দূরত্ব
ছিয়াশি সালের শেষদিকে ঘটনাটি ঘটে। দেড়মাস পর ফিরবে বলে রুদ্র মোংলায় চিংড়ির ব্যবসা দেখতে গেলে যেহেতু আমার কিছু করার নেই ঢাকায়, ময়মনসিংহে চলে যাই। ময়মনসিংহ থেকে দেড়মাস পর ফিরে দেখি রুদ্র ফেরেনি এখনও। কবে ফিরবে জানতে চাইলে মেরি বলে আরও দুসপ্তাহ দেরি হবে। রুদ্রহীন ঘরটিতে একলা বসে থাকি, ঘরটি খুব খালি খালি লাগে। টেবিলে কবিতার খাতা পড়ে আছে, যেন লিখছিল, এই মাত্র উঠে সে অন্য ঘরে গেছে, এক্ষুনি ফিরে আবার লিখবে কবিতা। আমি চোখ বুজে অন্য ঘর থেকে রুদ্রর ফেরার অপেক্ষা করি মনে মনে। মনে মনে তার একটি হাত রাখি আমার কাঁধে, শুনি একটি খুব চেনা কণ্ঠস্বর, কখন এলে? সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছি তোমার! কাঁধের হাতটি ক্রমশ নেমে আসছে বুকে, আরেকটি কাঁধেও আরেকটি উষ্ণ হাত, সেই হাতটিও নেমে আসছে। গা শিথিল হয়ে আসছে আমার, আমার গালে তার দাড়ি- গাল ঘসতে ঘসতে বলছে, সোনা আমার মানিক আমার, বউ আমার, তোকে ছাড়া আমি বাঁচি না রে! আমার তৃষ্ণাতর্ ঠোঁট জোড়া সিক্ত হতে চাইছে, ঠোঁটে তার দীর্ঘ দীর্ঘ উষ্ণ সিক্ত চুম্বন। অভূত এক শিহরণ আমার গা কাপাঁচ্ছে। মাথাটি এলিয়ে পড়ে টেবিলের খাতায়। অনেকক্ষণ ওভাবেই পাওয়ায় না পাওয়ায় চণূর্ হই। খাতাটির শেষ পাতায় লিখি, আমার ভাল লাগছে না, ভাল লাগছে না। কেন আসোনি তুমি। বউ ছেড়ে এত দীর্ঘদিন কি করে থাকো তুমি। বড় একা লাগে আমার। তুমিহীন একটি মুহূতর্ও আমার কাছে অসহ্য। আমার আপন কেউ নেই এক তুমি ছাড়া। আমার জীবন কাটে না তুমি ছাড়া। হয় আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও, নয় তুমি আমার কাছে চলে এসো। গোছানো বিছানাটির দিকে তাকিয়ে থাকি এক শরীর তৃষ্ণা নিয়ে। একটি বেদনার্ত হাত এগিয়ে যায় বিছানার চাদরে রুদ্রর ফেলে যাওয়া স্পর্শ পেতে, বুলোতে থাকে চাদর। ফেলে যাওয়া ঘ্রাণ পেতে বালিশে মুখ চেপে তার ছিঁটেফোঁটা শুঁকতে শুঁকতে বলি, কবে আসবে তুমি, আমার আর ভাল লাগে না একা থাকতে। তুমি ফিরে এসো প্রাণ। আমার বক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার চক্ষে ফিরিয়া এসো, আমার নিতিসুখ ফিরে এসো। আমার সর্বসুখ তুমি ফিরে এসো। বালিশ ভিজে যায় শব্দহীন কান্নায়। সচকিত হই বাড়ির মানুষদের সম্ভাব্য কোতূহলের কথা ভেবে, দুহাতে চোখ মুছে, মেরিকে ডেকে, আমি না হয় দুসপ্তাহ পর ফিরব, বলে দরজার দিকে এগোতে নিলে ও বলে, এক্ষুনি যাচ্ছ বৌদি? বসো, চা খেয়ে যাও। শুষ্ক-হাসি ঠোঁটে, বলি, না চায়ের তৃষ্ণা নেই।
রাজাবাজারের মোড় থেকে একটি রিক্সা নিয়ে মহাখালি বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে থাকি। রুদ্রহীন ঢাকা শহর আমার কাছে ধু ধু মরুর মত লাগে। মহাখালি থেকে হঠাৎ ধুত্তরি বলে রিক্সা ঘুরিয়ে নয়াপল্টনের দিকে যাই। ভাল লাগে না ময়মনসিংহ যেতে। অবকাশে আমি অনাকাঙ্খিত অতিথি। মা প্রায়ই বলেন, বাপ মার অমতে বিয়া করছস। খুব সুখে না থাকবি কইছিলি! এখন এত বাপের বাড়ি আসতে হয় কেন? বাবার চোখের সামনে পড়লে কঠোর দৃষ্টি ছুঁড়ে দেন, মাকে ডেকে বলেন, ওই ছেড়ি আমার বাসায় আইছে কেন? ওরে বাসা থেইকা ভাগাও। আমার বাসায় আসার ওর কি অধিকার আছে? আমি কি কামাই করি আরেক বেডার বউরে খাওয়ানির জন্য নাকি? ওরে খাওন দিবা না। নয়াপল্টনে ছোটদার বাড়িতে উদাস বসে রুদ্রকে ভাবি, দিন রাত কি অক্লান্ত পরিশ্রম করছে বেচারা। নিশ্চয়ই নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। নিশ্চয়ই বউটির কথা মনে করে যত শীঘ্র সম্ভব ফিরে আসতে চাইছে। পারছে না বলে নিশ্চয়ই তার কষ্ট হচ্ছে খুব। ইচ্ছে করে তার কপালের ঘাম মুছিয়ে দিই আঁচলে। আমার এই মগ্নতায় টোকা দিয়ে গীতা বলে, কি রে, কি ভাবস? তর জামাই কই? তারে লইয়া আইলি না কেন?
আমার বুঝি একলা আসা মানা? সবসময় জামাই লইয়া আইতে হইব?
কি, রাগারাগি হইছে নাকি!
নাহ! রাগারাগি হইব কেন!
তাই তো মনে হইতাছে। জামাই আছে ঢাকায়?
নাহ।
গীতার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। টুলুর ঠোঁটেও হাসি। এ বাড়িতে গীতার ছোট ভাই টুলু থাকে। কালো-ছেলে মোটা-ছেলে, নাকের-নিচে-শুঁয়োপোকা-মোচ- ছেলে টুলুকে বাংলাদেশ বিমানে চাকরি দিয়ে ঢাকায় এনে ছোটদা নিজের বাড়িতে রাখছেন। বাঁকা হাসিটি নিয়েই টুলু হাঁক দেয় এক গেলাস জল দে তো নার্গিস। নার্গিস গেলাসে পানি নিয়ে টুলুর হাতে দেয়। ওর সঙ্গে চোখাচোখি হয় একটি