ছোটদা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর বাড়িতে আবদার করলেন আনন্দ মোহন কলেজে বেবি নাম, নেত্রকোণা বাড়ি, তাঁর এক সহপাঠী মেয়েকে এ বাড়িতে থাকতে দেওয়া হোক, যেহেতু বেবির থাকার জন্য কোনও ভাল জায়গা নেই। ছোটদার আবদার মঞ্জুর হল। বেবি সুটকেস নিয়ে উঠল অবকাশে, আমার বিছানায় শোবার জায়গা হল তার। টেবিল চেয়ার দেওয়া হল তাকে পড়াশুনা করার। বেবি, দেখতে লম্বা, শ্যামলা, চমৎকার মায়াবি চোখ, দু’দিনেই খাতির জমিয়ে ফেলল বাড়ির সবার সঙ্গে। আত্মীয় স্বজনের বাইরে কারও মুখ দেখে ঘুমোতে যাওয়ার, বা ঘুম থেকে ওঠার আমার সুযোগ ঘটেনি এর আগে। বাইরের জগত থেকে আমাদের সংসারে একটি জলজ্যান্ত মানুষের প্রবেশ ঢেউ তোলে আমার নিস্তরঙ্গ জীবনে। বেবি যখন গল্প করে তার বোন মঞ্জুরি কী করে গাছের মগডাল থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিল, সে ই বা কী করে একা একা নেত্রকোণা থেকে চলে এল ময়মনসিংহে লেখাপড়া করতে, কী করে তার পাগল এক ভাই কংসের জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকত সারাদিন, একদিন তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি–কংস হয়ে দাঁড়ায় আমারই নদী, ব্রহ্মপুত্র যেমন। মঞ্জুরিকে মনে হয় আমার জন্ম জন্ম চেনা। মা’র সঙ্গে চুলোর পাড়ে বসে বেবি গল্প করে কী করে তার পাগল ভাইটিকে আর খুঁজে না পাওয়ার পর মা তার নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে বিছানায় পড়ল, শুকিয়ে পাতাকাঠির মত হয়ে বেবিকে বলল তাকে পুকুরে নিয়ে স্নান করিয়ে আনতে, বেবি তাই করল, পুকুর থেকে নেয়ে এসে শাদা একটি শাড়ি পরে বেবির মা শুল, সেই শোয়াই তার শেষ শোয়া। মা গল্প শুনে আহা আহা করে বলেন তুমি হইলা আমার মেয়ে। আমার এখন তিন মেয়ে।
বাবা বাড়ি ফিরে বেবিকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, পড়াশুনা কেমন চলছে? ফার্স্ট ডিভিশন পাইবা ত!
বেবি মাথা নুয়ে বলে–জী খালুজান, আশা রাখি।
সাড়ে তিন মাস পর বেবিকে অবশ্য পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে হল। কারণ মা হঠাৎ এক দুপুরে আবিষ্কার করেছিলেন ছোটদা বিছানায় শুয়ে আছেন, খাটের কিনারে বসে ছোটদার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বেবি। মা ফেটে পড়লেন বেবি, এত শয়তানি তুমার মনে মনে ছিল! আমারে বুঝাইছ তুমাদের ভাই বোনের সম্পর্ক। দুধ কলা দিয়া কালসাপ পুষতাছি আমি। আমার ছেলের সাথে ফস্টি নস্টি করার উদ্দেশ্য তুমার! এত বড় সাহস!
