বন্দী জীবন থেকে মুক্তির কোনও পথ নেই। কোনওদিন মুক্তি পাবো বলে মনে হয় না। নিজ ভূমে পরবাসী হওয়ার যন্ত্রণা অনেক। আমি আমার সকল যন্ত্রণা নিয়ে একা বসে থাকি। হাসপাতাল থেকে বিনা নোটিশে আমার বিচ্ছিত হওয়া দেখে ডাক্তাররা নিশ্চয়ই বিস্মিত এবং বিরক্ত। কিন্তু কী করতে পারি আমি! নিজের জীবনটি নিজের হাত থেকে ফসকে গেল হঠাৎ। আমার অক্ষমতাগুলো আমাকে দুমড়ে মুচড়ে আমাকে ক্ষুদ্র করে ফেলতে থাকে। কষ্ট কান্নায় বুক ভারি হয়ে আছে। কথা বলতে চাই, কাঁদতে চাই কিন্তু পারি না। দিন রাত পড়ে পড়ে গোঙাই কেবল। নিজেকে বকুলির মত মনে হয়। সেই বকুলি। কথা বলতে না পারা বকুলি। বকুলি টিকাটুলির মেয়ে। হাসপাতালে একদিন বকুলির মা তাকে নিয়ে এসেছিল। এর আগে কোনওদিন বকুলি বা তার মা হাসপাতালে আসেনি। হাসপাতালের কোথায় যেতে হয়, কি করতে হয় কোনও চিকিৎসা পেতে হলে, দুজনের কেউই জানে না। সকালে হাসপাতালে ঢুকেই দেখেছি দুজন বসে আছে বহির্বিভাগের বারান্দায়। একজনের ষোল সতেরো বছর বয়স হবে, আরেকজনের বয়স অনুমান করি তিরিশের মত। হাসপাতালের আঙিনায় এরকম কত মানুষই তো বসে থাকে। কিন্তু বারান্দায় চোখ পড়তেই দেখি অল্প বয়সী মেয়েটি আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। কেন তাকিয়ে আছে, আমাকে কি চেনে নাকি! একবার মনে হয়, হয়ত আমার রোগী ছিল কোনও এক সময়, তাই চিনেছে। আমি গাইনির বর্হিবিভাগে রোগী দেখতে ঢুকে যাই। দুপুরবেলা বেরিয়ে দেখি ওরা দুজন ঠিক একই জায়গায় একই রকম করে বসে আছে। আমি কি জানি কেন ধীরে ধীরে বসে থাকা দুজনের দিকে এগিয়ে যাই, বলি, ‘রোগী কে?’
‘বকুলি।’
‘ওর নাম বুঝি বকুলি!’
‘হ আমার মেয়ে। আমার মেয়ে বকুলি।’ তিরিশ হাত রাখেন ষোলর পিঠে।
‘কি অসুখ?’
‘বকুলি কথা কয় না।’
‘অসুখ কি? কি জন্য আসছেন এইখানে।’
‘বকুলি কথা কয় না।’
‘কথা কয় না তো বুঝলাম, অসুখ টা কি? পেটে অসুখ. নাকি বুকে অসুখ। বলেন, কিসের চিকিৎসা করতে চান।’
‘বকুলির কথা ফিরাইয়া দেন। বকুলি যেন আবার আগের মত কথা কয়।’
‘কবে থেইকা কথা কয় না?’
‘আজকে একমাস হইয়া গেল কোনও কথা কয় না।’
বকুলি আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, বড় ডাগর চোখে। কী আশ্চর্য সুন্দর চোখ। এরকম চোখ যদি আমার থাকত, মনে মনে ভাবি। বিধ্বস্ত চুল। কপালে ঘামে ভেজা কিছু চুল লেপটে আছে। পরনে একটি নীল সুতি শাড়ি। আলু থালু।
‘কেন কথা কয় না?’
‘তা তো জানি না।’ মহিলা মাথা নাড়ে। বকুলির দিকে তাকিয়ে এরপর বলে, ‘বকুলি কথা ক। ক কি হইছিল। কথা ক বকুলি। ও বকুলি কথা ক। একবার কথা ক। ক কথা। কথা ক।’
‘কী হইছিল যে কথা কয় না! একমাস আগে কিছু কি ঘটছিল?’
বকুলির মা এদিক ওদিক তাকিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে আসে আমার দিকে, আমার খুব কাছে এসে কানের কাছে মুখ রেখে আস্তে বলে, ‘ও নদীর ধারে পইড়া ছিল। মানুষে আইয়া খবর দিলে আমি গিয়া নিয়া আইছি।’
‘পইড়া ছিল কেন?’
‘কী জানি, কারা নাকি ধইরা নিছিল। গেছিল ত কামে। জিনজিরার ফ্যাক্টরিতে কাম করত। কাম থেইকা দুইদিন ফিরে নাই। পরে ত খবর পাইলাম।’
‘যখন নদীর পাড়ে পইড়া ছিল , জ্ঞান ছিল?’
‘তা ছিল। আমার সাথে উইঠা আইল। আমি তারে নিয়া আইলাম বাড়িত। এত জিগাইলাম কী হইছিল ক। বকুলি কথা কইল না। সেই যে কইল না। আইজও কয় না।’
‘খারাপ কিছু ঘটছিল নাকি?’
‘মানুষে কয় ব্যাটারা নাকি তার ইজ্জত নিছে।’
বকুলির মা ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। কেঁদে কেঁদে বলতে থাকে, ‘এক আশ্বিন মাসে বকুলি হইল, পরের আশ্বিনে তার বাপ মরল।.. ‘ আমার সময় নেই বকুলির মার গল্প শোনার, থামিয়ে দিয়ে বলি, ‘কালকে সকালে আইসা নাক কান গলা বিভাগে যাইয়া ডাক্তার দেখান। গলায় হয়ত কোনও অসুবিধা থাকতে পারে।’
আমি সরে আসি। প্রতিদিনই আমাকে মানুষের কষ্টের গল্প শুনতে হয়। হাজারও রকম কষ্টের মধ্যে এও এক কষ্ট।
বকুলির মা আমাকে পেছন থেকে ডাকে, ‘আপা, বকুলি কি কথা কইব না আর?’
‘জানি না।’
আবারও ডাকে, ‘আপা একটু খাড়ন।’
দাঁড়াই।
‘আপনের বড় মায়া। বকুলি যেন কথা কয়, এই ব্যবস্থাটা কইরা দেন। বোবা মেয়ে নিয়া আমি এখন কই যামু, কি করমু।’
‘কালকে আইসা ডাক্তার দেখান। শুনেন ডাক্তার কি কয়।’ হাঁটতে হাঁটতে বলি।
হাসপাতালের গেটের কাছ থেকে একটি রিক্সা নিয়ে উঠে বসি। তখনও বকুলি ওভাবেই বসা ছিল। বারান্দা থেকে বকুলির মা আমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল। সারা পথ আমার কানে কেবল বকুলির মার কথাটি বাজল,বকুলি কথা ক।
পরদিন বর্হিবিভাগের বারান্দায় আমার চোখ যায়, বকুলি যেখানে বসে ছিল। অনেক রোগীর