মা’কে খুব কমই দেখেছি আমাদের সঙ্গে বসে ভাত খেতে। বাড়ির সবাইকে খাইয়ে বেলা চলে গেলে নিজে খান। আমরা খেয়ে যে খাবার বাঁচে, তা। মুরগি রান্না হলে মা’র ভাগে গলার হাড়, বুকের হাড়, পিঠের হাড়। মা খেয়ে যা থাকে, খায় চাকর চাকরানি। না থাকলে ক্ষতি নেই, ওদের খাবার আলাদা রাঁধা হয়, মাছ মাংস আমাদের, কাজের মেয়েদের জন্য পাইন্যা ডাল, শুঁটকি। এরকমই নিয়ম, এ নিয়ম নানির বাড়িতেও ছিল, নানিও খেতেন নানাকে খাইয়ে, ছেলেদের খাইয়ে, বাচ্চাকাচ্চা খাইয়ে, পরে। সবার খাওয়া হলে কাজের লোক খেত। পান্তা ভাত, নুন মরিচ দিয়ে, নয়ত নষ্ট হয়ে যাওয়া ডাল মেখে। আমরা যখন খাই, মা কখনও কোনও কাজের লোককে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেন না। ওরা নাকি আমাদের খাবারে নজর দেয়। সাত বছর বয়সে একদিন পেট কামড়াচ্ছে রাতে, মা বললেন ফুলবাহারিডারে দেখছিলাম হাঁ কইরা দেখতাছে তুই যহন খাস। ওর নজর লাগছে।
মা নানির ঘর থেকে তিনটে পান এনে সর্ষের তেল মেখে পানগুলো এক এক করে আমার সারা পেটে ছুঁইয়ে আনছিলেন বলতে বলতে উইঠ্যা আয় বাও বাতাসের নজর, ফুলবাহারির নজর, এসব। পেট থেকে নজর তুলে নিয়ে পান তিনটে একটি কাঠিতে গেঁথে কুপির আগুনে পুড়িয়ে মা বললেন–নজর পুড়লাম।
নজর কি মা? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।
মা বললেন কারও কারও চোক্কের নজর লাগে খুব। একবার ভিক্ষা করতে আইছে এক বেডি, উঠানের তাজা পাইব্যা গাছটার দিকে চাইয়া কইল আহা, কত পাইব্যা ধরছে! বেডি দরজার আড়াল হইতেই গাছটা পইড়া গেল। গুঁড়ি ধইরা কেউ লাড়ে নাই, ঝড় নাই, বাতাস নাই–চোক্কের সামনে আপনাসে পইড়া গেল গাছ।
ফুলবাহারি তর খাওনের দিকে বুধয় চাইয়া কইছে আহা কি মজার খাওন! নজর পোড়ানোর পর ব্যথা কমে গেল। অবশ্য বাবা ওষুধ দিয়েছিলেন খেতে। মা বললেন নজরডা পুড়াইছি বইলা পেডের বেদনা ভালা হইছে।
আকুয়া পাড়ায় তিন বেটির চোখ ছিল নজরের, মা বলেন। তারা যেদিকে তাকাত, গাছের দিকে হলে গাছ মরত, মানুষ হলে সে মানষ এমন অসুখে পড়ত যে শ্বাস ওঠে প্রায়। তিন বেটিকে দেখলে পাড়ার মানুষ দুয়োর এঁটে বসত। নানির বাড়ির দুটো গাছ প্রায় মরতে বসেছিল, তিন বেটির একজনের কাছ থেকে পানি পড়া এনে গাছের গোড়ায় ঢেলে বাঁচানো হয়েছিল গাছ। নানির মা, মা’দের