অবসর

পরীক্ষার পর আমার আনন্দ আর ধরে না। অখণ্ড অবসর জুড়ে এখন আমি যা মন চায় করে বেড়াব,

পরীক্ষার পর আমার আনন্দ আর ধরে না। অখণ্ড অবসর জুড়ে এখন আমি যা মন চায় করে বেড়াব, সিনেমা দেখে, গল্পের বই পড়ে, কবিতা আবৃত্তি করে, পদ্য লিখে। কিন্তু বাবা হুকুম জারি করলেন কোনও সিনেমা পত্রিকা পড়া চলবে না, সিনেমার নায়ক নায়িকাদের ছবিঅলা বাজে সব পত্রিকা এ বাড়িতে নিষিদ্ধ। প্‌ ড়তে যদি হয়ই তবে ভাল পত্রিকা পড়তে হবে। যে পত্রিকা পড়লে জ্ঞান বাড়ে। তো কি নাম সেই জ্ঞানদায়িনী ভাল পত্রিকাটির? আমি উৎসুক জানতে, আমার তখন কোনও কিছুতে নাক সিঁটকোনো নেই। পড়তে দিলে গোটা বিশ্ব পড়ে ফেলতে পারি। বাবার পছন্দের পত্রিকাটির নাম বেগম। বেগম আসতে লাগল বাড়িতে নিয়মিত। পত্রিকাটির আগাগোড়া পড়ে ফেলি একদিন, কি করে কি রান্না করতে হয়, কি করে চুল বাঁধতে হয়, কি করে সবজি-বাগান অথবা ফুলের বাগান করতে হয়, কি করে ঘর গোছাতে হয়, শিশুর যত্ন, স্বামীর যত্ন ইত্যাদিই বা কি করে,এসব। দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রায় একই জিনিস বেগমে, অর্ধেকের বেশি পড়া হল না। তৃতীয় সপ্তাহে অর্ধেকের চেয়েও কম। বেগম যে একেবারে না ছোঁয়া রয়ে গেল এরপর তা নয়, বরং বেগমের ওপর ঝুঁকে থাকা আগের চেয়ে বেশি বাড়ল, হাতে হাতে যেতে যেতে বেগমের কাগজ ছিঁড়ে যেতে লাগল। বেগমকে জনপ্রিয় করার কারণটি দাদা, হকারের হাতে বেগম দেখলে দাদাই প্রথম ছোঁ মেরে তুলে নেন। এরপরই ঝুঁকে থাকা, নিজে ঝুঁকবেন, বাড়ির সবাইকে ঝোঁকাবেন। পাঁচ ছটি কালো মাথা বেগমের ওপর ঝুঁকে রইল পুরো দুপুর এমনও হয়েছে, এরপর বাকি মাথাগুলো সরে গেলেও দাদার মাথাটি থেকে যায়, অলস বিকেলে, এমনকি রাতেও, সবাই ঘুমিয়ে গেলে। দাদা ঝুঁকে থাকেন এক ঝাঁক মেয়ের ছবিতে। বেগমে যারাই লেখে, গল্প কবিতা অথবা প্রাণী ও উদ্ভিদের যত্ন পদ্ধতি, তাদের ছবি ছাপা হয় এক পাতায়। এক সঙ্গে কুড়ি পঁচিশটি মেয়ের ছবি দেখতে পাওয়া যা তা কথা নয়, বেগম দাদাকে যত আনন্দ দেয়, তত আর কাউকে দেয় না। তিনি প্রতি সপ্তাহে বেগম থেকে মেয়ে পছন্দ করেন, আবার পরের সপ্তাহে সে মেয়ে বাতিল করে অন্য মেয়ে পছন্দ করেন। আসলে পরের সপ্তাহে বেগম এলে আবার নতুন কাউকে আগে যাকে পছন্দ করেছিলেন তার চেয়ে বেশি পছন্দ হয়ে গিয়ে গোল বাধাঁয়। কোনটিকে যে তিনি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন নিশ্চিত না হয়ে আবার পরের সপ্তাহের বেগমের জন্য অপেক্ষা করেন, আরও ভাল যদি জোটে। দিলশাদ নুর নামের এক সুন্দরী মেয়েকে তিনি একবার পছন্দ করলেন কিন্তু তার কবিতায় সেই যে গেছে সে আর ফিরছে না, ফিরে এলে আমি তার বুকে মাথা রেখে ঘুমোবো.. লাইনটি পড়ে দাদা ঠোঁট উল্টো বললেন নাহ এরে বিয়া করা যাবে না।

