গোরা ২২

কাল রাত্রে গোরা তো পরেশবাবুর বাড়ি হইতে চলিয়া আসিল, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে সেই অভিনয়ে যোগ দেওয়ার

গোলাপ ফুলের একটু ইতিহাস আছে।

 

কাল রাত্রে গোরা তো পরেশবাবুর বাড়ি হইতে চলিয়া আসিল, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে সেই অভিনয়ে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব লইয়া বিনয়কে বিস্তর কষ্ট পাইতে হইয়াছিল।

 

এই অভিনয়ে ললিতার যে কোনো উৎসাহ ছিল তাহা নহে, সে বরঞ্চ এ-সব ব্যাপার ভালোই বাসিত না। কিন্তু কোনোমতে বিনয়কে এই অভিনয়ে জড়িত করিবার জন্য তাহার মনের মধ্যে যেন একটা জেদ চাপিয়া গিয়াছিল। যে-সমস্ত কাজ গোরার মতবিরুদ্ধ, বিনয়কে দিয়া তাহা সাধন করাইবার জন্য তাহার একটা রোখ জন্মিয়াছিল। বিনয় যে গোরার অনুবর্তী, ইহা ললিতার কাছে কেন এত অসহ্য ইহয়াছিল তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারিতেছিল না। যেমন করিয়া হোক সমস্ত বন্ধন কাটিয়া বিনয়কে স্বাধীন করিয়া দিতে পারিলে সে যেন বাঁচে, এমনি হইয়া উঠিয়াছে।

 

ললিতা তাহার বেণী দুলাইয়া মাথা নাড়িয়া কহিল, “কেন মশায়, অভিনয়ে দোষটা কী?”

 

বিনয় কহিল, “অভিনয়ে দোষ না থাকতে পারে, কিন্তু ঐ ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে অভিনয় করতে যাওয়া আমার মনে ভালো লাগছে না।”

 

ললিতা। আপনি নিজের মনের কথা বলছেন, না আর কারো?

 

বিনয়। অন্যের মনের কথা বলবার ভার আমার উপরে নেই, বলাও শক্ত। আপনি হয়তো বিশ্বাস করেন না, আমি নিজের মনের কথাটাই বলে থাকি– কখনো নিজের জবানিতে, কখনো বা অন্যের জবানিতে।

 

ললিতা এ কথার কোনো জবাব না দিয়া একটুখানি মুচকিয়া হাসিল মাত্র। একটু পরে কহিল, “আপনার বন্ধু গৌরবাবু বোধ হয় মনে করেন ম্যাজিস্ট্রেটের নিমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করলেই খুব একটা বীরত্ব হয়, ওতেই ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করার ফল হয়।”

 

বিনয় উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “আমার বন্ধু হয়তো না মনে করতে পারেন, কিন্তু আমি মনে করি । লড়াই নয় তো কী? যে লোক আমাকে গ্রাহ্যই করে না, মনে করে আমাকে কড়ে আঙুল তুলে ইশারায় ডাক দিলেই আমি কৃতার্থ হয়ে যাব, তার সেই উপেক্ষার সঙ্গে উপেক্ষা দিয়েই যদি লড়াই না করি তা হলে আত্মসম্মানকে বাঁচাব কী করে?”

 

ললিতা নিজে অভিমানী স্বভাবের লোক, বিনয়ের মুখের এই অভিমানবাক্য তাহার ভালোই লাগিল। কিন্তু সেইজন্যেই তাহার নিজের পক্ষের যুক্তিকে দুর্বল অনুভব করিয়াই ললিতা অকারণ বিদ্রূপের খোঁচায় বিনয়কে কথায় কথায় আহত করিতে লাগিল।

 

শেষকালে বিনয় কহিল, “দেখুন, আপনি তর্ক করছেন কেন? আপনি বলুন-না কেন, “আমার ইচ্ছা, আপনি অভিনয়ে যোগ দেন।’ তা হলে আমি আপনার অনুরোধ-রক্ষার খাতিরে নিজের মতটাকে বিসর্জন দিয়ে একটা সুখ পাই।”

 

ললিতা কহিল, “বাঃ, তা আমি কেন বলব? সত্যি যদি আপনার কোনো মত থাকে তা হলে সেটা আমার অনুরোধে কেন ত্যাগ করতে যাবেন? কিন্তু সেটা সত্যি হওয়া চাই।”

