বড় হওয়া

এক পবিত্র দিনে জন্ম আমার, বারোই রবিউল আওয়াল, সোমবার, ভোর রাত। এমন মেয়ের জন্মেই লা ইলাহা

এক পবিত্র দিনে জন্ম আমার, বারোই রবিউল আওয়াল, সোমবার, ভোর রাত। এমন মেয়ের জন্মেই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহা মহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলার কথা, আল্লাহর ওলিরা নাকি জন্মেই তা বলেন। ফজলিখালা বলেছিলেন, আহা কি নুরানি মুখ মেয়ের, হবে না কেন, কী পবিত্র দিনে জন্মেছে!

 

কিন্তু মেয়ের মুখের নূর রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে যায়। শরাফ মামা, ফেলু মামা আর টুটু মামার পেছনে দৌড়োতে দৌড়োতে। কড়ই গাছকে পাক্কা করে চোর চোর খেলার ধুম পড়ে বিকেল হলেই। চোর দৌড়ে যাকে ছোঁবে, সে হবে চোর, গাছের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে চোরকে বলতে হবে এক দুই তিন চার পাঁচ, তারপরই ভোঁ দৌড়, যাকে কাছে পায়, তার পেছনে। মামারা আমার থেকে বড়, দৌড়োতে পারেন আমার চেয়ে দ্রুত। আমাকেই বেশির ভাগ সময় চোর হয়ে থাকতে হয়। টুটু মামা কেড়ি কেটে দৌড়োন, চোর আমি ধন্দো পড়ি। খরগোসের মত দৌড়োন ফেলুমামা, সারাদিন তাঁর পেছনে দৌড়োলেও তিনি আমার নাগালের বাইরে থাকেন।

 

ডাংগুটি খেলতে গেলেও আমাকে খাটতে হয়। আমি গুটি ছুঁড়ি, শরাফ মামা নয়ত ফেলু মামা ডাং পিটিয়ে সে গুটি মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেন। আমার ইচ্ছে করে আমি ডাং হাতে খেলি, কেউ খাটুক, গুটি ছুঁড়ুক আমার ডাংএর দিকে। তা হঠাৎ খানিকক্ষণের জন্য ঘটে বটে, আবার ডাংএর গায়ে গুটি না লাগায় ডাং ফেরত দিতে হয়।

 

মার্বেল খেলতে গেলেও জিতে আমার সব মার্বেল মামারা নিয়ে নেন। শরাফ মামা কাচের বয়ামে মার্বেল রাখেন। প্রায়ই বিছানায় বয়াম উপুড় করে ফেলে মার্বেল গোণেন তিনি। আমি মুগ্ধ চোখে দেখি চকচক করা মার্বেলগুলো। আমার কেবল তাকিয়ে থাকার অধিকার আছে, ছোঁবার নেই। একবার হাত বাড়িয়েছিলাম বলে শরাফ মামা ধাম করে পিঠে কিল বসিয়েছিলেন।

 

সিগারেটের প্যাকেটগুলোও আমার হাতছাড়া হয়ে যায়। বগা, সিজার, ব্রিস্টল আর ক্যাপস্টেনের প্যাকেট রাস্তা থেকে কুড়িয়ে চ্যাড়া খেলতাম। উঠোনের মাটিতে চারকোণা ঘর কেটে ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে চ্যাড়া ছুঁড়তে হয়, এরপর যত ইচ্ছে প্যাকেট হাতের মুঠোয় নিয়ে দু’উরুর তলে লুকিয়ে অন্যপক্ষকে বলতে হয় পুটকির তল। মানে বাজি, তোমার চ্যাড়া আমার চ্যাড়ার চারআঙুলের সীমানায় এলে আমি পুটকির তলে যা আছে দিয়ে দেব, না হলে তুমি দেবে গুনে গুনে। আমাকেই দিতে হত।

 

