আবার একদিন পীর বাড়ি

আবার একদিন পীর বাড়ি

পীরবাড়ি যাওয়া হয় আমার একদিন। এবার মার সঙ্গে নয়। তিনজন বান্ধবীর সঙ্গে। হোস্টেলে

আবার একদিন পীর বাড়ি

 

পীরবাড়ি যাওয়া হয় আমার একদিন। এবার মার সঙ্গে নয়। তিনজন বান্ধবীর সঙ্গে। হোস্টেলে মেয়েরা একটি মিলাদের আয়োজন করার ইচ্ছে করেছে। যদিও উদ্ভট শখ এটি, ডাক্তারি পড়া মেয়েদের আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা গাওয়ার সময়ও নেই বেশি, আর এটি গাওয়ার কারণ খুঁজেও তারা পাবে না কিছুই, তবু। উদ্ভট হলেও যেহেতু শখটি হয়েছে একজন মৌলবির দরকার তাদের। মৌলবি খুঁজছে মেয়েরা, এদিক ওদিক খুঁজে ব্যথর্ হয়ে শেষে আমাকে ধরলো, যেহেতু শহরের মেয়ে আমি, চেনা জানা থাকতে পারে কেউ। আমি কথা দিই মৌলবি যোগাড় করে দেব, আবেগে আবেগে আবার এও বলে ফেলি, দেব তো দেব মেয়ে-মৌলবি দেব একখানা। মেয়েদের হোস্টেলে মেয়ে-মৌলবি এসে মিলাদ পড়িয়ে যাবে। এর চেয়ে ভাল প্রস্তাব আর কি হতে পারে। তবে আমি যেহেতু আল্লাহ রসুলে মিলাদে মসজিদে বিশ্বাসী নই, আমি মিলাদের মিষ্টি খাওয়া ছাড়া আর কিছুই করব না। ওই আল্লাহুম্মা সাল্লিআলা সাইয়েদেনায় শরিক হওয়ার কোনও রুচি নেই আমার। ঠিক আছে, তাই সই। আমার সঙ্গে রওনা হয় সাফিনাজ, হালিদা আর পারুল। চারজন দুটি রিক্সা নিয়ে নওমহলের পীরবাড়ি পৌঁছই। বহু বছর পর পীরবাড়ি আসা আমার। ছোটবেলায় যেমন গা ছমছম করত এ বাড়ি ঢুকতে, এই বড়বেলাতেও সেই গা ছমছমটি যায়নি। যেন এ পৃথিবী নয়, পৃথিবীর বাইরে কোনও এক জগতে ঢুকছি। এই জগতের সবাই আমাদের দিকে বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টিগুলো অতিক্রম করে অন্দরমহলে ঢুকি, খুঁজি ফজলিখালাকে। ফজলিখালা আমাকে দেখে, লক্ষ করি, খুব অবাক হননি, যেন কোনও একদিন এবাড়িতে আমার আসারই কথা ছিল। ফজলিখালাকে, যেহেতু তিনি আমার খালা, যেহেতু এ বাড়ির সবাই সবকিছু বেজায় অদ্ভুতুড়ে হলেও তিনি পুরোটা নন, বলি যে আমাদের একটি মেয়ে-মৌলবি দরকার, আজ বিকেলেই। মেয়েদের হোস্টেলে মিলাদ পড়িয়ে আসবে। এই আহবানে ফজলিখালার মুখে হাসি ফোটার কথা, কারণ গোটা শহরে এই একটি জায়গাতেই, এই পীরবাড়িতে, মেয়ে-মৌলবি পয়দা করা হয়, আর এই মেয়ে-মৌলবির চাহিদা আছে বাজারে, কেউ কেউ এসে মেয়ে-মৌলবি পাওয়ার জন্য তদবির করে অথবা করতে পারে। ফজলিখালার অ-বিস্মিত অ-খুশী মখু টির সামনে দাঁড়িয়ে তাড়া দিই, এক্ষুনি কোনও একটি মেয়েকে যেন আমাদের হাতে দেওয়া হয়, আমাদের সময় নেই বেশি। যে