পীরবাড়িতে ঢুকলে আমার গা ছমছম করে। এ বাড়ির সবগুলো গাছই, আমার আশংকা হয়, জ্বিন ভূত পেত্নীর বাসা। কখন কোন গাছের তল দিয়ে যাওয়ার সময় জ্বিন লাফিয়ে পড়বে ঘাড়ে কে জানে, মা’র আঙুল শক্ত করে ধরে পীরের ঘরের দিকে হাঁটি। আসলে আমি হাঁটি না, মা হাঁটেন, আমাকে হাঁটতে হয়। মা মুরিদ হয়েছেন পীরের। শাড়ি ছেড়ে জামা পাজামা ধরেছেন। মা’কে মা বলে মনে হয় না।
পীরের ঘরে বসে আছেন ছ’সাতটি মেয়ে, পরনে ওদের পায়ের পাতা অবদি ঝুলে থাকা লম্বা জামা, মাথায় ওড়না। জামাগুলো শরীরের সঙ্গে এমন মিশে থাকে যে দূর থেকে দেখলে মনে হয় উদোম গায়ে বুঝি ওরা। একজনের পরনে কেবল শাড়ি। গলায় তাবিজ ঝুলছে চারটে। মাথায় ঘোমটা টানা। খুব বিমর্ষ মুখ তাঁর। পীরের পায়ের ওপর দু’হাত রেখে তিনি বলেন
— পুলা না হইলে স্বামী আমারে তালাক দিব হুজুর।
খুব ধীরে কথা বলেন পীর আমিরুল্লাহ, কথা যখন বলেন পাঁচ আঙুলে দাড়ি আঁচড়ান। ছাদের কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলে, চোখে অপার মায়া, বলেন– আল্লাহর নাম লও, আল্লাহ ছাড়া দেওয়ার মালিক কেউ নেই, আমি তো উছিলা মাত্র। মাঝরাতে জিকির করবে। তিনি পরওয়ার দেগার, দো জাহানের মালিক, তার কাছে কাঁদো আলেয়া। না কাঁদলে তার মন নরম হবে কেন, বল! বান্দা যদি হাত পাতে, সেই হাত আল্লাহ ফেরান না। তার অসীম দয়া।
আলেয়া উপুড় হয়ে পায়ের ওপর, যেন সেজদা করছেন, ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ছেলে হওয়ার শর্তে তিনি মাঝরাত কেন, সারারাতই জিকির করবেন। আমিরুল্লাহ দাড়ি থেকে হাত সরিয়ে আলেয়ার পিঠে রাখেন, কড়িকাঠ থেকে নামিয়ে আলেয়ার ঘোমটা খসে বেরিয়ে আসা চুলে চোখ রেখে বলেন আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, নিরাকার, সর্বশক্তিমান। তার আদি নেই, অন্ত নেই। তার পিতামাতা পুত্রকন্যা নেই। তিনিই সবকিছু দেখেন অথচ তার আমাদের মত চক্ষু নেই। তিনি সবই শোনেন, অথচ তার কর্ণ নেই। তিনি সবকিছুই করতে পারেন অথচ আমাদের মত তার হাত নেই। তিনি সর্বত্র সর্বদা বিরাজিত। তিনি আহার করেন না, নিদ্রা যান না। তার কোনও আকৃতি নেই। তার তুলনা দেওয়া যেতে পারে এমন কোনও বস্তু নেই। তিনি চিরদিনই আছেন এবং চিরদিনই থাকবেন। তিনি সকলের অভাব পূরণ করেন, তার নিজের কোনও অভাব নেই। তিনি চিরজীবিত, তার মৃত্যু নেই, ধ্বংসও নেই। তিনি পরম দাতা, অসীম দয়ালু। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ইজ্জতের মালিক, মানুষকে তিনি ইজ্জত দান করেন। তুমি তার দরবারে হাত ওঠাও, তোমার নিশ্চয় ছেলে হবে, সমাজে তোমার ইজ্জত রক্ষা হবে।
