পরেশবাবুর বাসার কাছেই সর্বদা তাঁহার তত্ত্বাবধানে থাকিয়া বাস করিতে পাইবে এই কথা শুনিয়া সুচরিতা অত্যন্ত আরামবোধ করিয়াছিল। কিন্তু যখন তাহার নূতন বাড়ির গৃহসজ্জা সমাপ্ত এবং সেখানে উঠিয়া যাইবার সময় নিকটবর্তী হইল তখন সুচরিতার বুকের ভিতর যেন টানিয়া ধরিতে লাগিল। কাছে থাকা না-থাকা লইয়া কথা নয়, কিন্তু জীবনের সঙ্গে জীবনের যে সর্বাঙ্গীণ যোগ ছিল তাহাতে এত দিন পরে একটা বিচ্ছেদ ঘটিবার কাল আসিয়াছে, ইহা আজ সুচরিতার কাছে যেন তাহার এক অংশের মৃত্যুর মতো বোধ হইতে লাগিল। এই পরিবারের মধ্যে সুচরিতার যেটুকু স্থান ছিল, তাহার যে-কিছু কাজ ছিল, প্রত্যেক চাকরটির সঙ্গেও তাহার যে সম্বন্ধ ছিল, সমস্তই সুচরিতার হৃদয়কে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে লাগিল।
সুচরিতার যে নিজের কিছু সংগতি আছে এবং সেই সংগতির জোরে আজ সে স্বাধীন হইবার উপক্রম করিতেছে এই সংবাদে বরদাসুন্দরী বার বার করিয়া প্রকাশ করিলেন যে, ইহাতে ভালোই হইল, এতদিন এত সাবধানে যে দায়িত্বভার বহন করিয়া আসিতেছিলেন তাহা হইতে মুক্ত হইয়া তিনি নিশ্চিন্ত হইলেন। কিন্তু মনে মনে সুচরিতার প্রতি তাঁহার যেন একটা অভিমানের ভাব জন্মিল; সুচরিতা যে তাঁহাদের কাছ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আজ নিজের সম্বলের উপর নির্ভর করিয়া দাঁড়াইতে পারিতেছে এ যেন তাহার একটা অপরাধ। তাঁহারা ছাড়া সুচরিতার অন্য কোনো গতি নাই ইহাই মনে করিয়া অনেক সময় সুচরিতাকে তিনি আপন পরিবারের একটা আপদ বলিয়া নিজের প্রতি করুণা অনুভব করিয়াছেন, কিন্তু সেই সুচরিতার ভার যখন লাঘব হইবার সংবাদ হঠাৎ পাইলেন তখন তো মনের মধ্যে কিছুমাত্র প্রসন্নতা অনুভব করিলেন না। তাঁহাদের আশ্রয় সুচরিতার পক্ষে অত্যাবশ্যক নহে ইহা জানিয়া সে যে গর্ব অনুভব করিতে পারে, তাঁহাদের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য না হইতে পারে, এই কথা মনে করিয়া তিনি আগে হইতেই তাহাকে অপরাধী করিতে লাগিলেন। এ কয়দিন বিশেষভাবে তাহার প্রতি দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিলেন। পূর্বে তাহাকে ঘরের কাজ-কর্মে যেমন করিয়া ডাকিতেন এখন তাহা একেবারে ছাড়িয়া দিয়া গায়ে পড়িয়া তাহাকে অস্বাভাবিক সম্ভ্রম দেখাইতে লাগিলেন। বিদায়ের পূর্বে সুচরিতা ব্যথিতচিত্তে বেশি করিয়াই বরদাসুন্দরীর গৃহকার্যে যোগ দিতে চেষ্টা করিতেছিল, নানা উপলক্ষে তাঁহার কাছে কাছে ফিরিতেছিল, কিন্তু বরদাসুন্দরী যেন পাছে তাহার অসম্মান ঘটে এইরূপ ভাব দেখাইয়া তাহাকে দূরে ঠেকাইয়া রাখিতেছিলেন। এতকাল যাঁহাকে মা বলিয়া যাঁহার কাছে সুচরিতা মানুষ হইয়াছে আজ বিদায় লইবার সময়ও তিনি যে তাহার প্রতি চিত্তকে প্রতিকূল করিয়া রহিলেন, এই বেদনাই সুচরিতাকে সব চেয়ে বেশি করিয়া বাজিতে লাগিল।