বেবি কেঁদে পড়ল মা’র পায়ে। ছোটদার মাথা ধরেছিল বলে বেবি কেবল স্পর্শ করেছিল কপালে, এই যা। আর কোনওদিন এমন ভুল হবে না বলে সে জোড় হাতে ক্ষমা চাইল। মা ক্ষমা করার মানুষ নন। বলে দেন, মন যখন ভাঙে মা’র, একেবারেই ভাঙে। বেবির চলে যাওয়াতে বাড়িতে সবচেয়ে যে মানুষটি নির্বিকার ছিলেন, তিনি ছোটদা।
ছোটদার পরীক্ষা সামনে, আইএসসি, যে পরীক্ষায় পাশ করে ভর্তি হবেন তিনি মেডিকেল কলেজে। বাবার অনেকদিনের স্বপ্ন, তাঁর একটি ছেলে ডাক্তার হবে। সেই ছোটদা হঠাৎ বাড়ি ফেরেন না। একদিন দু’দিন, সপ্তাহ চলে যায়, তাঁর টিকিটি নেই। বাবা উন্মাদ হয়ে সারা শহরে খোঁজ করেন। বাবা তখন টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন, ভোররাতে বাসে করে টাঙ্গাইল যান চাকরি করতে, অবশ্য যত না চাকরি করতে চাকরি বাঁচাতেই বেশি, রাতে বাড়ি ফিরে আসেন। আপিসে ছুটির দরখাস্ত ফেলে তিনি ছেলের খোঁজ করেন। ময়মনসিংহ ছোট শহর, ছেলে মেলে, তবে ছেলে আর সেই আগের ছেলে নেই। ছেলে বিবাহিত। কি ঘটনা, ক্লাসের এক হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে তাকে বিয়ে অবদি করে ফেলেছেন গোপনে, এক বন্ধুকে উকিল বাপ বানিয়ে। এখন বউ নিয়ে সেই বন্ধুর বাড়িতে আছেন।
বাবা কপালের শিরা চেপে বলেন–সব্বনাশ হইয়া গেছে। আমার সব আশা ভরসা শেষ। ছেলে আমার এ কি কান্ড করল! কে তারে এইসব করতে বুদ্ধি দিল। পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক মাস আছে। ছেলে আমার ডাক্তারি পড়বে। ছেলে আমার মানুষের মত মানুষ হবে। ছেলে এ কি পাগলামি করল! ওর ভবিষ্যত নষ্ট হইয়া গেল! কত কইছি বন্ধুদের সাথে মিশবি না। মিশছে। কত বুঝাইছি লেখাপড়া কইরা মানুষ হইতে!
বাবার মাথায় লোটা লোটা ঠান্ডা পানি ঢালেন মা। বাবার রক্তচাপ বাড়ছে। মা টের পান না, বাবার হৃদপিন্ডের ওপর কালো এক থাবা বসিয়ে যায় ফুঁসে ওঠা রক্তচাপ।
মা ফুঁপিয়ে কাদেন আর বলেন – আমার হীরার টুকরা ছেলে। কই আছে, কী খায় কেডা জানে! বদমাইশেরা ওরে নিশ্চয় তাবিজ করছে! এইডা কি তার বিয়ার বয়স হইল যে বিয়া করে। আল্লাহগো আমার ছেলেরে আমার কাছে ফিরাইয়া দাও।
চোখের পানি মুছে বাবার ঝিম ধরে থাকাকে ঠেলে ভাঙেন মা, নাকি গুজব?
বাবা ডানে বামে মাথা নাড়েন।
গুজব নয়। ঘটনা সত্য। মেয়ের নাম গীতা মিত্র। হিন্দু।
চুলোয় হাঁড়ি চড়ে না। শুয়ে থেকে থেকে সারাদিন কড়িকাঠ গুনি। দাদা ঢাকা চলে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। আমার বড় একা লাগে। দাদা নেই, ছোটদাও যদি আর এ বাড়িতে না থাকেন, বাড়িটি বিষম খাঁ খাঁ করবে। মণি ঝিমোয় বারান্দায়, রোদ সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে নিচে, উঠোনে। রোদের গায়ে কারও পা পড়ে না। রোদে দাঁড় করিয়ে মা তাঁর ছেলেমেয়েদের গা মেজে গোসল করিয়ে সারা গায়ে মেখে দিতেন সর্ষের তেল, মেখে দু’কানের ছিদ্রে দু’ফোঁটা করে তেল আর নাভির ছিদ্রে একফোঁটা। বড় হয়ে যাওয়া ছোটদাকেও তাই করতেন। ছোটদা কপালের ওপর ঢেউ করে চুল আঁচড়াতেন, চোখা জুতো পরতেন, পাশের বাড়ির ডলি পালের দিকে চেয়ে দুষ্টু দুষ্টু হাসতেন আর বাড়ির ভেতর ঢুকেই তিনি মা’র তোতলা শিশু, মুখে লোকমা তুলে খাওয়াতেন তাঁকে মা।