চোর চোর, ডাংগুটি, মার্বেল, চ্যাড়া খেলে খেলে রং তামাটে হয়ে গেছে, মুখের নূরানি গেছে, ফজলি খালা তবু আশা ছাড়েননি, তাঁর তখনও ধারণা আমি বড় হয়ে আল্লাহর পথে যাব।

 

নন্দিবাড়ি থেকে আমার ঘুরে আসার পর ফজলিখালার ধারণা আরও পোক্ত হয়। রুনুখালার বান্ধবী শর্মিলার বাড়ি নন্দিবাড়ি নামে এক এলাকায়, হাজিবাড়ি জঙ্গলে যেতে গেলে হাতের বাঁদিকে। ও বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন রুনু খালা আমাকে নিয়ে। শর্মিলার বাড়িটি, চুন সুরকি খসা পুরোনো দালান। পোড়ো বাড়ির মত, যেন দেয়ালের ভেতরে সাপ বসে আছে মোহরের কলসি নিয়ে। যেন বটগাছ গজাচ্ছে বাড়িটির ফোকরে। বাড়িটি দেখলেই মনে হয় বাড়ির ছাদে গভীর রাতে কোনও রূপবতী মেয়ে পায়ে নূপুর পরে নাচে আর বাতি জ্বাললেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। বাড়িটি ঘিরে লিচু গাছ, লিচু পেকে ঝুলে আছে গাছের সবগুলো ডাল। নন্দিবাড়ির লিচুর বেশ নাম, কিন্তু লিচুর দিকে হাত বাড়াতে আমার ভয়, যদি পোড়োবাড়ির দালান থেকে উঁকি দেয় কোনও পদ্ম গোখরা। সিঁড়ির সামনে অদ্ভুত সুন্দর এক পুকুর, জলে তাকালে তলের মাটি দেখা যায়, আর জলের আয়নায় ভেসে ওঠে মুখ, জল নড়ে, মুখও নড়ে এলোমেলো হয়ে। আমি হাসি না, অথচ জলের মুখ হাসে আমাকে দেখে।

 

সন্ধেয় নিবু নিবু হারিকেন জ্বেলে শর্মিলা আমাদের মিস্টান্ন খেতে দিয়েছিলেন, আমি মাথা নেড়ে বলেছি খাবো না। খাবো না তো খাবোই না।

 

— কেন খাবে না? শর্মিলা জিজ্ঞেস করল।

 

ঠোঁট চেপে বসে থাকি। সাপের, জিনের, ভূতের ভয়ে গলার স্বর বেরোয় না।

 

শর্মিলা অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে, যে মেয়ে ছাদে গভীর রাতে নাচে বলে মনে হয়, ও ঠিক শর্মিলার মত দেখতে। শর্মিলার কোনও যমজ বোন নয়ত আগের জন্মে ও শর্মিলাই ছিল। শর্মিলার কালো চুল সাপের মত নেমে এসেছে হাঁটু অবদি। বাড়িতে তখন একা সে, পরনে শাদা শাড়ি, বেতের চেয়ারে বসেছেন গা এলিয়ে চুল এলিয়ে, হু হু করে সন্ধের বাতাস জানলা গলে এসে আরও এলো করে দেয় চুল, আবছা আলোয় দেখি তাঁর কাজল না পরা চোখও কালো, উদাস।

 

শর্মিলা ঠোঁট খুললে মনে হয় আকাশ থেকে ডানা করে এক শাদা পাখি বয়ে আনছে শব্দমালা–খুব মিষ্টি মেয়ে তো, নাম কি তোমার?

