ছেলে হয়ে ওঠার ইচ্ছে আমার সেদিন মরে গিয়েছিল, যেদিন ইচ্ছেয় আচ্ছত আমি দেখলাম ফুলবাহারির মা এসেছে অবকাশে। হাড্ডিসার। কামেলা রোগে মরতে বসেছিল, পীরফকিরের দোয়ায় নাকি বেঁচেছে। কাহিলাকে কেউ আর কাজে রাখে না। এর ওর বাড়ি চাল ডাল ভিক্ষে করে সে চলে। ফুলবাহারির মা যখন পাকঘরের বারান্দায় ধপাস করে বসল, আর ওঠার সময় বারান্দার থামে ভর করে দাঁড়াল, এত ক্লান্ত যে জীবনের ভার আর সে বহন করতে পারছে না। আমার দেখে মনে হয় জীবন কাঁধে এসে বসে সময় সময়, একে পিঠে ঝুলিয়ে বহুদূর হাঁটতে শরীর মন সায় দেয় না।
সেই ফুলবাহারির মা, ঘসঘস ঘসসসস শব্দে মশলা বাটত নানিদের পাকঘরে। ঘসঘস ঘসসসস। ঘসঘস ঘসসসস। শব্দটি আমি যেন শুনি যখন পা টেনে টেনে বেলগাছের তল দিয়ে সে হেঁটে চলে যাচ্ছিল। কোথায় যাচ্ছিল কে জানে, তার পেছন পেছন দৌড়ে আমার দেখা হয়নি সে যাচ্ছে কোথায়, এ জগতের কোথায় তার যাওয়ার জায়গা। ঘসঘস শব্দটি আমাকে একটি ভাঙা চৌকাঠে এনে বসায়, যেখানে বসে চেয়ে থাকতাম শিলপাটার ওপর ঝুঁকে দুলে দুলে ফুলবাহারির মা’র মশলা বাটার দিকে। সাত সকালে এসে মশলা বাটতে বসত, দুপুরের আগে আগে বাটা শেষ হত। হলুদ, মরিচ, ধনে জিরা, পিঁয়াজ, রসুন, আদা সাতরকম মশলা তাকে পিষতে হত শিলপাটায়। বড় এক গামলায় করে নানার দোকানের কর্মচারি এসে নিয়ে যেত মশলা। বিকেলে আবার বাটতে বসত, সারা বিকেল বাটত। ইচ্ছে হত আমিও বাটি, ফুলবাহারির মা’র মত দুলে দুলে। বলেওছি, একটু খানি বাটতে দিবা মশলা আমারে?
ফুলবাহারির মা মশলা বাটা থামিয়ে আমার দিকে ফক করে পান খাওয়া কালো দাঁত হাসল, বলল আপনে মশলা বাটতে পারবাইন না আপা, এইডা খুব শক্ত কাম। ফুলবাহারির মা আমার মা’র বয়সী, আমাকে সে ডাকে আপা আর আপনি সম্বোধন করে, কারণ আমি মনিবের বাড়ির মেয়ে। আমাকে মশলা বাটা মানায় না, ছোটলোকেরা বাটে এসব। ছোটলোকের হাত ময়লা হয় শক্ত আর নোংরা কাজ করে। তিন বছর বয়স থেকেই আমি বুঝতে শিখেছি, কারা ছোট আর কারা বড়। ফুলবাহারির মা দেখতে বড় হলেও ছোটলোক, এদের কোলে উঠতে হয় না, এদের গা ধরতে হয় না, এদের হাতের রান্নাও খেতে হয় না। এদের চেয়ারে সোফায় বসার অধিকার নেই, হয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, নেহাত বসতে হলে মাটিতে, শুলে মাটিতে শুতে হয়। ডাকার সঙ্গে সঙ্গে এদের দৌড়ে আসা চাই সামনে, যে হুকুমই করা হোক, সবই মুখ বুজে পালন করতে হয় এদের। ছোটলোকদের তাই করার নিয়ম।
ফুলবাহারির মা’র পান খাওয়া কালো দাঁতের দিকে তাকিয়ে আমি একটি প্রশ্ন, প্রশ্নটি হঠাৎই উদয় হয়, করি–তুমার নাম কি ফুলবাহারির মা?
মশলা পেষার ঘসঘসস শব্দে আমার প্রশ্ন সম্ভবত থেতলে যায় বলে সে কোনও উত্তর দেয় না। চৌকাঠে বসে আমি আবারও, বিকেলে, যখন বাড়ির মানুষগুলো দুপুরের খাওয়ার পর গা টান করে শুয়েছে, চোরা বেড়ালটি চুলোর পাড়ে ঘুমোচ্ছে, প্রশ্ন করি, এবার স্বর উঁচু করে, তুমার নাম কি?
পেষণ থামিয়ে ফুলবাহারির মা তাকায় আমার দিকে, ঘামে ভেজা তার কপাল, নাক, চিবুক। নাকের ডগায় ঘাম জমলে, রুনু খালা বলেন জামাইয়ে আদর করে। ফুলবাহারির মা’র জামাই মরে ভূত হয়ে গেছে কত আগে, তাকে আদর করবে কে! এবার আর কালো দাঁত বেরোয় না হাসিতে। হাসিতে নিচের পুরু ঠোঁট উল্টে থাকে, আর দু’গালে যেন দুটো আস্ত সুপুরি।
আমার উৎসুক চোখে শান্ত চোখ রেখে ফুলবাহারির মা বলে আমার কুনো নাম নাই বইন। মাইনষে ডাহে ফুলবাহারির মা।
এবার আমি হেসে, চোখ নাচিয়ে, মেয়েমানুষটির বোকামো ধরে ফেলেছি ভঙিতে বলি ফুলবাহারি জন্মানোর আগে তুমার নাম কি ছিল? আঁচলে মুখের ঘাম মুছে ফুলবাহারির মা বলে–আমার কুনো নাম আছিল না।
–তাইলে মাইনষে তুমারে কি কইয়া ডাকত? ধর তুমার মা বাপ কি ডাকত?