কোনও একটি মেয়ে, হুমায়রা বা সুফায়রা বা যে কেউ। আমার এই প্রস্তাব শুনেও অবাক হন না ফজলিখালা, কিন্তু হাসেন। সম্ভবত তাঁর দুটো কন্যার নাম উল্লেখের কারণে এই হাসিটি। ফজলিখালার মখু টি আগের মতই সুন্দর। হাসিটি সেই আগের মতই নির্মল। সেই হাসিটি যখনও মিলিয়ে যায়নি, হুমায়রা এসে উপস্থিত। আঁটসাঁট জামাটি থেকে হুমায়রার পেটের থাক থাক চবির্ প্রায় ফেটে বেরোতে চাইছে।বড় ওড়নায় ঢেকে রেখেছে মাথা। হুমায়রার ওড়না ঢাকা মাথাটি সামনে পেছনে নড়ে যখন আমরা বলি একজন মেয়ে-মৌলবি দরকার আমাদের। এই হুমায়রা, যে নিজের প্রেমিক প্রবর ফুপাতো ভাইকে মেদেনিপুর থেকে আনিয়ে হলেও নিজের বিয়ে ঘটিয়েছে, যখন পীরবাড়ির সব যুবতি মেয়েরা আল্লাহর পথে নিজেদের উৎসর্গ করে নিজেদের বিয়ে থা সংসার সন্তান ইত্যাদি জলাঞ্জলি দিয়েছিল যেহেতু পীর নিজে ঘোষণা করেছিলেন এই শেষ জমানায় বিয়ে করার কোনও মানে হয়না। কিন্তু এই হুমায়রা, পীরের নাতনি হয়ে, পীরের ঘোষণার অবাধ্য হয়েছে প্রথম, অবাধ্য হয়েছে ঠিক বিয়ের বয়সে এসে। ওদিকে ঘোষণা পালন করতে গিয়ে হুমায়রার চেয়ে বয়সে বড় যুবতীকুল আইবুড়ি রয়ে গেছে। এই হুমায়রা, যার বিয়ের কারণে পীরের কাছে আসা শেষ জমানায় বিয়ে না করার জন্য আল্লাহর নির্দেশটি এক রাতেই পাল্টো যায়, পাল্টো গিয়ে দাঁড়ায় আল্লাহ বলেছেন শেষ জমানায় সঙ্গী বেছে নাও খুব তাড়াতাড়ি, বান্দারা শেষ জমানায় বিয়ে করলে আল্লাহতায়ালা বড় খুশী হবেন। আল্লাহতায়ালা বড় ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পাল্টান। এই পীরবাড়ির সদস্যদের সুবিধে অসুবিধে অনুযায়ী সিদ্ধানগ্তুলো নেন তিনি। হুমায়রা আমাদের আকাঙক্ষাটি শুনে ঠিক আছে, ব্যবস্থা করছি, যা চাইছ তা পাবে বলে আমাদের অপেক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে অন্দরমহলের অন্দরে চলে গেল। ফজলিখালাও অদৃশ্য। সম্ভবত হুমায়রা নিজে বোরখা পরে আসছে আমাদের সঙ্গে যেতে। কিন্তু ওভাবে প্রায় পঁচিশ মিনিট দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পর নিজে তো সে বোরখা পরে এলই না আমাদের সঙ্গে হোস্টেলে যেতে, বরং আমাদের নিয়ে স্বয়ং পীর আমিরুল্লাহর ঘরে ঢুকল। পীর আমিরুল্লাহ শাদা আলখাল্লায় শাদা টুপিতে বসেছিলেন বিছানায়। তাঁর মেহেদি লাগানো দাড়ি নড়ছিল যখন তিনি আমাদের দেখে মাথা নাড়ছিলেন আসুন আসুন ভঙ্গিতে। হুমায়রা দাঁড়িয়ে রইল পাশে। পীর ছাড়াও পীরের কন্যা জোহরা ছিল ঘরে, আর কিছু আইবুড়ি। আমাদের