 

কান পেতে থাকলে শর্মিলার কথার সঙ্গে নূপুরের শব্দ শোনা যায়। আমি শুনি, অন্তত। রুনু খালা বলেন–ওর নাম শোভা।

 

–মিষ্টি খাও শোভা। শর্মিলা হেসে বলেন।

 

আমার নাম শোভা নয় কথাটি বলতে চেয়েও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। শোভা নামটি আমার সত্যিকার নামের চেয়ে ভাল তা সত্যি কিন্তু নামটি আমার নয়। নামটি বলে আমাকে কেউ ডাকলে কেমন অস্বস্তি হয় আমার, ওই নামের ডাকে সাড়া দিলে নিজেকে মিথ্যুক মনে হয়, মনে হয় চোর, অন্যের নাম চুরি করে নিজের গায়ে সেঁটেছি। শর্মিলাকে হঠাৎ, হঠাৎই, আমার শর্মিলা বলে মনে হয় না, বসে আছে চুল খুলে শাদা শাড়িতে, যেন ও শর্মিলা নয়, ওর মরে যাওয়া যমজ বোন নয়ত আগের জন্মের ও বলছে। শব্দগুলো আসছে পাখির ডানায় করে। ও যখন কথা বলে নূপুরের শব্দ ভেসে আসে। মিষ্টি এক গন্ধ ঘরে, বেলি ফুলের। ঘরে কোথাও বেলি ফুল নেই, বাগানে বেলি ফুলের গাছ নেই, গন্ধ কোত্থেকে আসে আমি বুঝি না। ফুলের গন্ধ কি শর্মিলার গা থেকে আসছে! বোধহয়। রুনু খালার হাত চেপে বলি–চল, বাড়ি যাই।

 

হারিকেনের আলো ম্লান হতে হতে দপ করে নিবে যায়। শর্মিলার গায়ের আলো সারাঘর আলো করে দেয়।

 

সারাঘরে আলো ছড়িয়ে বেলি ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে শর্মিলা বলেন–এখনই চাঁদ উঠবে। ফুটফটে জোৎস্না হবে। জোৎস্নায় বসে আমরা গান গাইব আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। তুমিও গাইবে।

 

বলে রিনরিন করে হেসে ওঠেন। আমি রুনু খালার গা ঘেঁসে ভাঙা গলায় বলি –রুনুখালা, চল। বাড়ি চল।

 

সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখি, চাঁদ ছিল শর্মিলাদের বাড়ির ওপর, উড়ে উড়ে আমাদের বাড়ির আকাশ অবদি এল। রুনুখালাকে পথে বলেছি দেখ দেখ চানটা আমগোর সাথে সাথে আইতাছে। রুনুখালা মোটে অবাক হলেন না দেখে। মা’কে বাড়ি ফিরেই বলেছি–জানো মা, চান আমরা যেইদিকে গেছি সেইদিকে গেছে। নন্দিবাড়ি থেইকা চানটা আমগোর সাথে আকুয়ায় আইছে।

 

মাও আমার কথায় অবাক হন না, জিজ্ঞেস করেন–কি খাওয়াইল শর্মিলাগোর বাড়িত?

 

গর্বে ফুলে রুনুখালা বললেন–কিচ্ছু মুহে দেয় নাই। হিন্দু বাড়ি ত, এইল্লিগা।

 

হিন্দু বাড়িতে আমি কিছু মুখে দিই না। কপালে কমুকুমের টিপ পরাতে চাইলে মুখ ফিরিয়ে নিই–মা’র ধারণা পবিত্র দিনে জন্মেছি বলেই আমি এমন করি। শর্মিলাদের বাড়ি থেকে ফেরার দু’চারদিন পর ফজলিখালার কাছে প্রথম কথাটি পাড়েন মা–দেখ ফজলি, অমন দিনে জন্মাইছে বইলাই তো মেয়ে আমার হিন্দু বাড়িতে খায় না, কপালে ফুটা দিতে চাই, দেয় না।

 