দাদি, কুকুরে কামড়ালে পেটে কুকুরের বাচ্চা যেন না হয় সে ওষুধ দিতেন। সবরি কলার ভেতর, কেউ জানত না কি দিয়ে বানানো, গোল মরিচের মত দেখতে জিনিসটি পুরে খাইয়ে দেওয়া হত। সেটিই ওষুধ। ওষুধ খাওয়ার পর নিষেধের মধ্যে একটিই ছিল, কোনও সবরি কলা খাওয়া চলবে না তিন মাস। ওষুধে কাজ হত, মানুষের পেট থেকে আর কুকুরের বাচ্চা বেরোত না। পাড়ার কেউ কেউ নানির মা’র কাছ থেকে কলার ওষুধ নিয়ে যেত। বেশির ভাগ লোক খাওয়াত সাত পুকুরের পানি। সাতটি পুকুর থেকে এক আঁজলা করে পানি তুলে খাইয়ে দিলেই কুকুর কামড়ানো রোগীর জলাতঙ্ক রোগ সারত, মানুষের পেটে মানুষের বাচ্চাই ধরত, কুকুরের নয়। আমাকে কুকুর কামড়ানোর পর সাত পুকুরের পানিও খাওয়ানো হয়নি, মা’দের দাদি তখন মরে সারা, কলার ওষুধও হয়নি। পেটে ইনজেকশন দিচ্ছেন বাবা, দিলে কি হবে, শরাফ মামা হাততালি দিয়ে বলতেন পেটে তর কুত্তার বাচ্চা। হাঃ হাঃ। আমার ভয় হত খুব। পেট টিপে টিপে দেখতাম কুকুরের বাচ্চা সত্যিই বড় হচ্ছে কি না ভেতরে। বরইএর বিচি গিলে ফেললে শরাফ মামা বলতেন মাথা দিয়া বরই গাছ গজাইব। আমি ঠিক ঠিকই মাথায় হাত দিয়ে পরখ করতাম, বরই গাছের কোনও চারা চাঁদি ফেটে উঠছে কি না। মাথায় মাথায় ঠুস লাগলে বলা হত, শিং গজাবে, আরেকটি ঠুস ইচ্ছে করেই দিতে হত, দুটো হলে নাকি আর গজায় না। ফকরুল মামার মাথার সঙ্গে কলপাড়ে এক ঠুস লাগার পর আমি আর দ্বিতীয় ঠুসে যাইনি, এই মামাটিকে আমার বরাবরই বড় দূরের মনে হত, ঈশ্বর গঞ্জ থেকে আমরা সপরিবার ফিরে এলে ফকরুল মামাকে বড় মামা ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন লেখাপড়া করাতে। ঢাকা থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ফিরেছেন, বড় মামা করাচি থেকে ফিরলে আবার গিয়ে কলেজে ভর্তি হবেন। ঢাকায় থাকা মানুষকে আমার আকাশের তারা বলে মনে হত, চাইলেই ছোঁয়া যায় না। ফকরুল মামা নিজেও ঠিক বোঝেননি টিউবয়েলের হাতলে নয়, লেগেছিল আমার মাথার সঙ্গে তাঁর মাথা। তিনি কলপাড়ে বসে উঁবু হয়ে মাথায় বাংলা সাবান মাখছিলেন, চোখ বুজে রেখেছিলেন সাবানের ফেনা যখন মাথা গড়িয়ে মুখে নামছিল, আর আমি গিয়েছিলাম বদনি ভরে পানি আনতে। শিং গজায় কি না দেখতে আয়না হাতে বসেছিলাম পুরো বিকেল, গজায়নি। শরাফ মামাকে জানালে প্রায় প্রতিদিনই বলতে লাগলেন আজ না হোক কাল গজাবে। শরাফ মামা যাই বলুন, শিং আমার সে যাত্রা গজায়নি।
