হঠাৎ একদিন
হারভার্ডের জীবন শেষ হওয়ার পর ভাবি এবার কোথায়! কোন দেশ? কোন শহর! কোথাও দাঁড়াতে চাই, পায়ের তলায় মাটি চাই। যাযাবর জীবনের ইতি বারবার টানতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি, আর যেন ব্যর্থ না হই। বাংলার মেয়ে বাংলায় ফিরবো। দীর্ঘদিনের এই স্বপ্ন আমায় তাড়া করে, আমার পায়ে পায়ে হাঁটে, সেঁটে থাকে গায়ে। এত কিছু ঘটে গেল বাংলায়! বই নিষিদ্ধ, অবান্তর কুৎসা, নিন্দা, তারপরও বাংলায় ফেরার ইচ্ছে। বিশুদ্ধ জল হাওয়া, ঝলমলে নগর, নিরাপদ জীবন ফেলে কলকাতায় ফিরি। বিদেশ থেকেই ট্রায়াংগুলার পার্কে একটি আসবাবওয়ালা বাড়ি এক মাসের জন্য ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারটা পাকা করে, তবে। হোটেলে থাকার আর একদমই ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে কি কোনওকালে ছিল। উপায় ছিল না বলে থাকতে হয়েছে। ট্রায়াংগুলার পার্কের বাড়িতে মানুষে, কোলাহলে, বন্ধুতে, ব্যস্ততায়, বিস্ময়ে, কৌতূহলে পুরো একমাস কাটাই। খোঁজ করতে থাকি একটি বাড়ির যেখানে অস্থায়ী নয়, রীতিমত স্থায়ী বাস করব, যতদিন বেঁচে থাকি, ততদিন। স্বপ্নগুলো পাখা মেলতে থাকে, সেইসব অচিন দেশের অচিন পাখির অচিন পাখা। অতিকায় সব পাখা আমাকে অদৃশ্য করে ফেলে।
সুইডেনের ভারতীয় দূতাবাসে আমার লেখা পছন্দ করেন এমন একজন হৃদয়বান মানুষ ছিলেন, কেন ছিলেন কে জানে! ভিসা করতে গেলে দিব্যি আমাকে ‘এক্স ভিসা দিয়ে দিলেন, যেটির, পরে জেনেছি, মেয়াদ ছমাস অন্তর অন্তর বাড়িয়ে অনন্ত কাল ভারতে থাকা যায়। এখন থেকে আর পর্যটক নই, রীতিমত বাসিন্দা আমি। কত শত স্বপ্ন মনের উঠোনে এক্কা দোক্কা খেলে, হঠাৎ যে কখন কোন্ ঘরটা কেনা হয়ে যায়, কোন্ স্বপ্নটা পূরণ হয়ে যায় নিজের অজান্তেই।
এক সকালে কলকাতা বিমান বন্দরে নেমেই কোনো একটা নম্বরে ফোন করে বাড়ি ভাড়া নেব, এক্ষুণি এই মুহূর্তে বললে ওপারের অচেনা এক কণ্ঠস্বর থেকে এক থোকা বিস্ময় ঝরে পড়ে। এভাবে বাড়ির কিছুই না দেখে বাড়ি ভাড়া কেউ নিয়েছে বলে তার জানা নেই। ধুলোধূসরিত খালি বাড়িতে খালি হাতে উঠে তোশক বালিশ খাট সোফা বাসন কিনে নিয়ে আসি, হ্যাঁ সেই সকালেই, সেদিনই। কোথায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে, কোথায় আসবাব পত্র, কোথায় চাল ডাল, সে ধারণা দেওয়ারও অবশ্য লোক ছিল না। প্রশ্ন করলে, যারা ঘিরে থাকে, আমি নামী বলে, বা আমি আমি বলে সবাই অপ্রস্তুত হয়, উত্তর নেই, অথবা ভুল উত্তর। সংসার ওই ভুল দিয়েই শুরু হয় আমার। আমার কলকাতার সংসার।
