শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল (১৯৭২-১৯৭৫) বাংলাদেশে আজও বিতর্কিত এবং আলোচিত। এই সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা এবং তার সরকারের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। সম্প্রতি, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও প্রকাশনাগুলোর পুরনো তথ্য খুঁজে বের করে এসব ঘটনা নিয়ে আলোচনা নতুন করে উত্থাপিত হয়েছে।
শাসনামলের বিতর্কিত ঘটনা
যুদ্ধকালীন সময় ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনার কেন্দ্রে রয়েছে তার কিছু সিদ্ধান্ত এবং কার্যক্রম। যেমন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দিন আহমেদ যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব করেন, তখন শেখ মুজিব তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে। তাজউদ্দিন আহমেদের মেয়ে তার বই 'নেতা থেকে পিতা'-তে এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
জাসদ ও সিরাজ শিকদারের প্রতি নির্যাতন
শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াইয়ে জাসদ নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগও ওঠে। প্রায় ৩০ হাজার জাসদ কর্মীকে গ্রেপ্তার এবং বিপ্লবী নেতা সিরাজ শিকদারকে ক্রসফায়ারে হত্যার ঘটনা সেই সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।
বাকশাল ও রাজনৈতিক দমন-পীড়ন
১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করে সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার ফলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা চরম আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিরোধী দলগুলোকে কার্যত নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে, রক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে সরকারবিরোধীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ
শেখ মুজিবের সরকারের আমলে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, এই দুর্ভিক্ষে ২৭ হাজার মানুষ মারা যায়, তবে প্রকৃত সংখ্যা লক্ষাধিক হতে পারে বলে দাবি করেন অনেক গবেষক।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন ও ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা
শেখ মুজিবের ক্ষমতা ধরে রাখার প্রচেষ্টায় তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে নিজেই দায়িত্ব নেন, এবং দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। এমনকি, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মতো নেতাকে গৃহবন্দি করা হয়, এবং শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতি সম্পর্কিত বিতর্কও সেই সময়ের আলোচিত ঘটনা।
শেখ মুজিবের মৃত্যু ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই এই ঘটনায় খুশি হয়েছিল, এমনকি তার মৃত্যুর পর মন্ত্রিপরিষদের স্পিকার আব্দুল মালেক উকিল বলেন, "দেশ একটি ফেরাউনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে।"
বিচার ও বিচারবহির্ভূত নির্যাতন
শেখ মুজিবের শাসনামলে বিচারবহির্ভূত নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ব্যাপক সমালোচিত। বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের লুটপাট নিয়ে ডকুমেন্টারি নির্মাণের চেষ্টার জন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হানকে গুম করা এবং তার বোনকে ভয় দেখানোর ঘটনা সেই সময়ের একটি কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ঘটনাগুলো আজও বাংলাদেশে বিতর্কিত এবং আলোচিত। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল নিয়ে যে প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছে, সেগুলো ছোটখাটো বিতর্ক নয়, বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক গাঢ় এবং জটিল অধ্যায়। শেখ মুজিবের শাসনামলকে কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিত, সেই বিচার ইতিহাসের কোর্টে রেখে দিয়েছেন অনেকেই।