ফকরুল মামা গোসল টোসল করে ধোয়া লুঙ্গি আর শার্ট পরে বিকেলে দাঁড়িয়েছিলেন কুয়োর পাড়ে নানা এক পুঞ্জি রেখেছিলেন পাটশুলার, তার পাশে। পুঞ্জির দিকে এমন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকার কারণ কি মা জিজ্ঞেস করতে ফকরুল মামা বলেছিলেন–না, ভাবতাছিলাম, যদি আগুন ধরাইয়া দেওন যাইত পুঞ্জিত, দেখতাম কেমনে কইরা পুড়ে। মা নানিকে গলা ছেড়ে ডেকে বললেন ফকরুলের কান্ড দেইখা যান মা, কী কয়। পুঞ্জিত আগুন লাগাইতে চায়। নানি চা বানাচ্ছিলেন, শুনে হাসলেন। নানি বিকেলে বড়দের জন্য চা বানান, মিটসেফের ভেতর থেকে কৌটো খুলে টোস্ট বিস্কুট দেন চা’র সঙ্গে। সন্ধের মুখে পুঞ্জিতে ঠিকই আগুন লাগল। খোঁজ পড়ল ফকরুল মামার। তিনি নেই বাড়িতে, চা বিস্কুট খেয়ে হাঁটতে গেছেন রাস্তায়। কার দোষ, সব্বনাশটি কে করেছে এসব প্রশ্নে না গিয়ে নানি কুয়ো থেকে বালতি বালতি পানি তুলে আগুনে ঢাললেন, ফটফট করে ফুটতে ফুটতে আগুন নারকেল গাছের চুড়ো অবদি উঠল। নানির পানিতে কোনও কাজ হল না। কুয়োর পাড়ের গাছগাছালি পুড়ে গেল। ফকরুল মামা ফিরে এসে পুঞ্জিতে আগুন লাগার কাহিনী শুনে মুষড়ে পড়লেন–হায় রে, এত ইচ্ছা আছিল পুড়লে কেরম লাগে, দেখি। আর আমিই কি না দেখতে পারলাম না। দোষ পড়ল গিয়ে ফুলবাহারির ওপর। টুটু মামা সাক্ষী দিলেন তিনি দেখেছেন ফুলবাহারি কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছে। বিড়ি খেয়ে নিশ্চয় সে পুঞ্জির ওপর ফেলেছে বিড়ির পুটকি। ফুলবাহারিকে কিলিয়ে ভর্তা বানাবেন বললেন মা, তাকে বলে দেওয়া হল এ বাড়িতে আর বিড়ি খাওয়া চলবে না তার। ফুলবাহারি বিড়ি খাওয়া ধরেছিল আবার, খেত পাকঘরের বারান্দায় বসে। মুখ ভর্তি বসন্তের দাগঅলা সেই কালো মৈসাপের মত দেখতে ফুলবাহারির জন্য, যার কাঁধে বাড়ির সব অপকর্মের দোষ পড়ত, হঠাৎ আমার মায়া হতে থাকে পাজামা পরার বয়সে পৌঁছে, এক সকালে ঘুম থেকে উঠে অবকাশের ভেতর বারান্দায় কয়লা গুঁড়ো করে দাঁত মাজতে মাজতে। ফুলবাহারি শীতের সকালে ভাপা পিঠা বানাত, সে কি স্বাদ পিঠার, ধবল পিঠার মাঝখানে খেঁজুরের গুড়, ঢাকা থাকত পাতলা কাপড়ে, ভেতর থেকে গরম ধোঁয়া