উনসত্তরের শেষ দিকে আমাদের চলে আসতে হয় আকুয়ার পাট চুকিয়ে। এঁদো গলির ধারে খলসে মাছে ভরা পুকুর, তার পাশে, কড়ই নিম খেঁজুর আর সুপুরি গাছের বেড় দেওয়া নানির চৌচালা ঘর, উঠোনে কুয়ো ছাড়িয়ে নারকেল গাছের সার, তার ওপারে আরেক ফালি উঠোন, উঠোনের উত্তরে বৈঠক ঘর, দক্ষিণে শোবার, শোবার ঘরের সিঁড়ির কাছে পেশাবখানা, পশ্চিমে খাবার ঘর আবার আরেক ফালি উঠোন আরও পূবে, দাদাদের আর খড়ির ঘরের মাঝখানে, যে ঘর পরে কাকার ঘর হয়ে ওঠে, খড়ি রাখা হয় বৈঠকঘরের পাশে ঘুমটি ঘরের মত লাল একটি ঘরে–সব ফেলে আমরা, আমি, দাদা, ছোটদা, বাবা, মা, ইয়াসমিন উঠি এসে আমলাপাড়ায় বিশাল বাড়িতে। বাড়িতে বোতাম টিপলে বাতি জ্বলে, পাখা ঘোরে। বড় বড় ঘর, মস্ত মস্ত থাম বসানো বারান্দা। যেন রাজার বাড়ি এটি, রাজা নেই উজির নাজির নেই, বাড়ি খালি পেয়ে উঠে এসেছি। বাড়ির লাল নীল হলুদ বেগুনি কাচ লাগানো জানালাগুলো আমার চেয়ে মাথায় লম্বা। আটত্রিশটি সিঁড়ি নেমে গেছে ঘর থেকে উঠোনে। মন্দিরের দেয়ালে যেরকম খোপ থাকে, সে রকম খোপে ভরা ঘরের দেয়াল। খোপগুলো পরে বুজে ফেলেছিলেন বাবা, সিঁড়িগুলো ভেঙেও টানা ইস্কুলঘরের মত বারান্দা বানিয়ে ফেলেছিলেন। এম এ কাহহার নামে পাড়ার এক বিত্তবানের বাড়িতে বাবা দেখেছেন খোপহীন দেয়াল, টানা বারান্দা–আমি অনুমান করি, বাবা এ বাড়িটিকেও সেরকম আদল দিতে কিছু টেনেছেন, কিছু বুজেছেন। বড়লোক দেখলে, বাবাকে দেখেছি, একেবারে মিইয়ে যান। যেন বড়লোকের সব ভাল, তাদের বেঢপ বারান্দাও। তবু বাবা কখন কি করবেন কেউ জানে না, হঠাৎ হয়ত একদিন ট্রাক ভরে বালু এল বাড়িতে, সিমেন্ট এল, ইট এল–দেখে ধারণা হয় সম্ভবত ভাঙা গড়া কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, না ঘটা অবদি কারও সাধ্য নেই বোঝার কী ঘটতে যাচ্ছে। বাবার ইচ্ছের কথা কার সাধ্য আছে বোঝে! আমাদের বাড়িটিই পাড়ার আর সব বাড়ি থেকে উঁচু, হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি নীল আকাশ রকম উঁচু। বাড়িটিতে আসবাব পত্র ঢোকানোর আগের রাতে আমি আর ছোটদা এসে এক রাত থেকেছিলাম, ছোটদা তাঁর গিটারখানা নিয়ে এসেছিলেন সঙ্গে, অনেক রাত অবদি গিটার বাজালেন ছোটদা, আর আমি গিটারের হলুদ জামাটির ওপর শুয়ে ছোটদা বলে ডাকলে গমগম করে সাতবার ছোটদা শোনা যেত, তা শুনেছি যেন রাজার সাত ছেলে বাড়ির সাত দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে আছে আর আমাকে ভেঙচি কাটছে আমি যা বলি তাই বলে। আমি কোথায় বললে সাতটি কোথায়, তুমি বললে সাতটি তুমি ভেসে আসে কোত্থেকে যেন। বাড়িটির চারদিক