ফজলিখালা প্রায়ই হাজি বাড়ি জঙ্গল পেরিয়ে চলে আসেন নানির বাড়ি। এসেই আপাদমস্তক ঢেকে রাখা বোরখাটি গা থেকে খুলে বেরিয়ে পড়েন উঠোনে, পাকঘরে ঢুকে পাতিলের ঢাকনা খুলে দেখেন কি রান্না হচ্ছে বা হয়েছে, যে রান্নাই হোক, ইলিশ মাছ ভাজা বা চিতল মাছের কোপ্তা, নাক কুঁচকে ফেলেন। দেখে ধারণা হয় তিনি বিশ্রি গন্ধ পাচ্ছেন ওসব থেকে, অথবা আদৌ এসব খাবার তিনি পছন্দ করেন না। খেতে বসলে ফজলিখালার পাতে নানি দেখে শুনে ভাল পেটিটি, তলের না ওপরের না, মাঝের ভাত দেন, না পোড়া না থ্যাবড়ানো বেগুনের বড়াটি দেন। বড়ার ওপর ভাজা পেঁয়াজও দিয়ে দেন এক মুঠো। তিনি যতক্ষণ খান নাক কুঁচকেই রাখেন, যেন এ বাড়িতে এসে শ্বশুরবাড়ির চমৎকার খাবার থেকে ভীষণ বঞ্চিত হচ্ছেন তিনি আর নিতান্তই ভদ্রতা করে যা তা কোনওরকম গিলছেন এখানে যেহেতু এসেই পড়েছেন আর দুপুরও গড়িয়েছে। খেতে বসে কেবল নাক কুঁচকে থাকা নয়, ফজলিখালা বলেন শাকটা কে রেঁধেছে, বালু বালু লাগে। মাংসটায় গরম মশলা দেওয়া হয়নি নাকি! মাছ ভাজায় মনে হয় তেল কম হয়েছে। এসব।

 

সেদিনও, যেদিন মা আমার কপালে টিপ না পরা আর হিন্দু বাড়িতে না খাওয়ার খবর শোনালেন, তিনি খেয়ে দেয়ে মুখে পান পুরে শুয়ে শুয়ে চিবোচ্ছেলেন, সেদিন ফজলিখালার আপত্তি ছিল রসুন নিয়ে, কবুতরের মাংসে নাকি রসুন কম হয়েছে। কাঁচা চারটে রসুন ফজলিখালার পাতে দিয়ে বলেছিলেন নানি দেখ তো ফজলি এহন স্বাদ লাগে কি না। –আবার পাতে রসুন দিতে গেলেন কেন মা!

ফজলিখালা শুকনো হেসে বলেন, কাঁচা রঁসুন কি আর মাংসের ঝোলে মিশবে! মাংস সিদ্ধ হয়েছে তাই তো যথেষ্ট। ক্ষুধা মেটাতে আল্লাহ বলেছেন কোনওরকম সামান্য কিছু খেলেই চলে, খাবার নিয়ে বিলাসিতা আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন না। নবীজিও অল্প খেতেন।

 

ফজলিখালার ফর্সা কপালে কোঁকড়া ক’টি চুল ঝুলে থাকে। দুর্গা প্রতিমার মত তাঁকে দেখায়। শুয়ে থাকা পান চিবোনো ফজলিখালা ঘটনাটি ফাঁস করেন ভরা ঘরে, দুপুরের পর বিছানায় শুয়ে বা বসে যারাই জিরোচ্ছিল, শোনে–বলছিলাম না, এই মেয়ে ঈমানদার হবে। দেখ, হিন্দুর বাড়িতে ও কিছু খেলো না। কপালে টিপও পরাতে দেয় না, কারণ হিন্দুরা কপালে টিপ পরে। ওকে তো কেউ শেখায়নি এসব, ও জানল কি করে! আসলে আল্লাহ ওকে জানাচ্ছেন। ছোটবেলায় ঘুমের মধ্যে ও কি যে মিষ্টি করে হাসত, ফেরেসতাদের সঙ্গে ও খেলত কি না। বড়বুর কপাল ভাল।

 

