আমিনা বেগম পান খাচ্ছেন। এসময়টা তার দিনের মধ্যে একটা অমূল্য সময় বলা যায় । যে পরিমাণে পান খায়,তাতে যা মনেহয় মাসে ১০০০ টাকা খরচই হয় তার পান সামগ্রীর পিছনে । যদিও তার টাকার কোন চিন্তা নেই ।
দরজা ঠেলে রায়হানের উকি দেয়া মাথাটা দেখে একটু বিরক্তিস্বরে বললেন,কিছু চাও?
- আম্মা আমি কি ভিতরে আসব?
- বাইরে দাড়াইয়া কথা বলা আমার অপছন্দ,জানোনা?
রায়হান দরজাটা আগের মত চাপা দিয়ে এসে মায়ের পায়ে কয়েকবার সালাম করে হেসে দিল ।
- হাসো কেন,কি ঘটনা?
- আম্মা আমার একটা চাকরি হইছে,তবে ততটা সুবিধার না । যেকোন সময় ছেড়ে দিতে পারি ।
- শুরুর আগেই ছাড়াছাড়ির কথা বলতেছ কেন,গাধা কোথাকার ! বাপের মত হইছ !
রায়হান হাসিটা এখনো থামায়নি,ভালই লাগছে হাসতে ।
- বোকা ছেলে,খালি হাসে । আমার এইপাশে পা উঠাইয়া ভালমত বস ।
কথামত রায়হান তাইই করল । মায়ের গা ঘেষে একটু আদুরে ভঙ্গিতে ।
- পান খাবা আব্বা? নতুন এক মশলা আনাইছি,খুব মজা । দাড়াও একবার খাও,তাইলেই মজা বুঝবা ।
রায়হান কেবল মাথা দুলিয়ে চলেছে ।
ওর খুব জানতে ইচ্ছে করছে,কতদিন পর মা ওকে আব্বা বলে ডেকেছে । ডাকটা শুনলেনা গলা কেমন ভার হয়ে আসে । অতি আবেগেই হয়ত ।
- রায়হান,তোমার দুভাইদের খবর কি,তারা কেমন আছে?
- আম্মা আপনি সারাদিন বাসায় থেকে আমাকে এই প্রশ্ন করতেছেন কেন ।
- তারা তো আমার সামনেই আসে না । চাকরি বাকরি,বউ পোলাপান নিয়ে ভারি ব্যস্ত । আমার কাছে আসার সময় কই? তুমিও কি বাসায় থাকো না?
- আগামী ৭ দিন মানে ১ সপ্তাহ ধরে আমি বাসায় আসি নাই । কারণ এইরকম বাজারের মত বাসায় থাকতে একদম ভাল্লাগেনা ।
- ও,ভাল বলছ ।
- আম্মা আমার টিউশনি আছে,গেলাম ।
- পানটা খাবা না?
- জ্বি দেন,খেতে_খেতে যাই ।
শুধুমাত্র বসার ঘরটাই এত্ত সুন্দর করে কেউ সাজাতে পারে বিশ্বাস করাই কষ্টকর । বাব্বাহ্,এইনা হল বড়লোকি বাসা ।
টানা কয়েক মাসেও এই রুমের উপর একটুও বিস্ময় কমেনি রায়হানের । পড়াতে এলেই মনে ওলটপালট লেগে যায় রুমের প্রতিটা বস্তু দেখে ।
তবে টাশকি খাওয়া কথা হল,বড়লোক সাহেবের একমাত্র সন্তান এবং মেয়ে মানে মামুন । এই মেয়ের কথাবার্তা,চালচলন তো পুরাই উল্টা ।
ক্লাস টেন পড়ুয়া এই মেয়ের সাথে চললে কে বুঝবে,এযে বিরাট রাজার একমাত্র রাজকন্যা । তবে রায়হানের অতটা টাশকি খেতে হয়নি ।
কারণটা ওর স্বভাবের । ওর খালি ঐ জড় চাকচিক্যের প্রতিই মনোযোগ অত্যধিক । চাকচিক্যের ভেতরের জীবদের নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই ।
স্যার বসে আছেন কেন,রুমে আসেন
মামুনর ডাকে ঘোর ভাঙল রায়হানের,হ্যা আসছি ।
মামুনকে দেখে রায়হান এক নিরব ঝামেলায় পড়ে গেছে ।
ঝামেলার কথাটা তো আর সরাসরি বলা যাবেনা,চুপ করে থাকাই নিরাপদ । তাই একে নিরব ঝামেলাই আখ্যা দিয়ে ফেলল রায়হান ।
আজ হঠাৎ এরকম কেন হয়ে গেল কে জানে । আসোলেই চোখ সামাল দেয়ার মত কঠিন কাজ,পৃথিবীতে খুব কমই আছে । ধ্যত্তরি যত্তসব !
