সেদিন বিকেলের ট্রেনেই আমরা ঢাকা রওনা দিলাম। অরুন সকাল থেকেই মন গম্ভীর করে রেখেছে আমার সাথে কোন কথা বলছে না। অরুন এমনিতে হাসি খুশি থাকে। এমন গম্ভীর মুখ তাকে কখনো দেখিনি। আমি অনেক বার তাকে জিজ্ঞাস করেছি সে একবারো উত্তর দেইনি।
রাত তখন আট্টা কি নয়টা। আমি আর অরুন ট্রেনের করিডোরের সামনে বসেছি। ট্রেনের কামড়াটা অপেক্ষাকৃত নির্জন। ট্রেনের সকল বাতি আগে থেকেই নিভানো। পাশের জানালা খোলা। জানালা দিয়ে শীথল হাওয়া ঢুকছে। চাদের আলো খানিক টা এসে পরেছে অরুনের মুখে। আর এতেই আমি তাকে আবছা ভাবে দেখছি। এ অদ্ভুদ পরিবেশে অরুন আমার দিকে ফিরে আচমকা বলল। আচ্ছা শহিদ তুই আত্মায় বিশ্বাস করিস। আলো ছায়াময় সেই নির্জন ট্রেনের কামরায় এমন প্রশ্ন শুনে শিউরে উঠে বলি। না আমি বিশ্বাস করি না। হঠাত এ প্রশ্ন করলি যে। অরুন কিছুক্ষন চুপ করে থেকে কি যেন ভাবতে লাগল।
তাহলে শোন,
তোকে একটা ঘটনা বলি। অনেক দিন আগে মধুপুর গ্রামে দুজন মানুষ মারা যায়। একজন কে মসজিদের পাশে আমগাছে ফাসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। এর মাস খানিক পরে একি গাছে ফাসি দিয়ে আত্মহত্যা করে। গ্রামঞ্চলে এ নিয়ে খুব তোলপাড় হয়। তখন থেকে গ্রামের মানুষ এই গাছ টি এড়িয়ে চলে। পারতপক্ষে কেউ রাতে ভুলেও আমগাছটির তলা দিয়ে যাইনা। আমি গতকাল রাতে নামাজ পড়ে গাছটির নিচ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখনো অন্ধকার কাটেনি। চাদের আলো হয়ত ছিল কিন্তু আমি যখন যাচ্ছি তখন ঘোর অন্ধকার। এমনিতে আমি খুব সাহসী কিন্তু আমগাছের তলা দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম, তখন খেয়াল করলাম আমি আসলে ভয় পাচ্ছি। সম্পূর্ন বিনা কারনে ভয়। নির্জন একটা রাস্তা দিয়ে গেলে যে কেও ভয় পেতে পারে। কিন্তু আমার ভয় টা সম্পূর্ন অন্যরকম। আমার মনে হল আমগাছ টির গোড়ায় কিছু একটা দাড়িয়ে আছে। আমি কিছুই দেখিনি। তবুও মনে হল কিছু একটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার অস্তিত্ব নেই শরীর নেই, কিছুই নেই তবুও মনে হল কিছু একটা আমার পাশে আছে। ঠিক তখনি অন্ধকারে দেখলাম ঠিক মানুষ বলা যায় না। তবুও অনেক টা মানুষের অবয়ব আম গাছে গোড়ায় দাড়িয়ে আছে। তখন এক জান্তব ভয় আমাকে গ্রাস করল। এমন তীব্রভয় আমি আগে কখনো পাইনি। আমি খেয়াল করলাম আমার পা কাপছে। আমি এক চিতকার দিয়ে মসজিদের বারান্দায় এসে অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর কি হয় জানিনা। জ্ঞান ফিরলে দেখি মসজিদের বারান্দায় শুয়ে আছি আর অনেক মানুষ ভিড় হয়ে আছে।
এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে অরুন হাপাতে লাগলো। আমি প্রচন্ড ভয়ে হারিয়ে ফেলেছি। সেদিন ট্রেনে অরুনের সাথে আর কথা হয়নি। অরুন সাড়া পথেই কি ভাবছিল।
রাত তিনটায় যখন ট্রেন ঢাকাই পৌছায় তখন ট্রেন থেকে নেমে শুধু বলল যাই। পরে দেখা হবে অরুন থাকে মগবাজারে, তার বাবা মাকে নিয়ে। আর আমি থাকি মালিবাগে। একা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে। বাসায় ফিরে সেদিন আর ঘুমোতে পারিনি। বই পড়ে, আলো জ্বালিয়ে কোন রকম রাত পার করলাম।
কিছুদিন পর প্রচন্ড কাজের চাপে অরুনের গল্প ভুলেই গিয়েছিলাম। মধুপুর যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে হঠাত অরুন আমাকে ফোন করে উদভ্রান্তের মত বলে দোস্ত তুই আমাকে বাচা
কেন কি হয়েছে ?
-আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি।
-কি হয়েছে খুলে বল। সেদিন গভীর রাতে মধুপুর থেকে ফিরে, ট্রেন স্টেশন থেকে একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম রিক্সাটা চলতে চলতে যখন অন্ধকার গলিতে ঢুকলো, ঠিক তখনি আমার মনে হল কিছু একটা আমার পাশের খালি জায়গায় বসে আছে। অনুভূতি টি এতই তীব্র যে আমার পাশে একঝলক তাকিয়ে দেখলাম। সেখানে কিছুই নেই। আমি বুঝতে পারলাম এটা আমার মনের ভুল। আম্র মনে এক অদ্ভুদ চিন্তা আসল, মধুপুরের ভয়ানক কোনকিছু আমার সাথে করে নিয়ে আসেনি তো। মন থেকে যত ই চিন্তাটা ফেলে দিতে চাইলাম ততই তা ঝাকিয়ে বসলো। রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে যখনি আমাদের বাড়ির গলিতে ঢুকলাম তখনি ওই টাকে দেখলাম সামনেই অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে। তার চোখ মুখ হাত পা কিছুই নেই। মনে হল আমার দিকে চেয়ে আছে। তার মুখে ত্রুটির হাসি। আমি দৌড়ে বাড়ির গেটে যেয়ে দাড়োয়ান কে ডাকতে থাকি। দাড়োয়ান আমাকে ধরে নিয়ে রুমে দিয়ে আসে। এতকথা অরুন একনাগাড়ে বলে হাপাতে লাগল।
আমি বললাম এসব তোর কল্পনা। চিকিতসা নিলে মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে।
-প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। তিনজন সাইক্লোজিস্টের সাথে দেখা করে ছিলাম সব বলেছি কিন্তু তারা কিছুই করতে পারেনি। এখন আমি তাকে আমার রুমে দেখি .কিছু একটা হাটছে আমার রুমে। ঘর অন্ধকার হলেই প্রায় দেখি মশারির ওপাশে কিছু একটা দাড়িয়ে আছে। তাই এখন বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাই।
আমি বললাম -ঠিক আছে তোকে আর কিছু সাইকিয়াট্রিস্টের ঠিকানা দিচ্ছি তুই গিয়ে দেখা করে আয়।
ঠিকানা নিয়ে অরুন ফোন রেখে দেয়।
আমার দেয়া ঠিকানাতে গিয়েছিল কিনা ঠিক জানি না। কিন্তু মাসখানেক পর অরুন যখন তার রুমের ফ্যানে ফাস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে তখন খুবই অবাক হলাম। বহু কাজের মধ্যেও তার জানাযায় গেলাম। সেদিন তার বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাদলেন অনেকক্ষন। কেন অরুন আত্মহত্যা করেছে তা কেও বলতে পারেনি। তবে শেষের দিকে অরুন গভীর রাতে কে কে বলে চেচিয়ে উঠত আর একা একা কথা বলত। (ঘটনাটি এখানে শেষ হতে পারতো কিন্তু আমিও নিজেও এ ঘটনায় জড়িয়ে গেলাম। আপনাদের দ্বিতীয় পর্বে বলব। কারা শুনতে চান দয়া করে জানাবেন। কেন না এই ঘটানা আসলেই সত্যি আপনারা পড়লেই লিখা