গ্রাম ছেড়ে শহরে ঢুকেছে কলেরা রোগ। পানি ফুটিয়ে খাচ্ছে মানুষ। পানি শোধনের বড়ি মাগনা বিলোনো হচ্ছে হাসপাতাল থেকে, এমনকী পৌরসভা থেকেও। বড়ি গুলে পানি খাওয়ার উপদেশ বিতরণ করে মাইক মারা হচ্ছে, পৌরসভার কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বড়ি বিলোচ্ছে, তারপরও মহামারি লেগে গেল। ঘরে ঘরে কলেরা রোগী। রাস্তাঘাটে রোগী মরছে। হাসপাতালগুলো উপচে পড়েছে রোগীতে। পর্যাপ্ত বিছানা নেই, মেঝেয় শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে রোগীদের, প্রত্যেকের হাতে সুঁই ফুটিয়ে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে কলেরা স্যালাইন। ডাক্তার নার্স সকলে ব্যস্ত। সূর্যকান্ত হাসপাতালে আমিও ব্যস্ত। দৌড়োচ্ছি রোগীদের কাছে স্যালাইন হাতে। বানের জলের মত রোগী আসছে, ওয়ার্ডে জায়গা হচ্ছে না, বারান্দায় শোয়ানো হচ্ছে। রাত দিন স্যালাইন চলছে তারপরও খুব কম রোগী সুস্থ হয়ে উঠছে। হাসপাতালের সামনে মড়া বহন করার খাটিযার স্তূপ। কবরখানায় ভিড়। গুদারাঘাটে ভিড়। আকাশে শকুনের ওড়াওড়ি।
হাসপাতালে কলেরার চিকিৎসা করতে করতে আমার সকাল কখন বিকেল হচ্ছে, বিকেল কখন সন্ধ্যে বুঝে উঠতে পারি না। সন্ধের পর বাড়ি ফিরি, কখনও খুব ক্লান্ত হয়ে গেলে বিকেলেই ফিরি। অবকাশের সামনের নর্দমায় বাবা ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দিয়েছেন। পানি শোধনের বড়ি শুধু খাবার পানিতে নয়, বাসন ধোয়ার, গোসল করার, কাপড় ধোয়ার সব পানিতেই গুলে দেওয়া হয়েছে। আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে এলেই মা আমার গা থেকে অ্যাপ্রোন খুলে ধুতে নিয়ে যান। সেই বিকেলে আর অ্যাপ্রোন খোলা হয় না, কারণ বাড়ি ফিরতেই বাবা বললেন আমাকে কলে যেতে হবে। তাঁর যাবার কথা ছিল কিন্তু খুব মুমুর্ষু এক রোগীকে তিনি দেখতে যাচ্ছেন। কলে আমি আগে কখনও যাইনি, কলটি কোত্থেকে এসেছে জানতে চাইলে বাবা ঠিকানা বলেন। নওমহল যেতে গিয়ে মেথরপট্টির রেললাইন পার হয়ে তিনটে বাড়ি পরে হাতের বাঁদিকে একটি সাদা বাড়ি। রেহানাদের বাড়ি। রেহানা ইয়াসমিনের বান্ধবী। ইয়াসমিনকে নিয়েই রওনা হই কলে। ডাক্তারি জীবনের প্রথম কলে। অ্যাপ্রোনের পকেটে স্টেথোসকোপ, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র আর কিছু জীবন রক্ষাকারী ইনজেকশন নিয়েছি। রেহানাদের বাড়ির সবাই বাবার জন্য অপেক্ষা করছিল, বাবার বদলে আমি এসেছি, যেহেতু আমিও ডাক্তার, আমাকে দেখানো হল রোগী। রোগিটি রেহানার ছোট ভাই। চোখ গর্তে চলে গেছে, ঠোঁট জিভ শুকিয়ে চচ্চড় করছে। ডিহাইড্রেশন পরীক্ষা করে কোনওরকম দেরি না করে রোগীকে হাসপাতালে নিতে বলি। হাসপাতাল থেকে জায়গার অভাবে রোগী ফেরত দেওয়া হচ্ছে, এ কথাটি রেহানার একটি সুস্থ ভাই বলল পাশ থেকে। ছেলেটিকে