উঠত। নানি বাড়ি থেকে চলে আসার পর শীত আসে, শীত যায়, ভাপা পিঠা আর খাওয়া হয় না। দাঁত মাজতে মাজতে আমার বড় ইচ্ছে করে শীতের এই কুয়াশা-ডোবা সকালে একখানা ভাপা পিঠা পেতে। শীতের সকাল যদি খেজুরের রস, ভাপা পিঠা আর কোঁচড় ভরা শিউলি ফুল ছাড়া কাটে, তবে আর এ কেমন শীত! মা আমাদের গায়ে চাদর পেঁচিয়ে চাদরের দু’কোণা ঘাড়ের পেছনে নিয়ে গিঁট দিয়ে দিতেন। কুয়াশা কেটে সূর্য উঠলে রোদ পোহাতে বের হতাম মাঠে। এ বাড়িতে শীতের রোদও পোহানো হয় না। হঠাৎ করে যেন বড় নাগরিক জীবনে চলে এসেছি। মোটা উলের সোয়েটার পরে ঘরে বসে থেকে, রুটি ডিম খেয়ে শীতের সকাল পার করতে হয়।
মণি বদনি ভরে পানি রেখে যায় আমার সামনে, যেন দাঁত মাজা শেষ হলে মুখ ধুই। ওকে বলিনি পানি দিতে, তবু। ফুলবাহারিও এমন করত, হেঁচকি উঠছে, নিঃশব্দে এক গ্লাস পানি দিয়ে যেত হাতে। হোঁচট খেয়ে পড়লাম, দৌড়ে এসে কোলে তুলে হাঁটুতে বা পায়ের নখে হাত বুলিয়ে দিত। মণি দেখতে ফুলবাহারির মত নয়, কিন্তু ওর মতই নিঃশব্দে কাজ করে, চাওয়ার আগেই হাতের কাছে কাংখিত জিনিস রেখে যায়। ওরা পারে কি করে এত, ভাবি। কাকডাকা ভোরে উঠে উঠোন ঝাঁট দেয় ওরা। নাস্তা তৈরি করে টেবিলে দিয়ে যায়। নাস্তা খাওয়া শেষ হলে থাল বাসন নিয়ে কলপাড়ে যায় ধুতে। ইস্কুলের পোশাক পরা হলে এগিয়ে এসে জুতো পরিয়ে দেয় পায়ে। জামা কাপড় ফেলে রাখি চেয়ারে টেবিলে, গুছিয়ে রাখে আলনায়। ময়লা হলে ধুয়ে দেয়। রাতে বিছানাগুলো শলার ঝাড়ুতে ঝেড়ে মশারি টাঙিয়ে গুঁজে দেয়। আমরা গুছোনো বিছানায় ঘুমোতে যাই। ঘুমিয়ে যাওয়ার অনেক পরে ওরা ঘুমোয়। রাতের বাসন কোসন মেজে, আমাদের এঁটো খাবারগুলো খেয়ে, তারপর। ঘুমোয় মেঝেয়। মশা কামড়ায় ওদের সারারাত, ওদের জন্য কোনও বিছানা বা মশারি নেই। ওদের মুখে মশার কামড়গুলো হামের ফুসকুরির মত লাগে দেখতে। শীতের রাতে লেপ নেই তোষক নেই, ছেঁড়া কাঁথা সম্বল। এরকমই নিয়ম, এই নিয়মে আমাকেও অভ্যস্ত হতে হয়, আমাকেও ওদের চড় থাপড় দিতে হয়, কিল গুঁতো দিতে হয়। রিক্সায় ওদের কোথাও নিলে পাদানিতে বসিয়ে নিই। জায়গা থাকলেও আমাদের পাশে বসার নিয়ম নেই ওদের। ওরা পরনের কাপড় জুতো পায় বছরে একবার, ছোট ঈদে। বাবা ওদের জন্য বাজারের সবচেয়ে কমদামি কাপড় কিনে