মা’র পেছনে জড়সড় দাঁড়িয়ে আল্লাহর নিরাকার শরীরটির কথা ভাবি। এ অনেকটা আমাদের ইস্কুলে যাদু দেখাতে আসা লোকটির মত, কালো কাপড় দিয়ে তাঁকে ঢেকে ফেলা হল, পরে কাপড় সরালে যাদুকর আর নেই ওতে। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। আমারও যদি নিরাকার শরীর থাকত, সারা শহর ঘুরে বেড়াতাম, ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে একা একা চলে যেতাম, কেউ আমার ঘাড় খুঁজে পেত না ঘরে ঠেলার।
নতজানু আলেয়ার উপুড় হওয়া শরীরের তল থেকে পীরসাব পা সরিয়ে নেন। যুবতীদের ভিড় থেকে হুমায়রা ছুটে এসে আলেয়াকে ধরে উঠোনে নিয়ে যায়। জবা গাছ তলে দাঁড়িয়ে আঁচলের গিঁট খুলে ভাঁজ করা নোট বার করে হুমায়রার হাতে দেন আলেয়া। হুমায়রা মুঠোর ভেতর নোটটি নিয়ে পীরসাবের হাতে গুঁজে দেয়, অভিজ্ঞ হাত। টাকা এক হাত থেকে আরেক হাতে যায়। অনেকটা রিলে রেসের মত। পীরসাব তাঁর আলখাল্লার পকেটে ঢুকিয়ে দেন টাকার হাতটি, ওটিই আপাতত চলমান ক্যাশবাক্স। পকেটে ঢোকানো হাতটির ওপর চোখ গেঁথে থাকে আমার। আমার চোখের পাতায় তীক্ষ্ণ চোখ রেখে–হামিমা, সঙ্গে কে তোমার, মেয়ে নাকি! পীর বলেন।
মা আমার বাহু টেনে সামনে এনে বলেন–জ্বি হুজুর। এই মেয়ে জন্মাইছে বারই রবিউল আওয়ালে। মেয়ে আমার সাথে দাড়ায়া নামাজ পড়ে। কায়দা সিফারা পইড়া সাইরা কোরান শরিফ ধরছে। এরে এট্টু দুয়া কইরা দিবেন হুজুর, যেন মেয়ে আমার ঈমানদার হয়।
মা আমার পিঠ ঠেলে বলেন–যা হুজুরকে কদমবুসি কর।
আমি গা শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকি। কদমবুসি করার জন্য এক পাও এগোতে ইচ্ছে করে না আমার। মা গা ঠেলেন আমার, আবারও। আমি এক পা দু’পা করে পেছোতে থাকি। মুখে শাদা লম্বা দাড়ি, পায়ের গোড়ালি অবদি আলখাল্লা, মাথায় আল্লাহু লেখা গোল টুপি লাগানো পীর থাবা বাড়িয়ে খপ করে ধরেন আমাকে, যেন গাছ থেকে টুপ করে পড়া একটি চালতা ধরছেন মুঠোয়। আমাকে তাঁর গায়ের সঙ্গে লেপটে ফেলেন এত যে আলখাল্লার ভেতর হারিয়ে যায় আমার শরীর। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। চোখ বুজে বিড় বিড় করে কিছু বলে পীরসাব ফুঁ দেন আমার সারা মুখে। ফুঁএর সঙ্গে থুতু ছিটকে পড়ে মুখে আমার।
আলখাল্লা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গিয়ে লুকোই মোহাবিষ্ট মা’র পেছনে। জামার হাতায় থুতু মুছতে মুছতে শুনি পীর বলছেন–তুমার মেয়ে কি দুনিয়াদারির পড়া পড়ছে নাকি! মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন–হ। আমার ত কোনও হাত নাই হুজুর ছেলেমেয়ের ওপর। এর বাপে সেই পড়াই পড়াইতেছে। এই মেয়ের আবার আল্লাহ রসুল সম্পর্কে খুব জানার ইচ্ছা। তাই ভাবছি এহানে নিয়া আসলে ওর ভাল লাগবে। মনটা ফিরবে আল্লাহর দিকে আরও।