হাসপাতালে নিতে বাড়ির কেউই রাজি নয়। অগত্যা পাঁচ ব্যাগ কলেরা স্যালাইন, স্যালইন সেট, বাটারফ্লাই নিডল আর কিছু ওষুধপত্রের নাম লিখে দিই কাগজে, রেহানা সুস্থ ভাইটিকে টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় জলদি জলদি সব কিনে নিয়ে আসতে। বাড়িটির দোতলায় ছোট্ট দুটো ঘর, ঘরের জিনিসপত্র সব এলো মেলো, রেহানার বাবা পা গুটিয়ে উদভ্রান্ত বসে আছেন একটি চেয়ারে। রেহানার মা মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়, কোলে ব্যারিস্টার, ব্যারিস্টার রেহানার তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ভাই। ব্যারিস্টারের এর মধ্যে দুবার বাস্তু গেছে। রেহানা ঠিক বুঝতে পারছে না ব্যারিস্টারকেও ধরেছে কি না রোগে। সুস্থ ভাইটি স্যালাইন নিয়ে এলে আমি স্যালাইন রানিং চালিয়ে দিয়ে রেহানাকে বুঝিয়ে দিই কি করে স্যালাইনের এক ব্যাগ শেষ হয়ে গেলে আরেক ব্যাগ লাগিয়ে দিতে হবে। সোফার ভাই এবং ব্যারিস্টার দুজনকেই কোনও দ্বিধা না করে হাসপাতালে নিয়ে যাবার উপদেশ আবারও বর্ষণ করে যখন দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসি, রেহানা আসে আমার পেছন পেছন। ইয়াসমিন আমার আগে বেরিয়ে একটি রিক্সা ডেকে উঠে বসেছে। রেহানার সঙ্গে ইয়াসমিনের তুই তোকারি সম্পর্ক। ইশকুলে এক সঙ্গে পড়েছে ওরা। কিছু মেয়ের ইশকুলে পড়াকালীনই বিয়ে হয়ে যায়, রেহানা সেরকম। দেড়বছরের একটি মেয়ে আছে রেহানার। নিজের সংসার ফেলে বাপের বাড়ি চলে এসেছে ভাইদের সেবা করতে। রেহানা নিজের মেয়েটিকে দেখতে যেতে পারছে না দুদিন, মেয়েটিকে এ বাড়িতে নিয়ে আসাও নিরাপদ নয়। সিঁড়ির শেষ মাথায় নেমে রেহানা আমাকে টাকা দিল। ষাট টাকা। ডাক্তারের ফি। কলে গিয়ে আমার প্রথম উপার্জন। উপার্জনটি করে রিক্সায় উঠে ইয়াসমিনকে সোল্লাসে বলি। ইয়াসমিন হাঁ হয়ে, ভুরু কুঞ্চিত, আমার হাসি-মুখের দিকে কিছুক্ষণ হতভম্ব তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তুমি রেহানার কাছ থেইকা টাকা নিছ?’ আমি হাসি-মুখেই বলি, ‘হ। নিছি। নিব না কেন? দিল তো! রোগী দেইখা দিছি। টাকা নিব না কেন?’
‘রেহানা তো আমার বান্ধবী। বাড়িতে দুই ভাই কলেরায় ভুগতাছে। এইসময় তুমি পারলা কি ভাবে টাকা নিতে?’
টাকাটা যখন বাড়িয়েছিল রেহানা, টাকা নেবার অভ্যেস নেই বলে আমার আড়ষ্টতা ছিল। রেহানা ইয়াসমিনের বান্ধবী হলেও আমার তো কেউ নয়! শহর খুঁজলে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ওরকম আমার বা ইয়াসমিনের বান্ধবী, দাদার বা ছোটদার বন্ধু, বাবা আর মার চেনা বা লতায় পাতায় আত্মীয় পাওয়া যাবে তাহলে তো ডাক্তরি করে টাকা পয়সা উপার্জন সম্ভব হবে না! কলে এসেছি, রিক্সাভাড়া খরচা হয়েছে, বুদ্ধি দিয়েছি, শ্রম ঢেলেছি, ফি নেবারই তো কথা। সব ডাক্তারই নেয়