আনেন। সবচেয়ে সস্তা সাবান পায় ওরা গায়ে মাখার। চুলে মাখার তেল পায় সস্তা সয়াবিন, নারকেল তেল দেওয়া হয় না। নারকেল তেল কেবল আমাদের চুলের জন্য। রাতে পড়তে বসি যখন, পায়ের কাছে বসে মশা তাড়ায় ওরা, হাতপাখায় বাতাস করে। পানি চাইলে দৌড়ে ওরা গ্লাস ভরে পানি এনে হাতে দেয়। আমাদের কারও জগ থেকে গ্লাসে ঢেলে পানি খাবার অভ্যেস হয়নি। হাতের কাছে পানি পেয়ে অভ্যেস। হাতের কাছে যা চাই, তাই পাই। আর ওদের অভ্যেস আমরা যা ইচ্ছে করি, তা পুরণ করার। ওরা জন্ম নিয়েছে কেবল মনিবের সেবা করার উদ্দেশে। ওদের মৃত্যু হবে মনিবের সেবা করতে করতে। ওদের অসুখ হলে ওদের ভৎসর্না করা হয়, ওরা মরে গেলে ওদের দুর্ভাগ্যকে দায়ি করা হয়। ওরা নোংরা, আমরা পরিষ্কার। ওরা নিচুতলার, আমরা ওপরতলার। ওরা ছোটলোক। আমরা বড়লোক। বই পড়ে বাংলা ইংরেজি গদ্য পদ্য শিখেছি। ব্যাকরণ শিখেছি। ভুগোল ইতিহাস শিখেছি। অঙ্ক বিজ্ঞান শিখেছি। সংসার আমাকে শিখিয়েছে নিচু জাত, উঁচু জাত, ছোটলোকি, বড়লোকি। বাল্যশিক্ষার অহংকার করিও না, দরিদ্রকে ঘৃণা করিও না, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই, সংসারে এসে অক্ষরবাক্য সমেত হোঁচট খেয়ে পড়ে। এ বড় পুরোনো নিয়ম, শোষণ, দরিদ্রের ওপর ধনীর। আমিও এই অদৃশ্য শেকলে অলক্ষে জড়িয়ে পড়ি।
মুখ ধুয়ে ঘরে আসার পর এক কাপ চা দিয়ে যায় মণি। সকালে চা খাওয়ার অভ্যেস হয়েছে সেই নানির বাড়িতেই। সকালে দু’রকম নাস্তা হত। প্রথম ছোট নাস্তা সকাল সাতটার দিকে, দশটার দিকে বড় নাস্তা। ছোট নাস্তা চা মুড়ি। চায়ের কাপে মুড়ি ফেলে চামচ দিয়ে তুলে তুলে খেতে হত। বড় নাস্তা পাতলা আটার রুটি সঙ্গে আগের রাতের মাংস, ভাজি, না হলে ডিম ভাজা, এসব।
চায়ে চুমুক দিচ্ছি, রান্নাঘর থেকে শব্দ আসে হুড়োহুড়ির, মা চড় কষাচ্ছে, লাথি বসাচ্ছে মণির গায়ে। ওর পরনে আমার পুরোনো জামাখানা একটানে মা ছিঁড়ে ফেলেন আরও। মণির দোষ, সে পাতিল থেকে মাংস চুরি করে খেয়েছে। মা’র কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার পরও ও বলছে–মাংস বিলাইয়ে খাইছে।
মা দাঁত খিঁচে বলেন–বিলাইয়ে না, তুই খাইছস। তুই একটা আস্তা চুরনি। এত খাওয়াই, তারপরও তর পেট ভরে না ছেড়ি! মাংস কি তরে দেইনা! কত বড় সাহস তর যে পাতিলে হাত দেস!