 

কেন যাবে না? আমি জিজ্ঞেস করি।

 

দেখলি না কোন বেডার লাইগা ও অপেক্ষা করতাছে!

 

আরে এইটা তো কবিতা।

 

কবিতা হোক তাতে কি হইছে!

 

কবিতায় যদি তুমি লেখ যে আকাশে উড়তাছ, তাইলে কি সত্যিই আকাশে উড়তাছ? আকাশে সত্যিকার না উড়ি, মনে মনে তো উড়ি। কবিতায় তো মনের কথা লেখা হয়। দাদা বাতিল করে দিলেন পছন্দ হওয়া দিলশাদকেও। দাদা যখন কাউকে বাতিল করেন, দাদাকে খুব বিমর্ষ দেখতে লাগে। যেন এইমাত্র হাতের মুঠো থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ পাখিটি উড়ে গেল। অবশ্য সুলতানার বেলায় দাদার তেমন মনে হয়নি। দাদার পত্রমিতা সুলতানা দাদাকে একটি শাড়ি পরা মোড়ায় বসা ছবি পাঠিয়েছিল, সেই ছবি নিয়ে দাদা অনেকগুলো রাত নির্ঘুম কাটাবার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই মেয়েকেই তিনি বিয়ে করবেন। নতুন কাপড় চোপড় বানালেন, নতুন সগু ন্ধী কিনলেন, জুতোও কিনলেন একজোড়া। সকালে আড়াই ঘন্টা সময় খর্চা করে গোসল করে নতুন জামা কাপড় পরে, শিশির অর্ধেক সগু ন্ধী গায়ে ঢেলে তিনি ঢাকায় রওনা হয়ে গেলেন। রাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে দেখি জিভে কামড় দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন দাদা। সকলে ঘিরে ধরি, কি হয়েছে, হয়েছেটা কি? দাদা তখনও জিভ থেকে দাঁত সরাননি, যখন সরিয়েছেন, একটি কথাই হাঁফ ছেড়ে বলেছেন, বড় বাঁচাডা বাঁচলাম।

 

কেন?

 

পৃথিবীর মধ্যে যদি কোনও কুৎসিত কিছু থাইকা থাকে, তাইলে ওই বেডি।

 

কও কি? ছবিতে ত সুন্দরই লাগতাছিল।

 

উফ। তরা যদি দেখতি বেডিরে। কাইল্যা পচা। পুইট্যা। বুইড়া। হাসলে উচা উচা দাঁতগুলা রাক্ষসের লাহান বাইর হইয়া পড়ে। পাতিলের তলার লাহান কালা মাড়ি। জীবনে কোনওদিন পেত্নী দেখি নাই, আজকে দেইখা আইলাম।

 

কেন, চুল ত দেখলাম কত লম্বা। পাছা ছাড়াইয়া যায়!

 

চুল। চুল দিয়া আমি কি করাম। চুল ধইয়া পানি খাইয়াম?