যে যত বলুক বড়বুর কপাল ভাল, মা ভাবেন তাঁর কপাল খারাপ। তাঁর পড়ালেখা করার শখ ছিল খুব, সম্ভব হয়নি। ভাল ছাত্রী বলে ইস্কুলে নাম ছিল। নানা চাইতেন মেয়ে বোরখা পরে ইস্কুলে যাক। মা বোরখা পরেই যেতেন, দেখে ইস্কুলের মেয়েরা মুখ টিপে হাসত। বিয়ে হয়ে গেল বলে ইস্কুল ছাড়তে হল। ইস্কুল থেকে শেষদিন বিদায় নেওয়ার দিন মাস্টাররা চুক চুক করে দুঃখ করে মা’কে বলেছিলেন তর মাথাডা ভালা আছিল, বিএ এমএ পাশ করতে পারতি। বিয়ার পর দেহিস পড়ালেখা যদি চালাইয়া যাইতে পারস। বিয়ের পর বাবার কাছে মা একটি আবদারই করলেন আমি লেখাপড়া করাম। দাদাকে ইস্কুলে পাঠিয়ে নিজেও তিনি যেতে শুরু করেছিলেন, বাবার আপত্তি ছিল না। আপত্তি ছিল নানার। মা’র তবু লেখাপড়ার শখ যায়নি। বাবা রাজশাহী পড়তে গেলে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে মা নিজে ইস্কুলে ভর্তি হলেন। তখন দাদা পড়েন সেভেনে, জিলা ইস্কুলে। মহাকালি ইস্কুলে মাও সেভেনে। ইস্কুলে মাস্টাররা জানতেন মা’র বিয়ে হয়েছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে। খবরটি গোপন রাখা হল ছাত্রীদের কাছে যেন মা কোনওরকম কুণ্ঠা ছাড়াই বয়সে ছোট মেয়েদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারেন, এক কাতারে বসে লেখাপড়া করতে পারেন। ক্লাস সেভেনের ষৈনমাসিক পরীক্ষায় সবচেয়ে ভাল ফল করলেন তিনি। গোপন ব্যাপারটি শেষ অবদি বাড়িতে গোপন থাকেনি। খবর জেনে বার্ষিক পরীক্ষার আগে মা’কে সাফসাফ বলে দিলেন নানা, সেই আগের মতই, মাইয়া মানষের অত নেকাপড়ার দরকার নাই। ঘরে বইসা পুলাপান মানুষ কর। বাবাও রাজশাহী থেকে চিঠি লিখে ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করে মা’কে ছেলেমেয়ে মানুষ করতে পরামর্শ দিলেন। পায়ে অদৃশ্য এক শেকল পরিয়ে দিল কেউ। মা’র স্বপ্নসাধ ভেঙে চুরমার হল আরও একবার।

 

মা’র বিশ্বাস হয় না তাঁর কপাল ভাল।

 

কপাল ভাল হলে নানাকে বেড়ালের মত পা টিপে টিপে মা’র ঘরে ঢুকে আশে পাশে কেউ আছে কি না পরখ করে পকেট থেকে বের করতে হয়েছিল কেন কাগজে মোড়ানো কৌটো! মা’র ডান হাতে কৌটোটি রেখে আঙুলগুলো বুজে দিয়েছিলেন তিনি যেন কাকপক্ষীও না দেখে! বলেছিলেন কেন জিনিসটা লুকাইয়া রাখিস, যেহেতু দেয়ালেরও কান আছে, ফিসফিস করে–আর রাইতে রাইতে মুখে মাখিস।

 