- স্যার আপনার কি কিছু হয়েছে?
একটু চমকে রায়হান বলল,নাহ্ কি হবে? কিছু না ।
ইচ্ছেকৃত হাসিটা দিতে গিয়েই ভালই ধরা খেল বেচারা ।
- স্যার মিথ্যা বলা মহাপাপ জানেন না? আচ্ছা,আমি বলি আপনার কি হয়েছে? - বল
- আমি আজ শাড়ি পড়েছি,আপনার প্রিয় রঙের । চোখে কাজল দিয়েছি খুব যত্ন করে,এটাও আপনার পছন্দমত । আর এতে আমাকে খুব সুন্দর লাগছে তাই আপনি চোখ নামাতে পারছেন না ।
রায়হানের মুখ মিডিয়াম হা হয়ে গেছে । এত নরম ভাবে চরম ধরা জীবনে এই ফাস্ট । ও খোদা,এইটা কি মেয়ে না মহিলা ফেরেশতা !
২.
হাসান সাহেব রুমে ঘুরেঘুরে কথা বলছেন । একা_একা,নিজের সাথে । যখন ভীষন একা মনেহয় এই পৃথিবীতে,তখনি তিনি এরকম করতে থাকেন ।
ফলাফল,তিনি একটু একাকিত্বের মাঝেও সান্ত্বনা খুজে পান ।
দরজায় খটখট শব্দ হতেই কথা থামিয়ে দিলেন । তিনি মোটামুটি অবাক আর কি ।
আমার কাছে কি কারো আসার কথা ছিল,কে আসবে?
আরেকবার শব্দ হল,খট-খট-খট ! হাসান সাহেব তড়িঘড়ি করে দরজার ছিটকিনি খুলে ফেললেন ।
- আব্বা কেমন আছেন?
হাসান সাহেব যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না রায়হান এসেছে ।
- এতদিন পর বাপের কথা মনে হল তোর ।
রায়হান টুপ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে একদম সটাং হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায় । খুব ঘুম পাচ্ছে ওর ।
- কিরে বেটা অসুস্থ নাকি?
- নাহ্
- তবে শুয়ে পড়লি যে? আচ্ছা শুয়ে থাক,তোর জন্য লেবু চা করে নিয়ে আসি । আজ সকালে বাজার থেকে কিনেছি,একদম টাটকা লেবু ।
হাসান সাহেবের ভীষন আনন্দ লাগছে । বাড়ি ছাড়ার পর একমাত্র এই ছোট ছেলেটাই তার খোজখবর রাখে । একদম ভালমত রাখে,কি লক্ষী একটা ।
চায়ের কাপে টানা দুচুমুক দিয়ে রায়হান বলল,আব্বা আপনি না একা থেকে ভালই আছেন । আমিও আর থাকব না ভাবতেছি ।
- তাইলে থাকবি কই?
- খালিদের বাসায় । কয়েকদিন ধরে তো ওর বাসাতেই আছি । আমার বন্ধুরা তো আর আমার মত বোকা না আব্বা । ওরা সবাই যে যার মত টাকা পয়সা কামিয়ে একদম পেটফোলা বড়লোক ।
- বাদ দে ! তুই যেমন আছিস খুব ভাল আছিস । সততাই সবকিছুর আগে ।
তারপরের কয়েকমিনিট কেটে গেল অস্বাভাবিক নিরবতায় । হাসান সাহেব গভীর মনোযোগে ছেলেকে দেখছেন । চেহারায় কার যেন ছায়া আছে ।
কার হতে পারে? মরিয়মের নাকি ওর দাদির?
যার মতই হোক,রায়হানটা দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে । দেখলেই সুপুরুষত্বের তৃপ্তি এসে যায় ।
৩.
বসার ঘরে চোখ পড়তেই ভ্রু কুচকে গেল রায়হানের । আজ রাতে চাদঁ এর বদলে সূর্য উঠবে নাকি । ভাই-ভাবি,পোলাপান দেখি সব একখানে ।
মেজভাবি ওকে দেখা মাত্রই শুরু করে দিল সুপরিচিত ঘ্যানানি,এইযে টো-টো বাবাজি বাইরে_বাইরে কি কর সারাদিন? মদ জুয়া আর কত !