দু’দিনেই বাড়ি বাসযোগ্য করে ফেলি। চারদিনে সাজানো। সাতদিনে ঝলমলে। ছ’মাসে মনে হয় তিরিশ বছরের সংসার। বারান্দায় শৈশবের সব ফুল। নানা রঙের ফুল ফুটে সুবাস ছড়াতে থাকে বাড়িময়। রাতে হাসনুহেনার গন্ধে বাড়ি ভেসে যায়। প্রায়ই একটি হাসনুহেনার টব শিয়রের কাছে এনে রাখি। ঘ্রাণ শুকতে শুকতে শৈশবে যেমন ঘুমোতাম, তেমন ঘুমোই। শহরের মধ্যিখানে চমৎকার বাড়ি। নিরাপদ বাড়ি। ঠিক রাস্তার ওপরে নয়। দুদুটো লোহার ফটক পেরিয়ে, দারোয়ান পেরিয়ে তবে ভেতরে ঢুকতে হয়। খোলা বারান্দা। মশলার সুগন্ধ ভেসে আসে রান্নাঘর থেকে, বারান্দায় অল্প অল্প উড়তে থাকে শুকোতে দেওয়া কাপড়। কী আশ্চর্য সুন্দর এই দৃশ্য! কতকাল আমি আমার শৈশব কৈশোরকে এত কাছ থেকে দেখি না। আলোয়, হাওয়ায় বাড়িটি সত্যিকার বাড়ি হয়ে ওঠে। আমার সাত নম্বর রাওডন স্ট্রিটের বাড়ি।
শহর আগের মতোই, তবে দীর্ঘদিনের বন্ধুটি নেই শহরে। যে বন্ধু সুসময়ে দুঃসময়ে ঠিক একই রকম পাশে থাকতেন, যাঁর সঙ্গে যে কোনো বিষয়ে যে কোনো সময় কথা বলা যেত, সেই নিখিল সরকার, নেই। সেই অথৈ সমুদ্র, সেই নিমগ্ন সাধক, সেই জ্ঞানের ভাণ্ডার নেই। জগৎ আমার, টের পাই, ঠিক বুঝে ওঠার আগেই কী রকম খালি হয়ে যাচ্ছে। মাও নেই, বাবাও নেই, নিখিল সরকারও নেই। আত্মীয় স্বজন থেকেও নেই, চেনা পরিচিত লোকদের বন্ধু বলে ডাকি। ঘন ঘন দেখা করতে আসা ভক্তদেরও বন্ধু বলি। তাড়াহুড়ো করে একটা তাসের ঘরের মতো কিছু গড়ে তুলছি কি! মাঝে মাঝে সবকিছুকে অদ্ভুত এক মায়া, রহস্যের জালের মতো মায়াবি এক জাল অথবা জীবন নিয়ে নিতান্তই বালখিল্য রসিকতা বলে মনে হয়।
রাওডন স্ট্রিটের বাড়ির দুয়ার সবার জন্য খোলা। সবার জন্য, এমন কী অচেনা মানুষের জন্যও আপ্যায়নের অন্ত নেই। আতিথেয়তা আমার অন্তরে। কত ঠিক-মানুষ, কত বেঠিক মানুষ, কত ভুল, কত ধূর্ত আমার ঘরের চৌকাঠ পেরিয়েছে। কাউকেই বেঠিক বা ভুল ভাবতে আমার ইচ্ছে করেনি। আজও করে না। এরকমই আমি। এরকমই সাদাসিধে আর নিরীহ। ঘরের পোশাকে আর হাওয়াই চপ্পলে হেঁটে হেঁটে দিব্যি ঘুরে বেড়াই শহর। ফুটপাত থেকে সস্তা জিনিস পত্তর কিনি। গড়িয়াহাটের