হুজুর চুক চুক দুঃখ করেন জিহবায়। বিছানায় শরীর এলিয়ে বলেন–মুশকিল কি জানো! দুনিয়াদারির লেখাপড়ায় মনে শয়তান ঢুকে যায়, পরে শয়তানের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে আল্লাহর পথে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। এই যে দেখ নাজিয়া, নাফিসা, মুনাজ্জেবা, মতিয়া এরা সবাই কলেজে পড়ত, সবাই পড়া ছেড়ে দিয়েছে। দিয়ে এখন আল্লাহর পথের পড়াশুনা করছে। আখেরাতের সম্বল করছে। ওরা এখন বুঝতে পারে, ওইসব পড়ালেখা আসলে মিথ্যা। ওরা ঢাকা ছিল ভয়ংকর অন্ধকারে। সত্যিকার জ্ঞানের আলো ওরা পায়নি।
মা আমাকে ইঙ্গিতে উঠোনে যেতে বলে হুজুরকে তালপাতার পাখায় বাতাস করেন। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি পেরিয়ে যেই না উঠোনে পা দেব, চিলের মত ছোঁ মেরে আমাকে তুলে নেয় হুমায়রা, নিয়ে সোজা উত্তরের ঘরে। এ ঘরটির তোষকগুলো গুটোনো থাকে দিনের বেলা, চৌকির ওপর বিছানো থাকে কেবল শীতল পাটি। পাটির ওপর বসে ফজলিখালার মেয়েরা তসবিহ জপে, নামাজ পড়ে। তারা কেউ ইস্কুলে যায় না, তারা আল্লাহর পথের লেখাপড়া করে বাড়িতে।
হুমায়রা আমার চেয়ে বছর পাঁচেক বড়। মুখখানা গোল চালতার মত ওর।
— তুমি বড় খালার মেয়ে, তুমি আমার খালাতো বোন হও, তা জানো! হুমায়রা আমার কাঁধে টোকা মেরে বলেন।
— দুনিয়াদারির লেখাপড়া কর কেন? এই লেখাপড়া করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। আল্লাহ অনেক গুনাহ দেবেন তোমাকে।
বলে আমাকে পাটির ওপর বসিয়ে হুমায়রা পাশে বসে আমার।
— তোমার বাবা হচ্ছে একটা কাফের। কাফেরের কথা শুনলে তোমাকেও দোযখে পাঠাবেন আল্লাহতায়ালা।
চোখ বুজে দোযখের কল্পনা করতে গিয়ে গায়ে কাঁপুনি ওঠে হুমায়রার। আমার হাতদু’খানা হঠাৎ চেপে ধরে সে কি কারণে, ঠিক বুঝতে পারি না। গা হিম হতে থাকে আমার। বড় একটি গর্তে আগুন জ্বলছে, ফুটন্ত পানির ওপর ভাসতে ভাসতে কাতরাচ্ছে অগুনতি মানুষ। মানুষগুলোর মধ্যে দেখি আমিও কাতরাচ্ছি। আমাদের সামনে ততক্ষণে এসে দাঁড়ায় একজন একজন করে সাতজন মেয়ে, ওদের দৃষ্টির হুল ফোঁটে আমার শরীরে। দুনিয়াদারির লেখাপড়া করা অদ্ভুত এক জীব যেন আমি। চোখে ওদের খলসে মাছের মত লাফ দিয়ে ওঠে এক ঝাঁক করুণা, ওরা যেন বেহেসতের বাগানে বসে দেখতে পাচ্ছে আমি দোযখের আগুনে পুড়ছি। আমাকে দেখে আহা আহা করে ওরা। লম্বা মত এক মেয়ে বলে–হুমায়রা, ও কি আল্লাহর পথে আসতে চায়!
— হ্যাঁ, কিন্তু ওর বাবা ওরে দিতে চায় না। হুমায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে। আমি খালাতো বোন বলেই বোধহয় ওর দীর্ঘশ্বাস অতি দীর্ঘ।
লম্বা মত জিভে চুক চুক শব্দ করে। বাকিরাও করে চুক চুক। চুক চুক। চুক চুক। যেন অনেকগুলো বেড়াল দুধ খাচ্ছে শব্দ করে। শব্দ শুনি আর ঋষি-মূষিকের মত বসে গুণি ওদের, সাত ছয় পাঁচ চার তিন দুই এক। লম্বা, খাটো, মাঝারি, খাটো, খাটো, খাটো, মাঝারি। ওদের মনে মনে ইস্কুলের এসেম্বলিতে দাঁড় করাই। খাটো, খাটো, খাটো, মাঝারি, মাঝারি, লম্বা। ওদের দিয়ে গাওয়াই, ও সাত ভাই চম্পা জাগোরে!
