মেয়েটির সঙ্গে কলেজের শেষ দিকে আমার বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল সে শিপ্রা, শিপ্রা চৌধুরি। শিপ্রার দুটি জিনিস আছে, যে জিনিসটি আমাকে আকর্ষণ করে তা তার রসবোধ আর যে জিনিসটি বিকর্ষণ করে তা হল যে কোনও কিছু নিয়ে তার উদ্বিগ্নতা। দেখছে ক্লাসের একটি মেয়ে লিভারের অসুখগুলো পড়ছে শিপ্রা সঙ্গে সঙ্গেই উদ্বিগ্ন, কেন মেয়েটি লিভারের অসুখ পড়ছে, নিশ্চয়ই এ নিয়ে পরীক্ষায় প্রশ্ন থাকবে! তক্ষুনি সে রাত জেগে লিভারের অসুখ পড়া শুরু করে দিল। কেউ একজন বলল, হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া না করলে মেডিকেলের লেখাপড়া ঠিক হয় না। যেই না বলা, যদিও বাড়িতে বসে শিপ্রার লেখাপড়া চমৎকার হচ্ছিল, ব্যাগে কাপড় চোপড় ভরে সে হোস্টেলে রওনা হল। শিপ্রার পড়ার সঙ্গী ছিল একটি ছেলে। ভাল ছাত্র হিসেবে ছেলের নাম ছিল। এরপর আরও ভাল ছাত্র হিসেবে যখন আরও কজনের নাম হল, তখন শিপ্রা সেই আরও ভালর দিকে নজর দিতে শুরু করল, মুখ চোখ ওর বিষাদাচ্ছত। কেন সে সেই আরও ভালদের পাচ্ছে না সঙ্গী হিসেবে! শিপ্রার স্বস্তি নেই সহজে। শিপ্রার বাড়ি শহরে। খাগডহর পার হয়ে জেলখানা, জেলখানার কাছে পুরোনো বোম্বাই কলোনি, সেখানে তার মা আর সে থাকে। বাবা অনেক আগেই শিপ্রার মাকে ছেড়ে চলে গেছে। শিপ্রার মা চাকরি করেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাপাই নবাবগঞ্জের মানুষ তিনি, বদলির চাকরিতে ঘুরতে ঘুরতে এই ময়মনসিংহে এসে থিতু হয়েছেন। শিপ্রার মাকে দেখলে অগাধ শ্রদ্ধা জাগে। এমন স্বনির্ভর, এমন আত্মপ্রত্যয়ী মা খুব একটা দেখা হয়নি আমার। শিপ্রা এই শহর থেকেই বিদ্যাময়ী পাশ করে আনন্দমোহন পাশ করে মেডিকেলে ঢোকে। এতবছর এ শহরে থেকেও শিপ্রা কথা বলে রাজশাহীর ভাষায়। ময়মনসিংহের ভাষার তুলনায় পরিচ্ছত, সুন্দর। আইবাম, খাইবাম, যাইবাম চন্দনার মত রপ্ত করা শিপ্রার পক্ষে সম্ভব হয় না, এখনও সে আসব খাব যাবতে রয়ে গেছে। তা থাক, শিপ্রা যেমন আছে, তেমন থাকলেই দেখতে ভাল লাগে। শিপ্রা লম্বায় আমার চেয়ে দুইঞ্চি বেশি, মেদ মাংসে আমার চেয়ে কেবল দুইঞ্চি নয়, অনেক ইঞ্চিই বেশি। ক্লাসের সবচেয়ে লম্বা মেয়ে বলে আমার পরিচয়খানি শিপ্রার সামনে এসে খুব ম্লান না হলেও খানিকটা তো হয়ই। এই ম্লানতা আমাকে, আমি লক্ষ্য করেছি, ছুঁতে পারে না।
মাঝে মধ্যে ক্যাম্পে যাওয়া ছাড়া পরিবার পরিকল্পনা আপিসের চাকরিটি যেহেতু আমার বসে থাকার, তাই শিপ্রার সঙ্গে আমার দেখা হতে থাকে ঘন ঘন, আড্ডা হতে থাকে দীর্ঘ দীর্ঘ। আমি আর শিপ্রা ছাড়া আমাদের ক্লাসের আর কোনও ছেলে বা মেয়ে এই শহরে চাকরি করছে না, শিপ্রা বাউন্ডারি রোডে পঙ্গু সেবালয়ে বসে। তারও কাজ নেই। শহরে বড় একটি হাসপাতাল থাকলে এসব ছোট খাটো জায়গায় বেশি কেউ আসে না। মেডিকেল কলেজের আমরাই শেষ ডাক্তার যারা পাশ করার পরই সরকারি চাকরি পেয়েছি। আমাদের পরের বছর থেকে যারা ডাক্তার হয়ে বেরোচ্ছে, তাদের জন্য আপনাতেই কোনও চাকরি হয়নি। তারা প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোয় ঘুরছে চাকরি পেতে, সরকারি চাকরি পেতে হলে তাদের বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। এই উদ্ভট ১৩ পরীক্ষাটি পাশ করা আর সবার সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক হলেও ডাক্তারদের জন্য ছিল না। নিয়ম চালু হয়েছে নতুন। খবর পাই যে আমরা যারা সরকারি চাকরি করছি, তাদেরও নাকি পরীক্ষাটি পাশ করতে হবে। কি কারণ? আমাদের তো চাকরি পাওয়ার কিছু নেই, আমরা তো সেই কবেই পেয়ে বসে আছি। কিন্তু সরকারি নতুন নিয়ম হল, পেয়েছি বটে চাকরি তবে পরীক্ষাটি পাশ করতে হবে চাকরিটি স্থায়ী করার জন্য। সরকারি চাকরি আবার অস্থায়ী হয়, এমন কথা শুনিনি কোনওদিন। এতকাল জানতাম সরকারি চাকরি মানেই স্থায়ী চাকরি। খবরটি শুনে শিপ্রা উদ্বিগ্ন। মোটা একটি বিসিএস গাইড কিনে সে মুখস্ত করতে শুরু করে দিল। আমারও একটি গাইড জোটে বটে কিন্তু পাতা ওল্টানো হয় না। পঞ্চম শ্রেণীর বালিকাদের মত গরুর রচনা লেখা আর ভাব সম্প্রসারণ করার কোনও ইচ্ছে হয় না আমার। বিসিএস ব্যপারটি বাংলা ইংরেজি অংক ইতিহাস ভুগোল থেকে শুরু করে গার্হস্থ বিজ্ঞান সাধারণ জ্ঞান সবকিছুর খিচুড়ি। আমি ডাক্তারি করব, ডাক্তারি ভাল জানলেই তো হল, আমার ওই খিচুড়ি জানতে হবে কেন! সরকার আর ডাক্তারদের চাকরি দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না, তাই চাকরি যেন কম দেওয়া যায় তাই এই ব্যবস্থা। বিসিএস যারা পাশ করবে, তাদের জন্যও চাকরির ব্যবস্থা না করতে পারলে মনে হয় চারশ মিটার দৌড়ের একটি আয়োজন করবে সরকার, যে জিতবে তাকেই দেওয়া হবে সরকারি চাকরি। ভাব দেখে মনে হয় যে ডাক্তারে ভরে গেছে দেশ, কোথাও জায়গা নেই আর ডাক্তার বসানোর। বলা হচ্ছে সরকারের তহবিলে অত টাকা নেই যে চাকরি দেবে। ডাক্তারদের চাকরি দিতে পারছে না সরকার, অথচ দেশে কয়েক হাজার মানুষের জন্য মাত্র একজন ডাক্তার।
শিপ্রা আর আমি ঢাকায় গিয়ে বিসিএস নামক পরীক্ষাটি দিয়ে আসি। গরুর রচনা না লিখলেও ছাগলের রচনা লিখতে হয়েছে। সরল অসরল সব রকম অংক কষে তরল করে, কাজী নজরুল ইসলাম কোন সালে জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন, তা বানিয়ে দিয়ে, গোয়ালা ৫ সের দুধে ২ সের পানি মিশাইলে ২৮ সের দুধে কয় সের পানি মিশাইয়াছের উত্তরে তিন বালতি আর বৈকাল হৃদ কোথায় অবস্থিতর উত্তরে বগুড়া বসিয়ে লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে আমরা আমাদের চাকরি স্থায়ী করি। এই পরীক্ষা পাশে চাকরির কোনও হেরফের হয় না, যেমন ছিল তেমনই থাকে। যারা বিসিএস পরীক্ষায় ফেল করে বসে আছে, তাদের চাকরিতেও কোনও চিড় ধরে না।
শিপ্রার জীবনে এরপর দুটি ঘটনা ঘটে। একটি হল বোম্বাই কলোনি থেকে সে আর তার মা চলে যায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোয়ার্টারে। দ্বিতীয়টি হল শিপ্রা প্রেমে পড়ে। প্রেমের পড়ার ব্যপারটি শিপ্রার জীবনে খুব উল্লেখযোগ্য। কারণ জীবনে সে প্রথম প্রেমে পড়েছে। মানু নামের এক ডাক্তার ছেলের প্রেমে পড়েছে সে। মানু বিবাহিত। শিপ্রাও বিবাহিত। শিপ্রার স্বামী থাকে মস্কোয়। ডাক্তারি পাশ করার পর শিপ্রা যখন দেখল যে ক্লাসের মেয়েরা ফটাফট সব ডাক্তার ছেলেদের বিয়ে করছে তখন সে যথারীতি খুব উদ্বিগ্ন। সকলে যখন বিয়ে করছে তখন বিয়ে ব্যপারটি নিশ্চয়ই মন্দ কোনও ব্যপার নয়, তারও নিশ্চয়ই তবে বিয়ে করা উচিত। কিন্তু বিয়ে করার জন্য পাত্র কোথায় পাবে সে!