ডাক্তারি
এক বছরের ইন্টার্নশিপের জন্য ডিউটি ভাগ করা হয়ে গেছে। যে কোনও একটি বিষয়ে ফিক্সড ডিউটি করতে হয়। যে বিষয়টিকে আমি প্রধান বলে মনে করি, সেই বিষয়ে। বেশির ভাগ মেয়েরা স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগে ফিক্সড ডিউটিটি নিয়েছে। মেডিসিন সার্জারি এক মাস করে হলেও স্ত্রীরোগে চার মাস। যৌনাঙ্গ ঘাঁটাঘাঁটি করা আমার বিশেষ পছন্দের ছিল না ছাত্রী থাকাকালীন, কিন্তু এই বিষয়টিকেই আমি প্রধান বিষয়ে হিসেবে নির্বাচন করে ফিক্সড ডিউটি নিই এই বিভাগে। চারমাসে চার মিনিট ফাঁকির কোনও সুযোগ নেই। ফাঁকি দেওয়া মানে নিজেকে ফাঁকি দেওয়া। ডাক্তারি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে প্রতি বছর বিদেশের মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার আসে। এ দেশে চাকরি করতে গেলে এ দেশে ডাক্তারি প্রশিক্ষণ নিতে হয়, নিয়ম এমন। প্রথম দিনই পরিচয় হয় মস্কো থেকে পাশ করে আসা দিবালোক সিংহের সঙ্গে। দিবালোক কমরেড মণি সিংহের ছেলে। সুসং দুর্গাপুরের মণি সিংহ। হাজং বিদ্রোহের মণি সিংহ। দুঃস্থ দরিদ্র মানুষের জন্য পুরো জীবন উৎসর্গ করা মণি সিংহ। সাধারণত বিদেশ থেকে পাশ করে আসা ডাক্তারদের আহামরি কিছু ভাবা হয় না। ভাবা হয় না কারণ তাদের মাথায় বিদ্যে থাকলেও হাতে দক্ষতা কম। বিদেশে এদেশের মত বেওয়ারিশ লাশও পাওয়া যায় না ইচ্ছেমত কেঁটে ছিঁড়ে বিদ্যেটি শেখার। এমন দরিদ্র রোগীর ভিড়ও নেই অন্য দেশে যে নির্ভাবনায় যখন তখন রোগির শরীরে গুঁতোগুঁতি করা যাবে, কোনও রোগী টুঁ শব্দ করবে না। আর অপারেশন থিয়েটারে সার্জনদের সহযোগিতা করার যে সুযোগ চতথুর্ বর্ষ থেকে আমাদের মেলে সেই সুযোগ তারা বিদেশের হাসপাতালে পায় না। খোদ বিলেত থেকে ডাক্তারি পাশ করে আসা এক মেয়েকে অধ্যাপক জোবায়েদ হোসেন যখন জিজ্ঞেস করলেন, কি মেয়ে, সিজারিয়ানে এসিস্ট করতে পারবা? মেয়ে মাথা নাড়ে, পারবে না। কোনওদিন করেনি। হেসে, জোবায়েদ হোসেন দেশি কাউকে ডাকেন। বিদেশিগুলোর পড়া বিদ্যে, দেখা বিদ্যে, করা বিদ্যে নেই। দিবালোক সিংহের পড়া বিদ্যে দেখা বিদ্যে থাকলেও আমি তাকে খাতির করি। প্রসব কক্ষে রোগির কাটা যৌনাঙ্গ কি করে পরতে পরতে সেলাই করতে হবে হাতে ধরে শিখিয়ে দিই তাকে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজটিতে ভাল লেখাপড়া হয়, এ কলেজ থেকেই প্রতিবছর ছাত্রছাত্রীরা দেশের অন্য যে কোনও কলেজের ছাত্রছাত্রীর চেয়ে পরীক্ষায় ভাল ফল করে। আমাদের আগের বছরে রাজিব আহমেদ হয়েছিলেন প্রথম। আমাদের বছরে এম-ষোল ব্যাচের প্রতিটি প্রফেশনাল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে মনসুর খলিল। এ কলেজটি ভাল হলেও এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে বেশির ভাগ সময় ছাত্র আন্দোলনের কারণে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া কম হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ বিলেতি পরিদর্শকদের অনুমোদন পেয়েছে, এ কলেজ পায়নি। পরিদর্শকবৃন্দ আসার আগে এই কলেজ হাসপাতাল দুটোই ধুয়ে মুছে তকতক করা হয়েছিল, ডাক্তার ছাত্রছাত্রী সবাই ধোয়া কাপড় পরে পরিপাটি হয়ে নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলেছিল সেদিন, তারপরও মহামূল্যবান অনুমোদন জোটেনি, কারণ পরিদর্শকবৃন্দ একটি নেড়ি কুকুরকে বসে থাকতে দেখেছেন হাসপাতালের বারান্দায়। অনুমোদন পাওয়া মানে এ কলেজ থেকে পাশ করে বিলেতের কলেজে বাড়তি লেখাপড়া করার অনুমতি পাওয়া। অনুমোদন পাওয়া হয়নি বলে আমরা খুব একটা মুষড়ে পড়িনি। মনসুর খলিল তো নয়ই। যে ছেলে বাড়ি আর কলেজ ছাড়া আর কোথাও নড়তে