আমার মগ্নতা ভাঙে হুমায়রার গুঁতোয়–দেখ এদের বাবা এদেরকে, সাতজনকে থুতনি তুলে দেখিয়ে বলে সে, আল্লাহর পথে দিয়ে গেছে। এরা এইখানেই থাকে। কোরান হাদিস শেখে।
হুমায়রা আবারও অতি দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে–খালুকে নছিহত করলে তিনি নিশ্চয় আল্লাহর পথে আসতেন। ছেলেমেয়েদেরও আল্লাহর পথে দিতেন।
বাবাকে করলে কাজ হত কি না আমার সংশয় আছে, তবে জজ সাহেবকে নছিহত করে কাজ হয়েছিল। জজ তাঁর ষোল বছরের মেয়ে মুনাজ্জেবাকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে গেছেন, লম্বা মেয়েটি, হুমায়রা বলে, মুনাজ্জেবা, জজের মেয়ে। কোথাকার জজ? ঢাকার। ঢাকা শব্দটি এমন স্বরে হুমায়রা উচ্চারণ করে যে ঢাকার জজ মানে বুঝতে হবে বড় জজ। ঘটনাটি এরকম ছিল, ষোল বছরের মেয়ে লেখাপড়ায় ভাল হলেও গোল্লায় যেতে শুরু করে, বখাটে এক ছেলের সঙ্গে প্রেম করে। জজ সাহেবের মেয়েকে নাকি পাড়ার মাঠে বখাটেটির সঙ্গে অন্ধকারে শুয়ে থাকতে দেখেছে কারা। পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে গেল। মেয়েকে ইস্কুল বন্ধ করে বাড়িতে বসিয়ে রাখলেন জজ সাহেব। তখন কেউ একজন তাঁকে বললেন আমিরুল্লাহ পীরের নাম, তিনি মেয়েদের বাড়িতে রেখে কোরান হাদিস শেখান, মেয়েরা নামাজি হয়, ঈমানদার হয়, অন্দরমহলের বাইরে পা দেওয়া নিষেধ তাদের, কঠোর পর্দার মধ্যে তাদের জীবন যাপন করতে হয়। শুনে ঢাকার জজ একবার মজলিশ শুনতে আসেন পীরের বাড়ি। পীরের ব্যাবহারে তাঁর মন গলে। তিনি তাঁর উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়েকে হুজুরের হাতে সঁপে দিয়ে যান ক’দিন পরেই। রুবিনা পাল্টে পীরসাব মেয়ের নাম দিয়েছেন মুনাজ্জেবা। মুনাজ্জেবা লম্বা লম্বা জামা গায়ে মাথায় ওড়না জড়িয়ে পর্দা পুশিদা মত অন্দরমহলে থাকে, কোরান হাদিস পড়ে, মজলিশে হুজুরের দোযখের বর্ণনা শুনে কেঁদে বুক ভাসায়, হুজুরের গা হাত পা টেপে। সেই থেকে শুরু এ বাড়িতে বড় বড় ঘরের মেয়ে আসার, পুলিশের মেয়ে, উকিলের মেয়ে, সরকারি কর্তাদের মেয়ে। হযরত ইব্রাহিম আল্লাহর হুকুম মত নিজের ছেলেকে কোরবানি দিয়েছিলেন, আর আজকালকার বাবারা কেন পারবেন না নিজের মেয়েকে আল্লাহর পথে দিতে! হুমায়রা ভাবে। এ বাড়িতে মেয়েদের আল্লাহর প্রেমে দিওয়ানা হতে বলা হয়, মেয়েরা হয়। নিরাকার আল্লাহর সঙ্গে মেয়েদের প্রেম ভীষণ জমে ওঠে এ বাড়িতে আসা মাত্র। পীর আমিরুল্লাহ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন দেখে, তাঁর মনে হয় এরা মুনাজ্জেবা নাজিয়া নাসিমা নয়, এরা শ্রেফ বেহেসতের বাগানের ফুল।
আমিরুল্লাহ পীর জঙ্গল সাফ করা আঙিনায় ঘর তুলে দেন মেয়েদের। কারও ঘরে টিনের চাল, কারও ঘরে সিমেন্টের। ঘরগুলোয় জানালা নেই, গরমে হাঁসফাঁস করে মেয়েরা। পীরসাব বলেছেন–আরবে এইরকম ঘর ছিল, যে ঘরে আমাদের নবী জীবন যাপন করতেন। এরকম ঘরে থাকলে সওয়াব হয়। নবীজি যে কষ্ট করেছেন, সে কষ্ট যদি তোমরা করতে পার, তবে নবীজি