 

একটু থেমে বললেন, মনে হয় নকল চুল লাগাইয়া ফটো তুলছে। সামনের উঁচা একটা দাঁতও নকল।

 

দাদা সুলতানার জন্য রঙিন কাগজে মুড়ে কিছু উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলো সেভাবেই ফেরত এনেছেন। সারাদিনের না খাওয়া দাদা হাপুস হুপুস করে খেয়ে পথের ধুলো কালি ধুয়ে দীর্ঘ ঘুম ঘুমোলেন।

 

সুলতানার স্বপ্ন দূর করে দিয়ে দাদা পরদিন থেকে বেগমে মন দিলেন। বেগম দিতে আসা হকারকে বলে দিই চিত্রালী পূর্বাণী আর বিচিত্রা দিতে। বলি বটে, কিন্তু এখন আর ইশকুল নেই যে রিক্সাভাড়া থেকে দুআনা চারআনা জমিয়ে রাখব, কাগজও বাড়তি নেই যে শিশিবোতলকাগজঅলার কাছে বিক্রি করে বেশ কটি আধুলি উপার্জন করব। পত্রিকা পড়ার জন্য মন আকুলিবিকুলি করে কিন্তু পত্রিকা কেনার টাকা যোগাড় করব কোত্থেকে! লোকে যেমন আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আমি করি দাদার ওপর। দাদার করুণার উদ্রেক সবসময় হয় না, দাদা আল্লাহতায়ালার মত দয়াশীল দানশীল হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না বরং হাড়কিপ্টে বলে তাঁর নাম আছে। রিক্সাভাড়া যেখানে দুটাকা, তিনি আজও সেখানে হাতে আট আনা দিয়ে রিক্সাঅলাকে ধমকে বিদেয় করেন। রিক্সাঅলার সঙ্গে তারস্বরে দাদার চিৎকার বাড়ির লোক তো বটেই, পাড়ার লোকও শোনে। এতে কোনওরকম ভ্রূক্ষেপ দাদা করেন না, তাঁর ভাষ্য এই তো কয়দিন আগেই আট আনা দিয়া আইছি।

 

কয়দিন আগে মানে? মা বলেন, সে ত পাঁচ বছর আগে।

 

পাঁচ বছরকে দাদার কয়দিন আগেই মনে হয়।

 

হাতে পয়সা থাকলে রিক্সাঅলাকে দুটাকার জায়গায় চারটাকা দেন মা, রিক্সাঅলা যদি অভাবের কথা কোনওদিন বর্ণনা করে পথে, তবে কেবল টাকাই নয়, বাড়ি পৌঁছে খাটের তলে ডাঁই করে রাখা ঝুনা নারকেলের একটি বেছে রিক্সাঅলার হাতে দিয়ে বলেন, পুলাপান নিয়া খাইও। মার এসব আচরণ দেখে দাদা বলেন, মা হইল নানার ডুপ্লিকেট। হাতে যা থাকে সব মাইনষেরে দিয়া দেয়।

 

দাদা মোটেও মার চরিত্র পাননি। দাদার মন সবসময় বলে পৃথিবীর সবাই তাঁকে ঠকাচ্ছে, তাই তিনি ছলে বলে কৌশলে সবাইকে ঠকাতে চেষ্টা করেন। দোকানে গিয়ে দর কষাকষি করার অভ্যেস দাদার। সকলেই দামাদামি করে, কিন্তু দাদার তুলনা হয় না। দাদার সঙ্গে দোকানে গেলে আমাকে কম লজ্জায় পড়তে হয় না। দোকানি যদি চায় পঞ্চাশ, লোকে তিরিশ টাকায় দিবেন? বা চল্লিশে হইব? জিজ্ঞেস করে। পঞ্চাশ টাকা দাম শুনে দাদা বলেন, তিন টাকায় দিবেন? দোকানি হাঁ হয়ে থাকে। কোথায় পঞ্চাশ আর কোথায় তিন! দাদা সেই তিন থেকে সোয়া তিন সাড়ে তিন করে ওপরে ওঠেন। দোকানি শেষ অবদি কুড়ি বা একুশে রাজি হয়। রাজি হয় বটে, তবে বলে দেয় কাস্টমার অনেক দেখছি ভাই, আপনের মত দেহি নাই। ঠগাইয়া গেলেন। লাভ ত হইলই না, আসল দামডাই উঠল না।

 