বাবার শিয়রের কাছে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বলেন–একটা হিন্দু মেয়েরে, কী কইরা একটা হিন্দু মেয়েরে বিয়া করল কামাল! মেয়েটা কয়দিন আইছে এই বাড়িতে। ওর আচার ব্যবহার আমার ভালা লাগে নাই। আইসা নোমানরে সিনেমায় লইয়া যাইতে চায়। নোমান না যাইতে চাইলে কামালরে সাধে। ছেড়াগোর পিছে পিছে ঘুরার স্বভাব। বড় চতুর মেয়ে, আমার শাদাসিধা ছেলেটারে পটাইছে। কামালের কয়দিন ধইরা দেখতাছিলাম বড় উড়া উড়া মন। ওই মেয়ের পাল্লায় পড়ছে এইটা যদি জানতাম আগে! তাইলে ওরে আমি সাবধান কইরা দিতাম।
খাটের রেলিংএ কুনই রেখে গালে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা বলেন–আল্লাহই পারেন ছেলের মন ফিরাইতে। আল্লাগো ছেলেরে আমার ফিরাইয়া আনো। হিন্দু বাড়িত বিয়া হইত ক্যা আমার ছেলের! আমার হীরার টুকরা ছেলের লাইগা কত বড় বড় ঘরের মেয়ের বাপেরা ভিড় করত অইলে! কত জাঁক জমক কইরা বউ ঘরে আনতাম! লেখাপড়া শেষ কইরা চাকরি বাকরি করতে থাকব, তারপরে না বিয়া! মন ঠিকই ফিরব আমার ছেলের, ফিইরা আইব। ভুল ত মাইনষেই করে!
গীতা মিত্র বিদ্যাময়ীতে পড়ত, মুখখানা গোল, তেঁতুলের গুলির মত, মায়া মায়া কালো মুখে হরিণের চোখ। ইস্কুলে নানা পরবে অনুষ্ঠানে নাচত মেয়ে। ছোটদার সঙ্গে তাঁর পরিচয় আনন্দ মোহন কলেজে পড়তে গিয়ে। আবার তাঁর খোঁড়া মাসির কারণে, খোঁড়া মাসি পড়াত আমাদের, সে সূত্রে এ বাড়িতেও ক’দিন এসেছে সে, এসে আমাদের দু’বোনের সঙ্গে রসিয়ে গল্প করেছে, বলেছে আমাদের সে লুকিয়ে সিনেমায় নিয়ে যাবে, নাচ শেখাবে, গাছ থেকে আতাফল পাড়তে গিয়ে তরতর করে গাছের মগডালে গিয়ে বসেছে, অমন এক দস্যি মেয়ে দেখে আমরা তখন খুশিতে বাঁচি না। বেবি ছিল অন্যরকম, সেলাই জানা রান্না জানা ঘরকুনো মেয়ে। বেবির দাপিয়ে বেড়ানোর স্বভাব ছিল না, গীতার যেমন। দস্যি মেয়েটি খুব অল্পতেই আমাদের হৃদয় দখল করে ফেলে। অবশ্য হৃদয়ের কপাট তখন এমন খোলা যে কেউ পা রাখলেই দখল হয়ে যায়। ঈদের জামা বানাতে শাদা সার্টিনের জামার কাপড় কিনে আনা হল, গীতা বাড়ি এসে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল কাপড়, বলল আমি খুব ভাল শিলাই জানি, আমি শিলাইয়া দিব। ব্যস, বাড়িতে দিনে দু’বার করে আসতে লাগল গজফিতায় গায়ের মাপ নিতে আমাদের। তিন দিনে সেলাই হবে বলেছিল, লাগিয়েছে তের দিন। তাও জামা জোটে ঈদের সকালে। পরতে গিয়ে দেখি বুক এমন আঁটো যে প্রায় ফেটে যায়, ঝুল এত বড় যে মনে হয় পীরবাড়ির আলখাল্লা। এমন অদ্ভুত জামা এর আগে কখনও পরিনি। ঈদটিও গিয়েছিল মাঠে মারা। ঈদের সকালে বাড়ি এসে জামা পরিয়ে দিয়ে সে হাততালি দিয়ে ইঁদুর-দেতো হাসি দিয়ে বলল–ইস কি যে সুন্দর লাগতাছে তুমারে! দারুন! দারুন।