এ ঘরে ঢোকানোর কারণ আমার কাছে স্পষ্ট নয়। অনুমান করি, মেয়ে-মৌলবি পেতে হলে কেবল ফজলিখালা আর হুমায়রার অনুমতি যথেষ্ট নয়, আমাকে স্বয়ং পীর আমিরুল্লাহর কাছে আবেদন পেশ করতে হবে আমাকে, তাঁর অনুমতি মিললেই আমাদের কাজ হাসিল হবে। কিন্তু ঘরে ঢোকার পর পীর আমিরুল্লাহ কিছু জানতে চাইলেন না আমরা কেন এসেছি, কি কারণ। আদৌ তিনি আমাদের এ বাড়িতে আগমনের উদ্দেশ্য জানেন কি না আমার সন্দেহ হয়। সম্পণূর্ অপ্রাসঙ্গিকভাবে, আর কাউকে না হলেও, আমাদের, আমাকে সাফিনাজকে, হালিদা আর পারুলকে হতবাক করে বলেন, তারপর বুঝলেন কি না আল্লাহর পথে আসা খুব সহজ কথা নয়, দুনিয়াদারির মোহ ত্যাগ যারা করতে পেরেছে, তাদের জন্য আল্লাহতায়ালা আখেরাতে সর্বোচ্চ সম্মানের আয়োজন করেছেন। ঘরের অন্যান্যদের মখু থেকে আহ আহ শব্দ ওঠে। সর্বোচ্চ সম্মানের জন্য তৃষ্ণা সেই আহ শব্দে। দুনিয়াদারির লেখাপড়া, দুনিয়াদারির সাময়িক সংসার, মায়ার জাল ছিঁড়ে যারা বেরিয়ে আসে তাদের জন্য কি ধরণের সম্মান অপেক্ষা করছে পরকালে তার পুঙ্খানপুুঙ্খ বর্ণনা করেন এবং দুনিয়াদারিতে ডুবে থাকলে আল্লাহতায়ালা কি ধরনের শাস্তি লিখে রেখেছেন তারও ভয়াবহ বিবরণ দিতে তিনি ভোলেন না। বর্ণনা দীর্ঘ। বিবরণ অতিদীর্ঘ।সাফিনাজ, হালিদা আর পারুল বার বার আমার দিকে কুঞ্চিত চোখে তাকাচ্ছে, বুঝে পাচ্ছে না কি ঘটছে এখানে, ফিসফিস করছে, চল চল। দেরি হয়ে গেল। আমিও ঠিক বুঝে পাচ্ছি না কেন আমাদের এখানে দাঁড় করিয়ে আল্লাহতায়ালার শাস্তি এবং পুরস্কারের আদ্যোপান্ত জ্ঞান দেওয়া হচ্ছে। হুমায়রাকে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করি যে আমাদের সময় নেই সময় খরচ করার। মেয়ে-মৌলবির জন্য এসেছি আমরা, এসব শুনতে নয়। আমার ইশারার দিকে ফিরে তাকায় না হুমায়রা। বড় বিব্রত বোধ করি বান্ধবীদের সামনে। মেয়ে-মৌলবি যোগাড় করে দেবার লোভ দেখিয়ে এদের এই বাড়িতে নিয়ে এসে এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আটকে পড়েছি। পীর আমিরুল্লাহ আমাদের দিকে আড়চোখে মাঝে মাঝে তাকান, বাকি সময় তিনি মেঝে নয়ত সিলিংএর দিকে, উঠোনের গাছগাছালি নয়ত আইবুড়িদের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন আল্লাহতায়ালার গুণাগুণ। যেন কোনও মানুষের মখু থেকে নয়, রবোটের মুখ থেকে বেরোচ্ছে সব। কোরান হাদিসের প্রতিটি শব্দ আমিরুল্লাহ মুখস্থ ঠোঁটস্থ অন্তঃস্থ করে ফেলেছেন, পরীক্ষা সামনে এলে


Rx Munna

447 Blog posts

Comments