লাবণ্য ললিতা লীলা সুচরিতার সঙ্গে সঙ্গেই ফিরিতে লাগিল। তাহারা অত্যন্ত উৎসাহ করিয়া তাহার নূতন বাড়ির ঘর সাজাইতে গেল, কিন্তু সেই উৎসাহের ভিতরেও অব্যক্ত বেদনার অশ্রুজল প্রচ্ছন্ন হইয়া ছিল।
এতদিন পর্যন্ত সুচরিতা নানা ছুতা করিয়া পরেশবাবুর কত-কী ছোটোখাটো কাজ করিয়া আসিয়াছে। হয়তো ফুলদানিতে ফুল সাজাইয়াছে, টেবিলের উপর বই গুছাইয়াছে, নিজের হাতে বিছানা রৌদ্রে দিয়াছে, স্নানের সময় প্রত্যহ তাঁহাকে খবর দিয়া স্মরণ করাইয়া দিয়াছে– এই-সমস্ত অভ্যস্ত কাজের কোনো গুরুত্বই প্রতিদিন কোনো পক্ষ অনুভব করে না। কিন্তু এ-সকল অনাবশ্যক কাজও যখন বন্ধ করিয়া চলিয়া যাইবার সময় উপস্থিত হয় তখন এই-সকল ছোটোখাটো সেবা, যাহা একজনে না করিলে অনায়াসে আর-এক জনে করিতে পারে, যাহা না করিলেও কাহারো বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না, এইগুলিই দুই পক্ষের চিত্তকে মথিত করিতে থাকে। সুচরিতা আজকাল যখন পরেশের ঘরের কোনো সামান্য কাজ করিতে আসে তখন সেই কাজটা পরেশের কাছে মস্ত হইয়া দেখা দেয় ও তাহর বক্ষের মধ্যে একটা দীর্ঘনিশ্বাস জমা হইয়া উঠে। এবং এই কাজ আজ বাদে কাল অন্যের হাতে সম্পন্ন হইতে থাকিবে এই কথা মনে করিয়া সুচরিতার চোখ ছল্ছল্ করিয়া আসে।
যেদিন মধ্যাহ্নে আহার করিয়া সুচরিতাদের নূতন বাড়িতে উঠিয়া যাইবার কথা সেদিন প্রাতঃকালে পরেশবাবু তাহার নিভৃত ঘরটিতে উপাসনা করিতে আসিয়া দেখিলেন, তাঁহার আসনের সম্মুখদেশ ফুল দিয়া সাজাইয়া ঘরের এক প্রান্তে সুচরিতা অপেক্ষা করিয়া বসিয়া আছে। লাবণ্য-লীলারাও উপাসনাস্থলে আজ আসিবে এইরূপ তাহারা পরামর্শ করিয়াছিল, কিন্তু ললিতা তাহাদিগকে নিষেধ করিয়া আসিতে দেয় নাই। ললিতা জানিত, পরেশবাবুর নির্জন উপাসনায় যোগ দিয়া সুচরিতা যেন বিশেষভাবে তাঁহার আনন্দের অংশ ও আশীর্বাদ লাভ করিত– আজ প্রাতঃকালে সেই আশীর্বাদ সঞ্চয় করিয়া লইবার জন্য সুচরিতার যে বিশেষ প্রয়োজন ছিল তাহাই অনুভব করিয়া ললিতা অদ্যকার উপাসনার নির্জনতা ভঙ্গ করিতে দেয় নাই।
উপাসনা শেষ হইয়া গেল। তখন সুচরিতার চোখ দিয়া জল পড়িতেছে, পরেশবাবু কহিলেন, “মা, পিছন দিকে ফিরে তাকিয়ো না, সম্মুখের পথে অগ্রসর হয়ে যাও– মনে সংকোচ রেখো না। যাই ঘটুক, যাই তোমার সম্মুখে উপস্থিত হোক, তার থেকে সম্পূর্ণ নিজের শক্তিতে ভালোকে গ্রহণ করবে এই পণ করে আনন্দের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ো। ঈশ্বরকে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে তাঁকেই নিজের একমাত্র সহায় করো– তা হলে ভুল ত্রুটি ক্ষতির মধ্যে দিয়েও লাভের পথে চলতে পারবে– আর যদি নিজেকে আধা-আধি ভাগ করো, কতক ঈশ্বরে কতক অন্যত্রে, তা হলে সমস্ত কঠিন হয়ে উঠবে। ঈশ্বর এই করুন, তোমার পক্ষে আমাদের ক্ষুদ্র আশ্রয়ের আর যেন প্রয়োজন না হয়।”