 

বিনয় কহিল, “আচ্ছা, সেই কথাই ভালো। আমার সত্যিকার কোনো মত নেই। আপনার অনুরোধে নাই হল, আপনার তর্কেই পরাস্ত হয়ে আমি অভিনয়ে যোগ দিতে রাজি হলুম।”

 

এমন সময় বরদাসুন্দরী ঘরে প্রবেশ করিবামাত্রই বিনয় উঠিয়া গিয়া তাঁহাকে কহিল, “অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হলে আমাকে কী করতে হবে বলে দেবেন।”

 

বরদাসুন্দরী সগর্বে কহিলেন, “সেজন্যে আপনাকে কিছুই ভাবতে হবে না, আমরা আপনাকে ঠিক তৈরি করে নিতে পারব। কেবল অভ্যাসের জন্য রোজ আপনাকে নিয়মিত আসতে হবে।”

 

বিনয় কহিল, “আচ্ছা। আজ তবে আসি।”

 

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “সে কী কথা? আপনাকে খেয়ে যেতে হচ্ছে।”

 

বিনয় কহিল, “আজ নাই খেলুম।”

 

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “না না, সে হবে না।”

 

বিনয় খাইল, কিন্তু অন্য দিনের মতো তাহার স্বাভাবিক প্রফুল্লতা ছিল না। আজ সুচরিতাও কেমন অন্যমনস্ক হইয়া চুপ করিয়া ছিল। যখন ললিতার সঙ্গে বিনয়ের লড়াই চলিতেছিল তখন সে বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইতেছিল। আজ রাত্রে কথাবার্তা আর জমিল না।

 

বিদায়ের সময় বিনয় ললিতার গম্ভীর মুখ লক্ষ্য করিয়া কহিল, “আমি হার মানলুম, তবু আপনাকে খুশি করতে পারলুম না।”

 

ললিতা কোনো জবাব না দিয়া চলিয়া গেল।

 

ললিতা সহজে কাঁদিতে জানে না, কিন্তু আজ তাহার চোখ দিয়া জল যেন ফাটিয়া বাহির হইতে চাহিল। কী হইয়াছে? কেন সে বিনয়বাবুকে বার বার এমন করিয়া খোঁচা দিতেছে এবং নিজে ব্যথা পাইতেছে?

 

বিনয় যতক্ষণ অভিনয়ে যোগ দিতে নারাজ ছিল ললিতার জেদও ততক্ষণ কেবলই চড়িয়া উঠিতেছিল। কিন্তু যখনই সে রাজি হইল তখনই তাহার সমস্ত উৎসাহ চলিয়া গেল। যোগ না-দিবার পক্ষে যতগুলি তর্ক, সমস্ত তাহার মনে প্রবল হইয়া উঠিল। তখন তাহার মন পীড়িত হইয়া বলিতে লাগিল, “কেবল আমার অনুরোধ রাখিবার জন্য বিনয়বাবুর এমন করিয়া রাজি হওয়া উচিত হয় নাই। অনুরোধ! কেন অনুরোধ রাখিবেন? তিনি মনে করেন, অনুরোধ রাখিয়া তিনি আমার সঙ্গে ভদ্রতা করিতেছেন। তাঁহার এই ভদ্রতাটুকু পাইবার জন্য আমার যেন অত্যন্ত মাথাব্যথা!’

 

কিন্তু এখন অমন করিয়া স্পর্ধা করিলে চলিবে কেন? সত্যই যে সে বিনয়কে অভিনয়ের দলে টানিবার জন্য ক্রমাগত নির্বন্ধ প্রকাশ করিয়াছে। বিনয় ভদ্রতার দায়ে তাহার এত জেদের অনুরোধ রাখিয়াছে বলিয়া রাগ করিলেই বা চলিবে কেন? এই ঘটনায় ললিতার নিজের উপরে এমনই তীব্র ঘৃণা ও লজ্জা উপস্থিত হইল যে স্বভাবত এতটা হইবার কোনো কারণ ছিল না। অন্যদিন হইলে তাহার মনের চাঞ্চল্যের সময় সে সুচরিতার কাছে যাইত। আজ গেল না এবং কেন যে তাহার বুকটাকে ঠেলিয়া তুলিয়া তাহার চোখ দিয়া এমন করিয়া জল বাহির হইতে লাগিল তাহা সে নিজেই ভালো করিয়া বুঝিতে পারিল না।

 

পরদিন সকালে সুধীর লাবণ্যকে একটি তোড়া আনিয়া দিয়াছিল। সেই তোড়ায় একটি বোঁটায় দুইটি বিকচোন্মুখ বসোরা-গোলাপ ছিল। ললিতা সেটি তোড়া হইতে খুলিয়া লইল। লাবণ্য কহিল, “ও কী করছিস?”