চায় না, তার জন্য বিলেত কোনও স্বপ্ন নয়। মনসুর খলিল দেখতে আস্ত একটি পাহাড়। ওজন দুশ কিলোর মত। খায় আর লেখাপড়া করে। শরীরটির লজ্জায় সে বাইরে কোথাও বেরোয় না, কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা বলে না। মাঝে মাঝে আমি যেচে কথা বলি মনসুরের সঙ্গে। অবশ্য বেশির ভাগই মজা করতে। করি সাফিনাজ সঙ্গে থাকলে। আমাদের দেখতে ভাল লাগে কথা বলতে গিয়ে মনসুর খলিলের ফর্সা মুখ টি যখন পাকা আমের মত লাল হয়ে ওঠে। হাসপাতাল এলাকাটিতে আমি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি নিজের পরিচয় নিয়ে। এখানে আমার মধ্যে আর একটি ডাক্তার-ছেলের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আমি যদি মেধায় দক্ষতায় ছেলেটির চেয়ে ভাল হই, এখানে আমি মর্যাদা পাবো ছেলের চেয়ে বেশি। এখানে আমরা নারী পুরুষের যৌনাঙ্গ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করে অভ্যস্ত, ঘেঁটে অভ্যস্ত যে শব্দ মুখে উচ্চারণ করা এই এলাকার বাইরে মানা সে সব শব্দ উচ্চারণ করতে এই এলাকায় লজ্জা বা দ্বিধার লেশমাত্র কারও জিভে থাকে না। ইন্টানির্ হয়েই হাসপাতালের ডক্টরস ক্যান্টিনে আমি যেতে শুরু করেছি। ডিউটির ফাঁকে ক্ষিধে লাগলে চা সিঙ্গারা খাই। সময় থাকলে আড্ডা আর টেবিল টেনিস দুটোই চলে। এখানে পুরুষ ডাক্তারের গায়ে যদি আমার গা লাগে বা হাতে হাত লাগে তবে আমি নষ্ট হয়ে গেছি বলে মনে করা হয় না। আমার বাইসেপ ব্র্যাকিতে ওর ট্রাইসেপ ব্র্যাকির টাচ লেগেছে বলেই বলা হয়। এখানে সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি একজন ডাক্তার। মাঝে মাঝে ওয়ার্ডের রোগীরা ভুল করে সিস্টার ডাকলে অবশ্য শুধরে দিতে হয়, যে আমি নাসর্ নই। আর্কিটেকচারে পড়তে না পারার জন্য যে আফসোসটি ছিল আমার, সেটি ডক্টরস ক্যান্টিনের চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে যায়। ডাক্তার হয়ে আমি ভুল করিনি, এ বিশ্বাসটি শক্ত হয়ে মনের মাটিতে গেড়ে বসে, যদিও ডাক্তারি পড়তে গিয়ে আমার সাহিত্য চর্চা গোল্লায় গেছে, শখের যে কবিতা, সেও আর লেখা হয় না। কবিতা লিখে নিজের একার আনন্দ হয়, কিন্তু চিকিৎসা করে হাজার মানুষকে আনন্দ দিতে পারি। হাসপাতালে সব ধরনের রোগী আসে, উচ্চজ্ঞবত্তরা কেবিন ভাড়া করে, মধ্যবিত্তরা সামর্থ হলে করে, দরিদ্র থাকে ওয়াডের্। হাসপাতালে ওষুধের অভাব, সব ওষুধ সরকার দেয় না। সেই ওষুধগুলো রোগীদের কিনে আনতে হয় বাইরে থেকে। কিন্তু দরিদ্র রোগীর পক্ষে বাইরে থেকে ওষধু কেনা সম্ভব নয়। উচ্চজ্ঞবত্ত বা মধ্যবিত্ত রোগিকে যখন কেনার জন্য ওষুধের নাম লিখে দিই কাগজে, একটির দরকার হলে লিখি পাঁচটি। পাঁচটির দরকার হলে লিখি দশটি। লিখি, কারণ উচ্চজ্ঞবত্তর জন্য ব্যবহারের পর বাকি যা থাকবে তা দেব দরিদ্র রোগিকে। কোনও রোগিকে জানানো হয় না যে আমরা ডাক্তাররা গোপনে গোপনে এই কাজটি করি, দরিদ্র বাঁচাই। দরিদ্রদের জন্য সন্ধানীতেও দৌড়োই। দরিদ্ররা রক্তের ব্যাংক থেকে টাকা দিয়ে রক্ত কিনতে পারে না, দরিদ্রদের রক্ত লাগলে সন্ধানী থেকে এনে নিই। কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা সন্ধানী নামের এই সংস্থাটি দরিদ্রদের সাহায্য করতেই খুলেছে। একদিন সন্ধানী আপিসে গিয়ে আমি চোখ দান করে আসি। মৃত্যুর পর চোখদুটো যেন কাজে লাগে কোনও অন্ধের। ওদের বলি, আমি দেহদান করব। মৃত্যুর পর আমার দেহ যেন মেডিকেল কলেজের শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে পাঠানো হয়। সন্ধানীতে দেহদানের কোনও কাগজপত্র নেই যে দান করতে পারি। সম্ভবত বেওয়ারিশ লাশের আধিক্য বলে এই প্রয়োজনটির কথা সদস্যরা উপলব্ধি করে না। আমার