ফুলবাহারির মা বড় একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে–মা বাপ কি আর আছে? কবেই মইরা গেছে।
–তা বুঝলাম, কিন্তু যহন তুমার বাপ মা মরে নাই, তুমারে নাম দেয় নাই? ধর আমার একটা নাম আছে। নাসরিন। ফুলবাহারির মা’কে আমি ইস্কুল মাস্টারের মত বোঝাই। মশলা পিষতে পিষতে বলে সে–না, আমার কুনো নাম আছিল না কুনোকালে।
আমারে এই ছেড়িডা, ছেমড়িডা, বান্দরডা, কইয়া বেহেই ডাকত।
আমি অবাক তাকিয়ে থাকি দুলতে থাকা শরীরের দিকে। যেন শিলপাটায় নয়, আমার মাথার ভেতর শব্দ হচ্ছে ঘসঘস ঘসসসস।
মা’কে, কলাগাছে কলা ধরার বা কড়ইএর ডাল ভেঙে পড়ার খবর যেমন দিই, তেমন করে এ খবরটিও দিই–জান মা, ফুলবাহারির মা’র নিজের কুনো নাম নাই।
মা শব্দ করলেন হু।
মা এতটুকু চমকান না শুনে মা’র বয়সী একজনের কোনও নাম নেই। এত নির্লিপ্তি মা’র, আমি বুঝি না, কেন।
–মা, নাম ছাড়া আবার মানুষ হয় নাকি? আমি বই থেকে চোখ সরিয়ে মনে জমে থাকা প্রশ্নটি করি।
–এত প্যাঁচাল পারিস না ত। বই পড়। জোরে জোরে পড়। মা খেঁকিয়ে ওঠেন। বাধ্য মেয়ের মত দুলে দুলে পড়ি–
আপনারে বড় বলে বড় সে নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।
লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে।
সদা সত্য কথা বলিবে।
–ফুলবাহারি, তুমার মার কুনো নাম নাই, জান? পড়ার ফাঁকে ফুলবাহারিকে বলি চাপা স্বরে।
ফুলবাহারিও একটুও অবাক হয় না শুনে যে তার মা’র কোনও নাম নেই। যেন এটিই স্বাভাবিক। যেন এটি হওয়ারই কথা ছিল। সে, বরং বাঁকা চোখে তাকিয়ে আমার চোখে, অনুমান করতে চায় কোনও লুকোনো কারণ আছে কি না তার মা’র যে কোনও নাম নেই সে নিয়ে আমার আগ্রহের।
–নাম নাই তো নাম নাই। নাম দিয়া কাম কি! গরিবের নাম থাকলেই কি না থাকলেই কি! ফুলবাহারি চোয়াল শক্ত করে বলে।
মা প্রায়ই বলেন ফুলবাহারির নাকি তেজ খুব বেশি। কথা বলে ব্যাডাগর লাহান, এক্কেরে ফাডা বাঁশ। তা ঠিক। ফুলবাহারির কথা আমাকে ভাবনায় ফেলে। তার মানে গরিবের কোনও নামের দরকার নেই! নাম দিয়ে কোনও কাজ নেই গরিবের! সম্ভবত ফুলবাহারি ঠিকই বলেছে। গরিবের ইস্কুলে যেতে হয় না, ইস্কুলের খাতায় নাম লেখানোর কোনও দরকার হয় না। গরিবের বাড়ি ঘর নেই, দলিলপত্রও তাই করতে হয় না, তাই নামেরও দরকার নেই। তাহলে নাম ছাড়াও বাঁচা যায়, অবশ্য গরিবেরাই বাঁচে কেবল। গরিবের কেবল নাম নয়, ওরা লেপ তোষক ছাড়াও বাঁচে, মাছ মাংস ছাড়াও, জুতো সেন্ডেল, জামা কাপড়, তেল সাবান, স্নো পাউডার ছাড়াও বাঁচে। ফুলবাহারির জন্য আমার খুব মায়া হতে থাকে, ওর নামহীন মা’র জন্যও। বালতির পানিতে ত্যানা ভিজিয়ে, চিপে, ফুলবাহারি উবু হয়ে মুছতে থাকে মেঝে। ওর কানে বিড়ি গোজা, কাজ কাম সেরে এই বিড়িটি ধরাবে সে। ফুলবাহারির বিড়ি খাওয়ায় বাড়ির কেউ আপত্তি করে না। ছোটলোকেরা বিড়ি তামাক খেতে পারে, কিন্তু ভদ্রঘরের মেয়েদের ওসব মুখে তোলা যাবে না। পুরুষ সে বড়লোক হোক, ছোটলোক হোক, যা ইচ্ছে করবে, যা ইচ্ছে খাবে, ফুঁকবে– বাধা নেই। ফুলবাহারির কালো লম্বা শরীরটি, বসন্তের দাগ-মুখ আর কানে গোঁজা বিড়িখানি আমার বড় চেনা। কাজের ফাঁকে মেঝেয় পাছা ঠেকিয়ে বিড়ি ধরায় ও, ফক ফক করে ধোঁয়া