মণি মার খেয়েও স্বীকার করে না সে চুরি করেছে। মা ঝাঁটা হাতে নিয়ে ওর পিঠে ঝপাং ঝপাং মেরে বলেন–স্বীকার কর এহনও যে তুই খাইছস।
মা’র শাড়ি খসে পড়ে মাথা থেকে, বুক থেকে। আব্রুর দিকে মা’র তখন নজর নেই। মরিয়া হয়ে ওঠেন মণির স্বীকারোক্তি শোনার।
মণি অনড় দাঁড়িয়ে মার খাচ্ছিল। জল পড়ছিল চোখ থেকে গাল গড়িয়ে বুকে। দৃশ্যটির মধ্যে আমি নাক গলিয়ে বলি–কইয়া ফালা, আর খাইতাম না।
মণি কাতর গলায় বলে–আর খাইতাম না।
মা থামেন। ধমকে দূরে সরতে বলেন আমাকে।
এসব লাথিঝাঁটা মণির কাছে ডাল ভাত।
পরদিনই মণি তার জীবনের ঝুড়ি খুলে বসে মা’র সামনে।
— আমি তহন কাঁইচলা আবু। বুনি খাই। নুনি, চিনি ছুডু ছুডু। বাবা আমগোর বেবাকতারে ফালাইয়া গেল গা। রাজমিস্তরির কাম করতে বাবা জামালপুর গেল, আর ফিইরা আহে নাই। মায়ে খবর পায়, বাবা একটা বিয়া করছে হেইনু। বিয়া করছে পুলার লাইগ্যা। একটা পুলার শখ আছিল বাবার।
মা খানিক ঝিমোন, খানিক শোনেন। মা’র চুলের গোঁড়া থেকে লিক এনে, চামড়ায় ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা ঢেলা, আধাগুইড়া এনে বাঁ হাতের নখে রেখে ডান হাতের নখে চেপে ফোটায় মণি আর বলে–তিন মাইয়া জন্মাইছে দেইখা বাবা রাগে আর থাহে নাই। মায়ের যদি একটা পুলা অইত, বাবা যাইত না। পুলা কেমনে অইয়াইব মায়ে। আল্লাহ মায়েরে পুলা দেয় নাই। একচোখ্যা আল্লাহ আমার মা’ডার দিকে চাইল না। আল্লাহরে আর দুষ দেই ক্যা। আমার বাপটা বড় পাষাণ, পাষাণ না হইলে এইভাবে ফালাইয়া যায়! আইজকা বাপ থাকলে মানষের বাড়ি বন্দিগিরি কইরা খাইতে অইত না! বাপের ত ক্ষেমতা আছিল আমগোরে ভাত কাপড় দেওনের।
বড় শ্বাস ফেলে ডান বাহুতে চোখের পানি মুছে মণি আবার শুরু করে–আমার মা পড়ে আমার চাচাগোর কাছে গেল, মামুগোর কাছে গেল। দূর দূর কইরা বেবাকে খেদাইল মায়েরে। তাগো চুলায় বাত ফুটতাছিল টগবগ কইরা। কি সোন্দর সুবাস, অহনও হেই সুৃবাস নাহো লাইগ্যা রইছে। আমগোরে কেউ একবেলা বাত দেয় নাই। ক্ষিদায় আমি কান্দি, নুনি কান্দো, চিনি কান্দো। মায়ে পুস্কুনি থেইকা শাপলা তুইলা সিদ্ধ কইরা খাইতে দিত। বাত নাই। বাড়ি বাড়ি ঘুইরা মায়ে বাতের মাড় মাইগ্যা আনে। হুগাইয়া আমগোর শইলো হাড্ডি ছাড়া কিছু নাই। খাওন না পাইয়া নুনিডা ব্যারামে পড়ল। শিং মাছের তরহারি দিয়া বাত খাইবার চায়। কেডা দিব! মা আল্লাহর কাছে কত কানল, এক চোখ্যা আল্লাহ ফিইরা চাইল না। নুনিডা মইরা গেল। কব্বরো নুনিডারে মাডি দিবার গিয়া মায়ের যে কী কান্দন। হেষে মা কাম খুঁজল মাইনষের বাড়ি। বিবিসাইবরা ছেড়ি উলা মায়েরে কামো নেয় না। মায়ে হেল্লিগা আমারে আর চিনিরেও কামে দিল। বান্দিগিরিই আছিল আমগোর কপালে। চিনি যেই বাড়িত কাম করত, হেই বাড়ির সাইবের খাইসলত আছিল খারাপ। চিনির বুহো বুলে আত দিত। বিবিসাইব দেইখ্যা চিনিরে খেদাইয়া দিছে। মা কত বাড়িত ঘুরল চিনিরে কামে দিবার। বিবিসাইবরা হেরে রাহে না