রায়হান খেপলো না,একদমই না । একটুতেই খেপার পাত্র ও নয়,বরং কেমন মজা লাগছে ।
- তোমার আম্মাজানকে পাওয়া যাচ্ছে না দুপুর থেকে ।
- হয়ত বাজারে গেছে আপকামিং পান মশলার খোজ করতে । এসে পড়বে সময়মত ।
- তা হলে তো হতই,কিন্তু চিঠি লিখে গেছে একটা !
- কি লিখছে? আমি বাড়ি ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছি,আর আসব না । এই টাইপের?
- হুম
-ও,তবে আমার এসে তো কোন কাজ হল না । আম্মার কাছেই আসছিলাম,পান খেতে । হরেক মশলা দিয়ে পান,খুব খেতে ইচ্ছে করছিল । থাক,যাই ।
মেজভাবি রাগে কটমট করছেন,যতসব আহাম্মকের পাল্লায় পড়েছি আমি ! বাড়ির সবগুলা একেকটা আস্ত আহাম্মক !
সোফার একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা রায়হানকে দেখছে মামুন,অনেকক্ষন ধরে । রায়হান মাথা নামিয়ে আছে, মামুনকে দেখতে পায়নি ।
মামুনর খুব,একদম ভীষনভাবে ইচ্ছে করছে এই বোকাসোকা চেহারার ছেলেটাকে অনেক আদর করতে,ইচ্ছেমত ।
হঠাৎ এরকম ইচ্ছে হওয়ার কারণটা ও নিজেই জানেনা,অত জানতে ইচ্ছেও হয় না ।
সামনে দাড়িয়ে থাকা মামুনকে দেখে একটু ঘাবড়ে রায়হান বলল,শাড়িটা এখনো পড়ে আছো?
- হুম কেন,খুব বেশি সুন্দর লাগছে?
- তোমার আব্বু কোথায়?
- আব্বু আসবে কোথ্থেকে,আব্বু তো বিদেশ ।
- ওহ সরি,ভুল হয়ে গেছে । ইয়ে মানে আম্মু....
- আমার বড়খালা আজ হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে তো তাই অফিস শেষে আম্মু তার বাসায় গেছে । আজ রাতে ফিরবে না বলেছে ।
- তারমানে পুরা বাড়িতে তুমি একা?
- হুম । না-না,কাজের মেয়েটা আছে তো ।
- ভালই হয়েছে,বেশি লজ্জা পেতে হবে না ।
- বিড়বিড় করে কি বলছেন স্যার?
- মামুন আমি দুপ্লেট ভাত খাব । বাসায় আম্মা নেই তো তাই খেতে পারিনি....আর আমার ঐ বন্ধুর বাসায় গিয়ে দেখি তালা মারা । কোথায় গেছে কে জানে । দিতে পারবে,খুব খিদে লেগেছে জানো ।
- এক্ষুনি আনছি ।
এক দৌড়ে রান্নাঘরে এসে পড়ল মামুন । আর এক সেকেন্ড ওখানে থাকলে,স্যার চোখের পানি দেখে ফেলত । একটা মানুষ এত সরল হয় কি করে?
অতিরিক্ত মায়ায় পড়লেও যে চোখে পানি এসে ভরে যায়,তা আজ প্রথম জানলো মেয়েটা ।
রাস্তাটা এখনি কেমন খালি হয়ে গেছে । মানুষজন তেমন একটা নেই,আর কয়েকটা রিকশার এদিক ওদিক ছুটে চলা ।
পিচঢালা পথটায় মানুষ,রিকশা সবকিছুর ছায়া পড়ছে । জোছনা দিয়ে গড়া একেকটা ছায়া । আকাশে যে আজ বিশাল একটা চাদঁ,তাইতো এত জোছনা !
সেসব ছায়ার উপর নিশ্চুপ হেটে চলেছে একটা বোকাসোকা চেহারার ছেলে । ছেলেটানা একটু_একটু করে ঘামছে । কারণ পাশে থাকা শাড়ি পড়া মেয়েটা তার একটা হাত শক্ত মুঠোতে ধরে আছে । যে মুঠো থেকেই ডানা ঝাপটাচ্ছে শুভ্র এক মায়াপাখি ।