অবকাশে ছোটদার সস্ত্রীক প্রবেশ আমার পরীক্ষার আগেই ঘটেছে। ঘটেছে মার কারণে। পুত্রশোকে যখন তিনি যারপরনাই কাতর,বাবার কাছে আবেদন নিবেদন করে ব্যথর্ হয়ে অতঃপর নিজেই হাশেমমামাকে পাঠিয়ে ছোটদা আর তাঁর বউকে ইসলামপুরের কোন এক গ্রামের কোনও এক কুড়েঘর থেকে শহরে আনলেন। কিন্তু শহরে এসে পৌঁছোনোর মানে এই নয় যে ওরা অবকাশে ঢোকার কোনওরকম অনুমতি পাবে। বাবা সোজা বলে দিলেন, কস্মিনকালেও যেন অবকাশমুখো না হয় ওরা। নানিকে বলে কয়ে নানির উঠোনে কুয়োতলার পাশে একটি ঘর, যে ঘরটি এককালে আমাদের খাবার ঘর ছিল, পয়পরিষ্কার করে একটি চৌকি পেতে দেওয়া হল ওদের থাকার জন্য। ছোটদা বউ নিয়ে ওখানে থাকতে শুরু করার পর বাবার আদেশে নানির বাড়ি বেড়াতে যাওয়া অন্তত আমার আর ইয়াসমিনের জন্য বন্ধ হয়। মা কিন্তু নিয়মিত ছোটদার সংসারে যেতে লাগলেন। মা তো আর খালি হাতে যান না, পুত্রধনের জন্য চাল ডাল আনাজপাতি অবকাশ থেকে যা যোগাড় করতে পারেন নিয়ে যান। বাবা যখন বাড়ি থাকেন না, ছোটদা ঢুঁ মারেন অবকাশে। ঢুঁ অবশ্য অহেতুক মারেন না, প্রয়োজন হলেই। বাবার নিষ্ঠুরতার কথা মা ভাবেন আর বলেন, এই মানুষটা মানুষ নাকি পাথর? মার অক্লান্ত সাধ্য সাধনার পর বাবাকে খানিক নরম করে মা একদিন অন্তত এইটুকু রাজি করালেন যে ছোটদা বউ নিয়ে অবকাশে ঢুকবেন কিন্তু কোণের একটি ছোট ঘরে ওরা বাস করবেন,সারা বাড়িতে অবাধ পদচারণার কোনও অধিকার ওদের থাকবে না। বিয়ে যখন করেইছো, বউ যখন আর ছাড়বেই না মনস্থ করেছো, যদিও এ বয়সে বিয়ে করার কোনও যুক্তি নেই, পেটালে গাধাও মানুষ হয়, তুমি হওনি—এখন দেখ লেখাপড়া শেষ করে ভবিষ্যতে ডাল ভাতের যোগাড় করার ব্যবস্থা করতে পারো কি না, এরকম ভেবেই বাবার রাজি হওয়া। মা ওঁদের জন্য দাদার ঘরের পেছনে একটি ছোট ঘর যে ঘরে মা নিজে থাকতেন গুছিয়ে দিলেন, কাপড় চোপড় রাখার একটি আলনা দাদার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া দরজাটি বন্ধ করে দরজার সামনে রাখলেন। ছোটদার পুরোনো খাটটি দাদার ঘর থেকে এনে ছোটঘরে পাতা হল। ছোটদা বললেন আয়নার টেবিলটি তাঁর ঘরে যে করেই হোক নিতে হবে। মার বিয়ের সময় খাট পালঙ্ক ইত্যাদির সঙ্গে নানা এই টেবিলটি মাকে উপহার দিয়েছিলেন। কাঠের ফুল পাতার নকশাঅলা বহিরাবরণ, অন্তস্তলের আয়নাটি সামনে পেছনে দোল খায় নাড়লে, দুপাশে ছোট দুটো তাক, দুটো ড্রয়ার—সিংহি সিংহি এই চারপেয়ে টেবিলটি বাবার ঘর থেকে নিজে টেনে ছোটঘরে দিয়ে এলেন মা। আঁচলে মুছে দিলেন আয়নায় জমা ধুলো। গীতা টেবিলের সামনে বসে ঘন্টা খরচ করে সেজে ছোটদার সঙ্গে প্রায় বিকেলে বাইরে যান। ওঁদের বাইরে যাওয়ার দিকে আমি তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থাকি। এরকম আমিও যদি যেতে পারতাম!