জুড়ে নারকেল আর সুপুরি গাছ। উঠোনে তিরিশ রকম ফুল ফলের গাছ। এমন বড় বাড়ি, আমার বিশ্বাস হয় না, আমাদের। নতুন বাড়িতে আসার পর পর পর কিছু ঘটনা ঘটে, এক নম্বর জানলার শিক ভেঙে বাড়িতে চোর ঢুকে গয়নাগাটি টাকা পয়সা নিয়ে যায়। দঞ্চুনম্বর বাবাকে একদিন রিক্সায় সঙ্গে রাজিয়া বেগম, অলকা হলের সামনে দিয়ে যেতে দেখেন মা। তিন নম্বর দাদা আর তাঁর বন্ধুরা পাতা নামে একটি পত্রিকা বের করেন, কবিতা গল্প ধাঁধা নিয়ে পাঁচমিশেলি পত্রিকা। সেই পাতা পত্রিকায় রামধনু নামে একটি কবিতা লিখে আমার নামে ছেপে দেন দাদা। কবিতার রচয়িতার নাম নাসরিন জাহান তসলিমা, যদিও বিদ্যাময়ী ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় ইস্কুলের খাতায় ঝুনুখালা খানিকটা ছোট করে আমার নাম তসলিমা নাসরিন লিখেছিলেন।
দাদা বললেন–সামনের সংখ্যায় তর নামে আরেকটা কবিতা ছাপাইয়াম।
মহানন্দো বলি–তাইলে আমি নিজে লিখবাম আমার কবিতা!
দাদা ফ্যাক করে হেসে ফেলেন–যা যা। তুই আবার লেখতে পারস নাকি!
মুহূর্তে বিষাদ আমাকে ছেয়ে ফেলে। ফ্রকের কোঁচড় ভরে জাম কুড়িয়ে দৌড়ে চলে যাই ছাদে। জামের রস রেগে বেগুনি হয়ে থাকে ফ্রক। আমার মন পড়ে থাকে কবিতায়।
এর পর থেকে দাদা বাড়ি না থাকলে তাঁর পড়ার টেবিলের ড্রয়ার খুলে কবিতার খাতা বের করে গোগ্রাসে পড়ি। আহা, এরকম আমিও যদি লিখতে পারতাম!
নতুন বাড়িতে আসার পর বাবা দেড় মণ ওজনের একটি গানের যন্ত্র কিনে আনলেন জার্মানি থেকে আসা এক লোকের কাছ থেকে। বন্ধুদের ডেকে এনে যন্ত্রটি দেখাতে লাগলেন দাদা আর বলতে লাগলেন মেইড ইন জার্মানি। হিটলারের বীরত্বে দাদা সবসময়ই বড় অভিভূত। হিটলারের দেশ থেকে আসা জিনিস নিয়েও। বন্ধুরা দু’চোখ ভরে যন্ত্র দেখে যায়। তারা এ যাবৎ হিজ মাস্টারস ভয়েজের কলের গানই দেখেছে, এমন যন্ত্র দেখেনি, বড় বড় ডিস্কে ফিতে লাগানো, একটির ফিতে আরেকটিতে ঘুরে ঘুরে জমা হয়। দেখে যাওয়ার পর পর নারায়ণ সান্যাল তার একক নাটিকা, পিন্টু তার গিটারের বাজনা, মাহবুব তার গলা ছেড়ে গাওয়া নজরুল গীতি ফিতেবন্দি করতে আসে। সবকিছুই আমাকে দেখতে হয় দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে, কাছে যাওয়ার কোনও অনুমতি আমি পাইনি। দাদা ভরাট গলায় নিজের আবৃত্তি করা রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের কবিতাও ফিতেবন্দি করেন। দাদার রাতারাতি নাম হয়ে যায় শহরে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখার্জি, মান্না দের গান বাজে, দাদা আর ছোটদা দিনের বেশির ভাগ সময় বাদন যন্ত্রটির ওপর ঝুঁকে থাকেন। বড় ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দেখতে। দাদা বলেন–কিছু ধরবি না। দূরে দাঁড়াইয়া দেখবি।