সার্থক হবে। অরুনের লাশ কবর দিয়ে আসছিলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অরুন আমার অনেক কাল আগের বন্ধু। সে আর আমি কত জায়গায় ঘুরেছি তার আমার বহু স্মৃতি মনে পরে কষ্ট হতে লাগল। রাত দশটায় আমি বাড়ী ফিরে সিড়ি বেয়ে উঠার সময় খেয়াল করলাম পাশের বাড়ীর একটি বিড়াল আমার পিছন পিছন উঠতে লাগল। আমার ফ্ল্যাট তিনতলায়। ফ্ল্যাট এর দরজা খুলে ভেতরে তাকাতেই এক তীব্র ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আমার রুম পুরো অন্ধকারে ডুবে আছে। পাশের বাড়ী থেকে কিছু আলো এসে পরেছে আমার রুমে
আর এই অস্পস্ট অদ্ভুদ আলোতে স্পস্ট দেখলাম আমার শোয়ার ঘরের সিলিং ফ্যানটায় ঝুলে আছে অরুনের লাশ। আচমকা ভয়ে কাপতে কাপতে ভয়ে দৌড়ে নিচে নেমে, গেটের কাছে এসে হাপাতে লাগলাম দাড়োয়ান দৌড়ে এসে বলল
-আরে ভাইজান কি হইছে
-লাশ!
-লাশ? কোথায়?
-আমার রুমে।
দাড়োয়ান পানি দিয়ে বললো
-লন পানি খান। আর কি হইছে খুইলা কন।
-রুমের দরজা খুলে দেখি, সামনের রুমে যে ফ্যানটা তাতে রশি পেচিয়ে কেউ একজন ঝুলে আছে।
-কন কি ? চলেন তো আমার সাথে। ফ্ল্যাটে এসে দেখি কিছুই নেই। দাড়োয়ান হাসি দিয়ে বলল বেহুদায় ভয় পাইছেন। দাড়োয়ান চলে গেলেও আমি ভেতরে ঢেকতে সাহস পেলাম না। আধ ঘন্টা পর যখন ঢুকলাম তখন আগের ঘটনাটা নিজের কাছে হাস্যকর মনে হল। রাতে আরেকবার গোসল করে না খেয়েই ঘুমিয়ে পরলাম।
গভীর রাতে ঘুম ভেংগে গেল। আমার ঘুম এত সহজে ভাংগে না। তার মানে কিছু একটা হয়েছে। ভাল করে কান পেতে কিছু একটা শুনতে চেষ্টা করলাম। হঠাত মনে হল কিছু একটা নিশব্দে হাটছে আমার বিছানের চারপাশ দিয়ে। মশারির জন্য ভালো করে কিছুই দেখতে পারছি না। তবুও মনে হল ঘন অন্ধকারে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। তীব্র ভয় আমাকে গ্রাস করলো। এত তীব্র ভয় আগে কখনো পাইনি। ঘরে বাতাস নেই, ফ্যান বন্ধ তবুও আমি স্পস্ট দেখলাম আমার মশারি নড়ে উঠল। হঠাত পায়ের কাছে মশারির দিকে আমার নজর গেল আর আতংক নিয়ে দেখলাম সেখানে মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে। অনেক খানি জিভ বের হয়ে আছে। পুরো মুখে কালো রক্ত। জ্ঞান হারানোর পুর্বে টের পেলাম মানুষ পচা দূর্গন্ধ আমার রুম জুড়ে ছড়িয়ে আছে।
গভীর রাতে এখনো ঘুম ভেংগে যায়। তাকিয়ে থাকি অন্ধকারে কিছুই দেখিনা তবুও মনে হয় আমার দিকে। ভয়ানক কিছু হওয়ার দিন গুনছি। বারান্দায় কিছু একটা হাটছে। বার বার পদশব্দ শোনা যাচ্ছে, আর কিছু ফিসফিস শব্দ। এভাবে দিন দিন চলতে থাকে আমার। মাস খানেক পর যা ঘটে মনে হয় পাঠক বিশ্বাস করবেন না। যে ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সে ঘটনায় অরুনের মৃত্যুর রহস্য বেড়িয়ে আসে