দাদার ওপর ভরসা করি বটে, কিন্তু দাদার কৃপণতা সীমা ছাড়িয়ে গেলে ছোটদার পথ অনুসরণ করা ছাড়া আমার আর উপায় থাকে না। দাদা একবার গোসলখানায় ঢুকলে যেহেতু ছোট বড় মাঝারি সব সেরে আসতে ঘন্টাখানিক সময় নেন, ঘরের আলনায় ঝুলে থাকা তাঁর প্যাণ্টের পকেটে কাঁপা একটি হাত ঢোকে আমার। দাদার পকেটে হাত ঢুকিয়েই হাতেখড়ি হয় এ বিদ্যের, তখন বাবার পকেটেও হাত যায়। কেবল হাত নয়, বুকও কাঁপে, হাতে পাঁচ টাকা দশ টাকার বেশি ওঠে না যদিও, কিন্তু শরমে মাথা নত করতে হয়, স্বস্তি জোটে না। এ বিদ্যে পরে ইয়াসমিনকেও আক্রান্ত করে।

 

ছোটদার ওপর দাদার রাগ দিন দিন বাড়ে। বাইরে যাওয়ার আগে দাদা তাঁর ঘরে ওষুধের বাক্স ঢুকিয়ে তালা দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু ঘরে তালা তো আর দিবানিশি দেওয়া চলে না। দাদা বাড়ি থাকলে ঘরের দরজা খোলাই থাকে। দাদা বাড়িতে আছেন, কিন্তু নিজের ঘরে নেই, এরকম কোনও সময় দেখলেই ছোটদা আমাদের পাঠান ওঘর থেকে ওষধু তুলে নিয়ে আসতে। ওষুধ হাতে করে নিয়ে আসতে গেলে বিপদ হতে পারে বলে দরজার তল দিয়ে পাচার করার উপদেশ দেন। দাদার আর ছোটদার ঘরে যে সবুজ কাঠের দরজা, তার তলে ওষুধের বোতল না হলেও ট্যাবলেট ক্যাপসুল পার হওয়ার মত ফাঁক আছে। ছোটদার একনিষ্ঠ বাহিনী আমি আর ইয়াসমিন প্রচণ্ড দুঃসাহস নিয়ে এই অপকর্ম করে যাই। এই খবরটি দাদার জানা হয়ে যায় একদিন। তিনি কাঠের দোকান থেকে মাপ মত একটি কাঠ এনে দরজার ফাঁক বন্ধ করে দেন। এরপরও যে ওষধু পাচারে কিছু ভাটা পড়ে, তা নয়। ঢিলে জামার আড়ালে করে ক্যাপসুল ট্যাবলেট তো বটেই, ওষুধের বোতল আনার কাজেও আমরা ব্যবহৃত হতে থাকি। বিত্তবানের বিরুদ্ধে বিত্তহীনের লড়াই, সভ্য ভাষায় বলা যায়। এত কিছুর পরও ছোটদার সঙ্গে সাপে নেউলে সম্পর্কে গড়ে তোলা দাদার পক্ষে সম্ভব হয় না, হয় না দাদার হাড় ফোটানো ব্যারামের কারণে। দাদার এই হাড় ফোটানো ব্যারামটি দাদাকে অদ্ভুত আনন্দ দান করে। হাড়ে হাড়ে ঘষর্ণ লেগে যে শব্দ হয়, সেটি তাঁর কর্ণকুহরে সংগীত মছূর্ নার সৃষ্টি করে। দাদা প্রতিদিনই তাঁর শরীরের যত হাড় আছে, তা ফোটান। আঙুলের হাড়ের প্রতিটি সন্ধিস্থল তিনি ঊর্ধ্বে নিম্নে ডানে বামে যত দিকে সম্ভব টেনে শব্দ তোলেন। পায়ের সবগুলো আঙুল নিয়েও একই কাণ্ড করেন। এরপর মেরুদণ্ডের সবগুলো হাড় তার ফোটানো চাই। এক হাত থুতনিতে আরেক হাত মাথায়, এবার হেঁচকা টান মেরে মাথাটা ডানে ঘুরিয়ে নাও, এরপর বামে, ঘাড়ের হাড়গুলো ফুটে


Rx Munna

447 Blog posts

Comments