 

ললিতা কহিল, “তোড়ায় অনেকগুলো বাজে ফুল-পাতার মধ্যে ভালো ফুলকে বাঁধা দেখলে আমার কষ্ট হয়, ওরকম দড়ি দিয়ে সব জিনিসকে এক শ্রেণীতে জোর করে বাঁধা বর্বরতা।”

 

এই বলিয়া সমস্ত ফুলকে বন্ধনমুক্ত করিয়া ললিতা সেগুলিকে ঘরের এ দিকে, ও দিকে পৃথক করিয়া সাজাইল; কেবল গোলাপ দুটিকে হাতে করিয়া লইয়া গেল।

 

সতীশ ছুটিয়া আসিয়া কহিল, “দিদি, ফুল কোথায় পেলে?”

 

ললিতা তাহার উত্তর না দিয়া কহিল, “আজ তোর বন্ধুর বাড়িতে যাবি নে?”

 

বিনয়ের কথা এতক্ষণ সতীশের মনে ছিল না, কিন্তু তাহার উল্লেখমাত্রেই লাফাইয়া উঠিয়া কহিল, “হাঁ যাব।” বলিয়া তখনই যাইবার জন্য অস্থির হইয়া উঠিল।

 

ললিতা তাহাকে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করি, “সেখানে গিয়ে কী করিস?”

 

সতীশ সংক্ষেপে কহিল, “গল্প করি।”

 

ললিতা কহিল, “তিনি তোকে এত ছবি দেন, তুই তাঁকে কিছু দিস নে কেন?”

 

বিনয় ইংরেজি কাগজ প্রভৃতি হইতে সতীশের জন্য নানাপ্রকার ছবি কাটিয়া রাখিত। একটা খাতা করিয়া সতীশ এই ছবিগুলি তাহাতে গঁদ দিয়া আঁটিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এইরূপে পাতা পুরাইবার জন্য তাহার নেশা এতই চড়িয়া গিয়াছে যে ভালো বই দেখিলেও তাহা হইতে ছবি কাটিয়া লইবার জন্য তাহা মন ছট্‌ফট্‌ করিত। এই লোলুপতার অপরাধে তাহার দিদিদের কাছে তাহাকে বিস্তর তাড়না সহ্য করিতে হইয়াছে।

 

সংসারে প্রতিদান বলিয়া যে একটা দায় আছে সে কথাটা হঠাৎ আজ সতীশের সম্মুখে উপস্থিত হওয়াতে সে বিশেষ চিন্তিত হইয়া উঠিল। ভাঙা টিনের বাক্সটির মধ্যে তাহার নিজের বিষয়সম্পত্তি যাহা-কিছু সঞ্চিত হইয়াছে, তাহার কোনোটারই আসক্তিবন্ধন ছেদন করা তাহার পক্ষে সহজ নহে। সতীশের উদ্‌্‌বিগ্ন মুখ দেখিয়া ললিতা হাসিয়া তাহার গাল টিপিয়া দিয়া কহিল, “থাক্‌ থাক্‌, তোকে আর অত ভাবতে হবে না। আচ্ছা, এই গোলাপ ফুল দুটো তাঁকে দিস।”

 

এত সহজে সমস্যার মীমাংসা হইল দেখিয়া সে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। এবং ফুল দুটি লইয়া তখনই সে তাহার বন্ধুঋণ শোধ করিবার জন্য চলিল।

 

রাস্তায় বিনয়ের সঙ্গে তাহার দেখা হইল। “বিনয়বাবু বিনয়বাবু’ করিয়া দূর হইতে তাঁহাকে ডাক দিয়া সতীশ তাঁহার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং জামার মধ্যে ফুল লুকাইয়া কহিল, “আপনার জন্যে কী এনেছি বলুন দেখি।”


Md Nafiz

136 Blog posts

Comments