কালু আর আমি ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো বন্ধু, বিপদে আপদে একে অপরের পাশে ছিলাম। এমন কোন দুষ্টুমি ছিলো না যা আমরা করি নি। তবে হ্যা, আমরা কারো ক্ষতি করতাম না। যে দুষ্টুমিটা আমরা সবচেয়ে বেশি করতাম তা হল ভুত সেজে লোকজনকে ভয় দেখানো। গ্রামে রটেই গিয়েছিল এলাকায় ভুতে বাসা বেঁধেছে। আমরা এসব শুনে চুপিচুপি হাসতাম। এভাবে খুব মজাতেই ছিলাম আমরা।।
একদিন আমার নানার বাড়িতে একটা বিয়ের দাওয়াত ঠিক হল। কালু আমার সবসময়কার দোস্ত, তাই কালুকেও বললাম আমার সাথে যেতে। প্রথমে অবশ্য কিছটা ইতস্তত করলেও পরে রাজি হয়ে গেল। নির্দিষ্ট দিনে বাসার সবাই রওনা দিল। পথে যেতে যেতে তেমন কিছু দুষ্টুমি করতে পারি নি। কারন আম্মু পাশেই ছিল। বিয়ে বাড়িতে অনেক লোকজন, খুব ভালোই লাগছিল। দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। বেশ খেলাম আমরা দুজনই। আম্মুরা নাকি কয়দিন নানু বাড়িতে বেড়াবে, তাই আমি আর কালু একাই গ্রামে ফিরে আসবো বলে ঠিক করলাম। কারন নানু বাড়িতে দুষ্টুমি করে সুবিধা করা যাবে না। আম্মুকে বলার সাথে সাথে আম্মু রাজি হয়ে গেলেন, বললেন, তবে বাড়িতেই ফিরে যা, যে বদমাইশি তোরা করস এখানে তা করতে পারবি না
আম্মু যে কিভাবে আমাদের মনের কথা এতো সুন্দরভাবে বুঝেন জানি না। আবার সাথে যাতায়াত ভাড়াও দিয়ে দিলেন। বিকালবেলাই বের হলাম নানু বাড়ি থেকে। পথে যেতে যেতে ঠিক করলাম বাসে অথবা সি এন জি তে গেলে আম্মু যে টাকা দিয়েছে সেটা প্রায় শেষ হয়ে যাবে। আর এগুলোতে না গিয়ে যদি টাকা বাঁচানো যায় তবে আমরা দুজন মিলে আরো মজা করতে পারব। ঠিক করলাম ট্রেনে করেই যাবো, টিকেট না কেটে যদি টাকা বাঁচানো যায় তবেই তো খেলা শেষ। স্টেশনে যেতে না যেতেই একটা ট্রেন ছেড়ে দিলো, দৌড়ে গিয়েও ধরতে পারলাম না। অফিসে গিয়ে পরের ট্রেন কয়টায় জানতে চাইলাম। লোকটি কিছুক্ষণ আমাদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে বলল, টিকিট ছাড়া যাইবা তাই না? সমস্যা নাই তোমাদের মতো থাকতে আমিও টিকিট ছাড়া অনেকবার আসা যাওয়া করেছি। একটু অপেক্ষা করো, সন্ধ্যার পর আরেকটা ট্রেন আসবো, অইটাতে কইরা যাইতে পারবা। আমি আর কালু লোকটার ব্যবহারে অবাক হয়ে গেলাম, ভাবলাম টিকিট ছাড়া যাব এই কথা শুনে তিনি হয়তো ঝামেলা