায়? আর কেউ নয়, আমাদের বিনয় আর গৌর এসেছে।”
সুচরিতা সংকুচিত হইয়া আবার বসিল। হারানের সুদীর্ঘ ইংরেজি রচনা-পাঠে ভঙ্গ ঘটাতে সুচরিতার আরাম বোধ হইল; গোরা আসিয়াছে শুনিয়া তাহার মনে যে একটা উত্তেজনা হয় নাই তাহাও নহে, কিন্তু হারানবাবুর সম্মুখে গোরার আগমনে তাহার মনের মধ্যে ভারি একটা অস্বস্তি এবং সংকোচ বোধ হইতে লাগিল। দুজনে পাছে বিরোধ বাধে এই মনে করিয়া, অথবা কী যে তাহার কারণ তাহা বলা শক্ত।
গৌরের নাম শুনিয়াই হারানবাবুর মনের ভিতরটা একেবারে বিমুখ হইয়া উঠিল। গৌরের নমস্কারে কোনোমতে প্রতিনমস্কার করিয়া তিনি গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন। হারানকে দেখিবামাত্র গোরার সংগ্রাম করিবার প্রবৃত্তি সশস্ত্রে উদ্যত হইয়া উঠিল।
বরদাসুন্দরী তাঁহার তিন মেয়েকে লইয়া নিমন্ত্রণে গিয়াছিলেন; কথা ছিল সন্ধ্যার সময় পরেশবাবু গিয়া তাঁহাদিগকে ফিরাইয়া আনিবেন। পরেশবাবুর যাইবার সময় হইয়াছে। এমন সময় গোরা ও বিনয় আসিয়া পড়াতে তাঁহার বাধা পড়িল। কিন্তু আর বিলম্ব করা উচিত হইবে না জানিয়া তিনি হারান ও সুচরিতাকে কানে কানে বলিয়া গেলেন, “তোমরা এঁদের নিয়ে একটু বোসো, আমি যত শীঘ্র পারি ফিরে আসছি।”
দেখিতে দেখিতে গোরা এবং হারানবাবুর মধ্যে তুমুল তর্ক বাধিয়া গেল। যে প্রসঙ্গ লইয়া তর্ক তাহা এই– কলিকাতার অনতিদূরবর্তী কোনো জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ব্রাউন্লো সাহেবের সহিত ঢাকায় থাকিতে পরেশবাবুদের আলাপ হইয়াছিল। পরেশবাবুর স্ত্রীকন্যারা অন্তঃপুর হইতে বাহির হইতেন বলিয়া সাহেব এবং তাঁহার স্ত্রী ইঁহাদিগকে বিশেষ খাতির করিতেন। সাহেব তাঁহার জন্মদিনে প্রতি বৎসরে কৃষিপ্রদর্শনী মেলা করিয়া থাকেন। এবারে বরদাসুন্দরী ব্রাউন্লো সাহেবের স্ত্রীর সহিত দেখা করিবার সময় ইংরেজি কাব্যসাহিত্য প্রভৃতিতে নিজের কন্যাদের বিশেষ পারদর্শিতার কথা উত্থাপন করাতে মেমসাহেব সহসা কহিলেন, “এবার মেলায় লেফ্টেনান্ট্ গবর্নর সস্ত্রীক আসিবেন, আপনার মেয়েরা যদি তাঁহাদের সম্মুখে একটা ছোটোখাটো ইংরেজি কাব্যনাট্য অভিনয় করেন তো বড়ো ভালো হয়।’ এই প্রস্তাবে বরদাসুন্দরী অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া উঠিয়াছেন। আজ তিনি মেয়েদের রিহার্সাল দেওয়াইবার জন্যই কোনো বন্ধুর বাড়িতে লইয়া গিয়াছেন। এই মেলার গোরার উপস্থিত থাকা সম্ভবপর হইবে কি না জিজ্ঞাসা করায় গোরা কিছু অনাবশ্যক উগ্রতার সহিত বলিয়াছিল– না। এই প্রসঙ্গে এ দেশে ইংরেজ-বাঙালির সম্বন্ধ ও পরস্পর সামাজিক সম্মিলনের বাধা লইয়া দুই তরফে রীতিমত বিতণ্ডা উপস্থিত হইল।
হারান কহিলেন, “বাঙালিরই দোষ। আমাদের এত কুসংস্কার ও কুপ্রথা যে, আমরা ইংরেজের সঙ্গে মেলবার যোগ্যই নই।”
গোরা কহিল, “যদি তাই সত্য হয় তবে সেই অযোগ্যতাসত্ত্বেও ইংরেজের সঙ্গে মেলবার জন্যে লালায়িত হয়ে বেড়ানো আমাদের পক্ষে লজ্জাকর।”
হারান কহিলেন, “কিন্তু যাঁরা যোগ্য হয়েছেন তাঁরা ইংরেজের কাছে যথেষ্ট সমাদর পেয়ে থাকেন– যেমন এঁরা সকলে।”
গোরা। একজনের সমাদরের দ্বারা অন্য সকলের অনাদরটা যেখানে বেশি করে ফুটে ওঠে সেখানে