মা’র কালো মুখ ফর্সা করার ওষুধ দিয়ে দিয়েছিলেন নানা যেন বাবার চোখে মা অসুন্দরী না ঠেকেন যেন বাবা বউছেলেমেয়ে ফেলে আবার না কোথাও চলে যান। সেই কৌটোর ওষুধ মা রাতে রাতে মুখে মাখতেন, মুখের রং কিন্তু পাল্টাত না। চোখ আরও কোটরের ভেতরে যেতে থাকে, চোখের নিচে পড়তে থাকে কালি, নাক যেমন ভোঁতা, তেমন ভোঁতাই থেকে যায়। রূপ না থাক, গুণ তো আছে তাঁর, সেলাই জানেন, রান্না জানেন, মা নিজেকে স্বান্ত্বনা দেন। কিন্তু আদৌ কি গুণবতী তিনি! মা’র বিশ্বাস তাঁর চেয়ে নিখুঁত রান্না সেলাই অন্য অনেক মেয়েই জানে। রূপ গুণ না থাক, মা আবার নিজের কাঁধে মনে মনে চাপড় দিয়ে নিজেকেই বোঝান তিনি তো আস্ত একটি মানুষ, খোঁড়া নন, অন্ধ নন, পাগল নন। সোহেলির মা’র এক মেয়ে বদ্ধ পাগল, সত্য গোপন করে এক ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছে মেয়েকে। সে পাগল মেয়ের চেয়ে সংসারে নিশ্চয় এক ধাপ ওপরে মা, যে যত নিন্দা করুক মা’কে। মা পাগল না হলেও মাঝে মাঝে পাগল পাগল লাগে মা’র। বাবা যখন রাজশাহী চাকরি করছিলেন, তিনি দাদাদের নানির কাছে রেখে রওনা হয়েছিলেন একা। মা’র ভয়, বাবা তাঁকে ভালবাসেন না। নানা রং ফর্সা করার ওষুধ দিলে মা’র আরও ভয় ধরে। লাল রঙের ফ্রক মা’কে আর নীল রঙের ফজলিখালাকে যখন কিনে দিতেন নানা, মা খেজুর গাছের তলে দাঁড়িয়ে কাঁদতেন একা একা, সেই ছোটবেলায়। বিয়ের পর বাবা তাঁর জন্য শাড়ি কিনতে গেলে দোকানিকে বলতেন কালো রঙের মেয়েকে মানাবে এমন শাড়ি দিতে। শাড়ি পেয়ে মা কাঁদতেন না, ভয় পেতেন। সেই ভয় মা’র কখনও যায়নি। রাজশাহির পথে যেতে যেতে বুক ফুঁড়ে সে ভয় বেরিয়ে আসে, মা সামাল দেন। কখনও এর আগে একা একা ময়মনসিংহ ছেড়ে কোথাও যাননি মা, তা যাননি, তাই বলে কেন যাবেন না আজ, তিনি স্বামীর কাছে যাচ্ছেন, তাঁর দু’ছেলের বাবার কাছে, কোনও অবৈধ পুরুষের কাছে যাচ্ছেন না, কলমা পড়ে যে লোক তাঁকে কবূল করেছেন, তাঁর কাছে, ন্যায্য দাবিতে যাচ্ছেন। বাবা বলেননি যেতে, কিন্তু তাঁর সমস্ত শরীরে মনে তিনি বাবার কাছে যাওয়ার তীব্র আকাংখা অনুভব করছেন। বাবা ড্রাম ভরে চাল আর হাতে টাকা পয়সা দিয়ে গেছেন সংসার খরচ। কিন্তু সংসারে মন বসে না মা’র। সংসারে চাল ডালই তো সব নয়! টিঙটিঙে বোকাসোকা মেয়েরও যে মন থাকে, মন উথালপাথাল করে, কে বোঝে! বাড়ির কাউকে বোঝানো যায় না এ কথা। বাবার বদলির চাকরি, সারাদেশ ঘুরে ঘুরে চাকরি করতে হয়। রাজশাহি এসে অবদি চেষ্টা করছেন আবার বদলি হয়ে যেতে ময়মনসিংহ। কিন্তু আপিসের বাবুরা তা মানেন না। এমন সময় হঠাৎ দেখেন বউ


Rx Munna

447 Blog posts

Comments