বলল–চল তুমারে দারুন এক জায়গায় নিয়া যাব বেড়াইতে।
দারুন এক জায়গায় যাওয়ার জন্য আমার তর সয় না। রিক্সা করে গীতার সঙ্গে দিব্যি রওনা হয়ে গেলাম। উঠলাম গিয়ে সাহেব কোয়ার্টারে জজের বাড়িতে। বড়লোকের বাড়ি। রুহি নামের এক মেয়ে গীতার বান্ধবী, তাকে নিয়ে তার বেরোতে হবে কোথাও। রুহি, চ্যাপ্টা দেখতে মেয়ে, বেজায় ফর্সা, তার মা’কে পটাতে লাগল বাইরে বেরোবে বলে। মা’র পটতে যত দেরি হয় গীতা আর রুহি তত ফিসফিস কথা বলে নিজেদের মধ্যে, আর আমি বসে থাকি খেলনার মত সোফায়। ঘন্টা দুই পর রুহির মা পটল, রুহি মুখে লাল পাউডারের আস্তর মেখে চোখে কাজল ফাজল লাগিয়ে বের হল, তিনজন এক রিক্সায় বসে রওনা হলাম সেই দারুন জায়গায়। আমার তখন দারুন জায়গাটি ঠিক কোথায়, জানা হয়নি। ওরা রিক্সায় বসে খিলখিল হাসে, আর আমি কাঠের ঘোড়ার মত বসে থাকি গীতার কোলে। গুলকিবাড়ির এক বাড়িতে রিক্সা থামে, বাড়ির এক শিয়াল-মুখো লোক আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে গেটে তালা দিয়ে দেয়। লোকটিকে আমি কখনও দেখিনি এর আগে। নিঝুম একটি বাড়ি, বড় মাঠঅলা। ঘরের ভেতর ঢুকে দেখি সারা বাড়িতে আর কোনও লোক নেই, শিয়াল-মুখো ছাড়া। দুটো ঘর পাশাপাশি। ভেতরে শোবার ঘরে রুহি ঢুকে যায় লোকটির সঙ্গে। পাশের ঘরের সোফায় খেলনার মত নাকি কাঠের ঘোড়ার মত নাকি জানি না, বসে আমি দেখতে থাকি লোকটি রুহির সঙ্গে ঘন হয়ে বিছানায় বসল। এত ঘন হয়ে যে আমার পলক পড়ে না। শিয়াল-মুখো শুয়ে পড়ল বিছানায় রুহিকে বুকের ওপর টেনে। হঠাৎই এক লাফে রুহিকে সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে এসে লোকটি আমাদের হাতে ফানটার বোতল ধরিয়ে দিয়ে গীতা যাও, লনে বস গিয়া বলে শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
মাঠে গিয়ে আমি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করি–লোকটা কে?
মিটিমিটি হেসে গীতা বলল–খুররম ভাই। অনেক বড়লোক। গাড়ি আছে।
— রুহিরে নিয়া যে লোকটা দরজা বন্ধ কইরা দিল। ঢোঁক গিলে বলি, এহন কি হইব। আমার ডর লাগতাছে। চল যাইগা।
গীতা তার কালো মুখে শাদা হাসি ফুটিয়ে বলে, আরে বস, এহনি যাইয়া কি করবা!
দুপুর পার হয়ে বিকেল হয়ে গেল চল যাইগা চল যাইগা করে করে। আমি ছটফট করি, প্রতিটি মুহূর্ত কাটে আমার অস্বস্তিতে। শিয়াল-মুখো ঘন্টায় ঘন্টায় ফানটার বোতল দিয়ে যায় এদিকে। ফানটা খেয়ে তখন আর আমার পোষাচ্ছে না। ক্ষিধেয় চিনচিন করছে পেট।