জানুয়ারি
‘মৌলবাদীদের মন রাখতেই বুদ্ধদেব তসলিমা নাসরিনকে কলকাতা থেকে হাপিস করলেন।
–মহাশ্বেতা দেবী
আজ সুয়েনসনের সঙ্গে দেখা করানোর ব্যবস্থা করার কথা ছিল। হল দেখা। বেচারা বিদেশি। দিল্লির রাস্তাঘাট চেনে না। তাকেও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, একেকদিন একেক রাস্তা দিয়ে নিয়ে আসা হয় ওই গোপন জায়গাটিতে। দেখা হওয়ার জায়গাটিতে।
অনেকটা সময়ই কাটালাম। ভালো খাবার দাবারের ব্যবস্থা করা হল। মাঠটাতে একটু হাঁটার সুযোগও হল। খালি পায়ে হাঁটলাম। একটা মাঠ পাওয়া জগৎ পাওয়ার মতো। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে মাটির ছোঁয়া পাইনি।
.
২ জানুয়ারি
আজ কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি হলে আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নেওয়ার উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান করলো এপিডিআর, কলকাতার মানবাধিকার সংগঠন অথবা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগঠন। মহাশ্বেতা দেবী ছিলেন অনুষ্ঠানের সভানেত্রী। দীপংকর চক্রবর্তী, সুজাত ভদ্র, শুভাপ্রসন্ন, অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বক্তৃতা করেছেন। উপস্থিত থাকার কথা ছিল শঙ্খ ঘোষ, অপর্ণা সেন, শাঁওলি মিত্রের। সকলেই নানা অসুবিধেয় পড়ে আসতে পারেননি। অনুষ্ঠানে প্রতুল মুখোপাধ্যায় গান গাইলেন, সেটি শুনলাম ফোনে। অসাধারণ। কী সুন্দর গান লিখেছেন আমাকে নিয়ে। হায় হায় হায় কী শরম কেয়া বাত, মার্কস বাদী পার্টি নাচে মৌলবাদ কা সাথ, দেশ ছাড়া এক তেজি মেয়ে থাকতো কলকাতায়, তার কাটতো সময় লেখাপড়ায়, সভায় আর আড্ডায়।..তারপর কী করে আমাকে পগার পার করা হল, সেই গল্প। কোনওদিন দেখা হয়নি প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর গানের মুগ্ধ শ্রোতা আমি। কলকাতায় গেলে দেখা হবে, দেখা আমাদের নিশ্চয়ই একদিন হবে।
আজ শেষ দিন সুয়েনসনের। বিকেলটা একসঙ্গে কাটানো হল। হল বটে, কিন্তু ওর প্রতি কি সত্যিই আমার কোনও অনুরাগ আছে? আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে, কোনও আত্মবিশ্বাসী সচেতন মেয়ে ওর মুখদর্শন করতো না। সন্ধেয় খেয়ে দেয়ে ও চলে গেল। মানুষটা অদ্ভুত। খুব হাত পা ছড়িয়ে উপভোগ করলো ভারত সরকারের আতিথ্য। আমি কি এরকম পারতাম? ওর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে বুঝি, অসম্ভব। আমার সংকোচ হত। কোনও দেশ যদি বিপদে পড়ে আমার খরচ বহন করতে চাইতো, কিছুতেই আমি নিতাম না সে খরচ। নিজে যা পারি, নিজের যা সামর্থ, তা দিয়ে আমি চলতাম। আজ পর্যন্ত এত যে বিদেশে থেকেছি, কোথাও কোনো সরকারের দান বা করুণা নিইনি। যদিও রাজনৈতিক শরণার্থী হিসেবে আমার নেওয়ারই কথা ছিল।
সুয়েনসনকে সরকারের কোনো এক লোক তাজমহল পর্যন্ত দেখিয়ে এনেছে, জয়পুর নিয়ে গেছে, উদয়পুরেও, দিল্লির অনেক কিছু দেখিয়েছে। খাওয়া খরচ, হোটেল খরচ সব অকাতরে দিয়েছে। আমি বলেছিলাম, এসব খরচ তো তুমিই দিতে পারো। সুয়েনসন বললো, ‘ওরা যখন দিচ্ছে, দিক। প্রভুকে বলেছিলাম বটে সুয়েনসনকে একটু ঘুরিয়ে দেখাতে, বেচারা আমার সঙ্গে কাটাতে পারছে না, তার চেয়ে ঘুরে বেড়ালে মন ভালো থাকবে। ওকে একটু সাহায্য করা। ওর গাইড হওয়া। কিন্তু যা আশা করিনি, যা চাইনি তাই করলেন প্রভু। জানি না কেন করলেন। প্রভু জানালেন সুয়েনসনকে তিনি অতিথির মতো দেখাশোনা করবেন। আমাকে খুশি করতেই সুয়েনসনের সব দায়িত্ব নিয়েছেন প্রভু। প্রভু কি ভেবেছিলেন, আমার করুণ অবস্থা দেখে সুয়েনসন আমাকে বলবে যেন ভারত ছেড়ে চলে যাই, অথবা আমাকে তার সঙ্গে যে করেই হোক সুইডেনে নিয়ে যাবে! প্রভু যা ভেবেই যা কিছুই করুন, সুয়েনসনের উচিত হয়নি এভাবে গোগ্রাসে সব গ্রহণ করা। ধন্যবাদ জানিয়ে বলতে পারতো, ওর নিজের খরচাটা ও নিজে দেবে। মাগনা পেলে কিছু লোক বিষ্ঠাও খায়। বিদেশিদের ভাবা হয়, বিশেষ করে সুইডিশদের, যে, এরা অন্যকে ঠকায় না, অন্যকে বিরক্ত করে না। তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। সুযোগ পেলে এরা রক্ত চুষে খায়। নিজেদের মধ্যে ঠকানোটা কম, যেই না অন্য জাতের কাউকে পেল, অমনি ঘাড় কামড়ে ধরবে। বিদেশিদের মধ্যে আমি যত স্বার্থপর, চশমখোর দেখেছি, দেশিদের মধ্যে তত দেখিনি। দেশিদের মধ্যে যে উদারতা, যে দয়া, এবং স্বার্থহীনতার সন্ধান আমি পেয়েছি, তার তুলনা হয় না। ভালো মন্দ দু সংস্কৃতিতেই মেলে। কার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছি, মিলছি–তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। সুয়েনসনের জন্য সরকারের যে টাকা খরচা হয়েছে, সে টাকার অংক অনুমান করে আমি শিউরে উঠি। টাকা আমি যে করে হোক, ফেরত দিতে চাই। আমার জন্য যা হচ্ছে হচ্ছে, আমার বন্ধুর জন্য হবে কেন? আমার বন্ধুকে আমি যে জায়গায় থাকছি, সেই জায়গায় না আসতে দিলে তো বাইরের বন্দোবস্ত করতেই হয়। কিন্তু তাই বলে কেন সুয়েনসনকে অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে চলতে হবে। আমার সঙ্গে ওর থাকা হবে না, এ তো একরকম জেনেই ও এসেছে। থাকা হবে না বলে ওর সমস্ত দায়িত্ব কেন আমাকে নিতে হবে! কেন যে