যদিও বাবা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ছোটদা আর তাঁর বউএর মখু দর্শন তিনি করবেন না, কিন্তু ওরা অবকাশে পাকাপাকি বসত শুরু করার ঠিক দুদিন পর সকালে গোসল সেরে সার্টপ্যাণ্টজুতোটাই পরে, সর্ষের তেলে চোবানো মাথাভর্তি কোঁকড়া চুলগুলো আঁচড়ে বৈঠকঘরে পায়ের ওপর পা তুলে বসলেন, বসে ডাকলেন আমাকে। বাবা ডাকছেন, এর অর্থ বাড়ির যেখানেই থাকো না তুমি, যে কাজই কর না, পড়ি কি মরি ছুটে আসতেই হবে। বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, ওই দুইটারে ডাক। ওই দুইটা কোন দুইটা? এই প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল আমার, করিনি। বাবা যেহেতু আদেশ দিয়েছেন, আমাকে বুঝে নিতে হবে ওই দুইটা বাড়ির কোন দুইটা। কারণ এ আমার, কেবল আমার কেন, বাড়ির সবারই জানতে হবে বাড়ির কোন দুইটা কে এ সময় বাবা ডাকতে পারেন। ছোটদার ঘরে ঢুকে চাপা স্বরে বললাম, যাও, ডাক পড়ছে, একজনের না কিন্তু, দুইজনের। ছোটদার মখু মুহূর্তে বিবণর্ হয়ে উঠল, ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে লুঙ্গির গিঁট বাধঁতে বাধঁতে।
গীতাকে ,গীতা বিমূঢ় বসা বিছানায়, সঙ্গে আসার অনুরোধ করতে করতে একবার দরজার কাছে, আবার ফিরে বিছানার ধারে, হাঁটছিলেন। “নাসরিন”—বিকট শব্দে দ্বিতীয় ডাকটি এল বৈঠক ঘর থেকে, এর অর্থ হল ওই দুইটার এত দেরি হচ্ছে কেন! অবশেষে, দুজন যখন বড় হিম্মতের সঙ্গে নিজেদের হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে সাক্ষাৎ হুতাশনের সামনে দাঁড় করালো, দরজার ফাঁকে চোখ কান নাক সব পেতে থাকলাম। গীতা উবু হয়ে বাবার পা ছুঁয়ে কদমবুসি করল। হিন্দু মেয়ের কদমবুসি, প্রণামের মতই, গীতার জন্য নতুন কিছু নয়। বাবা কেশে গলা পরিষ্কার করে, যদিও পরিষ্কারই ছিল গলা, এমন কোনও জমা কফ ছিল না গলায়, বললেন ছোটদার দিকে যতটা সম্ভব চোখ রঙিন করা সম্ভব,করে, জীবন কিরম বুঝতাছ? বিয়া করছ,লেখাপড়া চাঙ্গে উঠছে, গঞ্জে গিয়া সংসার করছ, একশ টাকা মাস চাকরি করছ, কী চাকরিডা করছ শুনি? কুলিগিরি। ঠিক না? কুলিগিরি ছাড়া তুমার ওই বিদ্যায় আর কি পাইবা! নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছ। তাতে কার কি ক্ষতি হইছে? আমার কিছু হইছে? আমার কিচ্ছু হয় নাই। হইছে তুমার। পাগলেও নিজের বুঝ বুঝে, তুমি বুঝ নাই। পাগলের কাছে গিয়া দেখ তার টাকা যদি নিতে চাস, দিবে? দিবে না। তার খাবার যদি নিতে চাস, দিবে? দিবে না।
বাবা খানিক থেমে, বুঝি না অপেক্ষা করে কি না মূর্তিমান দুইটার মখু থেকে নিদেনপক্ষে কোনও শব্দের, বলেন, আনন্দমোহনে ভর্তি হইয়া আয়, ইন্টারমিডিয়েটে তো থার্ড ডিভিশন পাইছস, চান্স তো পাইবি না কিছুতেই, তবু দেখ চেষ্টা কইরা। যাওয়ার সময় আমার চেম্বার থেইকা টাকা লইয়া যা। বাবা এবার গীতার দিকে চোখ নাক দাঁত সব কুঞ্চিত করে বলেন, কি ভাইবা এই কাজটা করছ? নিজের ভবিষ্যতের কথা তুমিও ভাব নাই? গীতার চোখদুটো দেখা যাচ্ছে না যেহেতু মেঝের দিকে চোখ, চুলের ডালি দৃশ্যমান নয় যেহেতু আঁচলে আবৃত মাথা, ঠোঁট এমনিতেই গীতার ছোট, ছোট মুখের ছোট ঠোঁট আরও ছোট হয়ে আছে। এবারও খানিক থেমে, কফ নেই তবু ঝেড়ে,বাবা বলেন গীতা, আমার মেয়ে দুইটার লেখাপড়া আছে, ওদের সাথে আড্ডা দিতে যেন না দেখি। কথা বুঝছ? গীতা মাথা নাড়ে, বুঝেছে সে। বাবা সশব্দে উঠে আমার ঘরের লাগোয়া ওদের দরজাটি সশব্দে বন্ধ করে ভেতর বারান্দার দিকের দরজা সশব্দে খুলে যাওয়া আসা এ দরজা দিয়েই করার আদেশ দিয়ে সশব্দেই বেরিয়ে গেলেন। আদেশ মানা ছাড়া আর উপায় নেই ছোটদার। তিনি বাংলা অনাসের্ আনন্দমোহনে ভর্তি হয়ে বাড়ি ফিরলেন। বাবা তাঁর বাংলায় ভর্তি হওয়ার ঘটনাটি শুনে ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে সাতদিন কাটালেন আর বলে বেড়ালেন বাংলায় পইড়া কয়ডা বেডা মানুষ হইছে? বাংলা বিশারদেরা বড়জোর বুদ্ধি কইরা গরুর গাড়ি চালাইতে পারে, আর কিছু না। ওই বলাটুকুই, অনেকটা হাল ছেড়ে দেওয়া বাবা ছোটদাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বিজ্ঞানের কোনও