দাদা বাড়ি না থাকলে আমি সে যন্ত্রও ছুঁয়ে দেখি। ইয়াসমিন ছুঁতে চাইলে বলি –দূরে দাঁড়াইয়া দেখ। কিছু ধরবি না। ও দূরে দাঁিড়য়ে দেখে। আমি যন্ত্রের দু’তিনটে বোতাম টিপলেই গান বাজতে শুরু করে। পায়ের ওপর পা তুলে শুয়ে শুয়ে গান শুনি। আমার বড় দাদা হতে ইচ্ছে করে।
বাড়িতে চুরি হওয়ার কারণে এরকম নিয়ম দাঁড়ায় জানালা দরজা সব বন্ধ রাখতে হবে। সে গরমে গা সেদ্ধ হলেও জানালা খুলে হাওয়া খাওয়া চলবে না। ভাঙা জানালায় বাবা আরও তিনটে করে শিক লাগিয়ে দিলেন, জেলখানার শিকের মত, লম্বা আর পাথারি। ঘরগুলো অন্ধকার হয়ে রইল। দিনের বেলাতেও আলো জ্বেলে লেখাপড়া খাওয়াদাওয়া করতে হয়। স্যাঁতসেঁতে ঘরে নিজেদের ইদূঁরের মত মনে হতে থাকে। রাজিয়া বেগমের সঙ্গে বাবাকে রিক্সায় দেখার পর থেকে মা শয্যা নিয়েছেন। রাঁধাবাড়া, নাওয়া খাওয়া ছেড়ে, শুকনো মুখে সারাদিন শুয়ে থাকেন। বাবার ঘর থেকে নিজের কাপড় চোপড় বিছানা বালিশ সরিয়ে অন্য ঘরে ঢুকেছেন। মা’কে দেখলে যে কেউ মনে করবে কঠিন এক ব্যারাম হয়েছে মা’র। চুলে তেল পড়ে না, চিরুনি পড়ে না। ঘামাচিতে গা ভরে গেছে, ঘামে শরীরের কাপড় লেপ্টে থাকে শরীরে। সারাদিন রা শব্দ নেই, বাবার বাড়ি ফেরার শব্দ শুনলে কেবল ছুটে এসে চিকন গলায় বিলাপ শুরু করেন –ওই তো, বেটির সাথে সারাদিন কাটাইয়া আইলা। বুঝি, এত বড় বাড়ি কিনছ, ওই বেটিরে বিয়া কইরা এই বাড়িতে তুলবা বইলা। মা’র বিলাপের কোনও জবাব কখনও দেন না বাবা। যেন কারও কোনও কথা তাঁর কানে ঢুকছে না। যেন কেউ তাঁকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছে না। যেন যে শব্দগুলো ভাসছে ঘরে, সেটি কিছুই না, বেড়ালের মিঁয়াও মিঁয়াও বা চুলোয় খড়ি পোড়ার শব্দ। মা যে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, অনর্গল চেচিয়ে যাচ্ছেন, বাবা তাঁর উপস্থিতি বা স্বর যেন টের পাচ্ছেন না এমন ঢঙে হাঁটাহাঁটি করেন উঠোনে ঘরে, বাচ্চাদের চাকরবাকরদের কুকুরবেড়ালের খবরটবর নেন, নানির বাড়ির পেছনের বস্তি থেকে নিয়ে আসা নতুন কাজের মেয়ে মণিকে ডাকেন ভাত দিতে, ভাত খেয়ে ঢেকুর তুলে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সর্ষের তেল মাখা চুল আঁচড়ে চলে যান বাইরে। মা পেছনে দাঁড়িয়ে বাবার গুষ্ঠি তুলে গাল পাড়েন–আমার বাবা ডাক্তারি পড়াইছে বইলা ডাক্তার হইছস, নাইলে তো চাষার ছেড়া চাষাই থাকতি। টেকার লুভে বিয়া করছিলি আমারে, এহন নিজের টেকা