তাণ্ডব – ০৩

সোনার তরী আর পূর্ণিমা খাঁটি মৌলবাদীদের পত্রিকা। এসব পত্রিকায় আমি কখনও কোনও

সোনার তরী আর পূর্ণিমা খাঁটি মৌলবাদীদের পত্রিকা। এসব পত্রিকায় আমি কখনও কোনও সাক্ষাৎকার দিইনি। কিন্তু যখন তাদের কোনও প্রয়োজন হয় আমার মুখে কিছু বাক্য বসাবার, তারা নিজ দায়িত্বে সেসব বসিয়ে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে। এ দেশের মানুষ মুদ্রিত যে কোনও লেখাকে খুব বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসটিই ইনকিলাব গোষ্ঠীর মূলধন। মুখে ফেনা তুলে ফেলছে কোনও একটি কথা বলে বলে, কারও কানে ঢোকে না তা, আর যখনই লিখে দিচ্ছে সে কথা, পড়তে গিয়ে লোকের মস্তিষ্কে তা সুরুৎ করে ঢুকে যায়। মস্তিষ্কগুলোই এখন এই গোষ্ঠীর খুব প্রয়োজন। এই জাতির মস্তিষ্কের ওপরের আবরণটি খুব পাতলা, খুব য়চ্ছ, খুব সহজে যে কোনও মাল আবরণ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যায়, গোবর ঢোকালে গোবরও ঢুকে যায়, ধর্ম ঢোকালে ধর্মও। আমার বিবৃতিটিই কেবল ঢোকেনি। আমি যে লিখেছি কোরান সংশোধনের কথা আমি বলিনি, সেটির দিকে কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না। অথবা তাকালেও মনে মনে বলছে, তুমি কোরানের সংশোধনের কথা এখন হয়তো না বলতে পারো, তাতে কি! কোরান সম্পর্কে কম বাজে কথা এ যাবৎ বলেছো ! এখন জল ঘোলা করোনি, কিন্তু আগে তো করেছো। ভাল যে বলেনি, তুমি জল ঘোলা না করলেও তোমার বাপ ঘোলা করেছে, বাপ না করলেও তোমার বাপের বাপ করেছে, তাই তোমাকে আমরা চিবিয়ে খাবো।

 

চিঠি আসছে বিদেশ থেকে। নভেম্বরে নরওয়ের লেখক সম্মেলনে যাবার আমন্ত্রণ, অক্টোবরে ফ্রান্সের বই মেলায়, সুইডেনের লেখক-সংগঠন থেকে আমন্ত্রণ, আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাসের জন্য লেখালেখির ওপর বিদ্যে নেওয়ার আমন্ত্রণ, নিউ ইয়র্কে মেরেডিথ ট্যাক্স এর নারীবাদী লেখক সভায় আমন্ত্রণ। আমি নিজেই অবাক হই এমন সামান্য লেখকের জন্য এত বড় সম্মান দেখে। বিদেশি কেউ কেউ আমাকে বলেন, আমাদের আশংকা হয় কবে কখন কে আপনাকে মেরে ফেলে। আপনি বরং অন্য কোনও দেশে চলে যান। বাংলাদেশ আপনার জন্য নিরাপদ নয়। আমি হেসে উড়িয়ে দিই এমন অলক্ষুণে প্রস্তাব। এ দেশ আমার, এ দেশ ছেড়ে আমি অন্য কোথাও চলে যাবো কেন? আমি কি পাগল হয়েছি নাকি যে এমন কথা ভাবব? যতদিন বাঁচি এ দেশেই থাকবো। এ দেশে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আমি একা লড়াই করছি না। মৌলবাদ-বিরোধী একটি বড় শক্তি এ দেশে আছে, আমরা সবাই মিলে দেশটিকে মৌলবাদ মুক্ত করতে চাইছি, সবাই মিলে দেশটির মঙ্গলের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছি। অন্য দেশে গিয়ে নিরাপদে জীবন যাপন করার কুৎসিত ভাবনাটি আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যেও মুহূর্তের জন্যও কখনও উঁকি দেয় না।

 

তাণ্ডবের মধ্যেও জীবন যাপন করছি। শ্বাস নিচ্ছি, ফেলছি। লড়াকু বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি, আলোচনা করছি, প্রেরণা পাচ্ছি, প্রেরণা দিচ্ছি, ভাবছি, লিখছি, পড়ছি, প্রতিবাদ করছি, মিছিলের মুখে পড়ছি, উল্টোদিকে দৌড়োচ্ছি, মিছিল চলে গেলে বেরোচ্ছি, আবার দৌড়োচ্ছি। গন্তব্য অনেক দূর, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছতেই হবে আমাদের। কিছু একটা করা শক্ত, কিন্তু কিছু একটা করতেই হবে। শামুকের মত গুটিয়ে থাকলে চলবে কেন! শান্ত হও, বাঁধন মানো, ধীরে বল, চিৎকার কোরো না। কিন্তু আমি শান্ত হচ্ছি না, বাঁধন মানছি না, ধীরে বলছি না, আমি চিৎকারই করছি। একটি সম্ভাবনাকে পিষে ফেলা হচ্ছে, সেই সম্ভাবনাকে ছিনিয়ে নিতে চাইছি দুর্বৃত্তদের হাত থেকে। আমি কি একা? না, আমার সঙ্গে অনেকেই আছেন। সরব এবং নীরব অনেকে। কাছের এবং দূরের অনেকে।

 

হঠাৎ একদিন অভাব এসে আমার দরজায় কড়া নাড়ে। অনেকদিন থেকেই আসছি আসছি করছিল, এবার এসেই পড়ে, ঢুকেই পড়ে চৌহদ্দিতে। না, এমন অভাবকে বরণ করলে চলবে না। আমার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে, এই খবরটি চাউর হয়ে গেলে আমাকে খুবলে খাওয়ার জন্য শকুনের ভিড় বাড়বে। এতদূর এসে এখন কোনওভাবেই মাথায় হাত দিয়ে আমার বসে গেলে চলবে না। আমাকে সাহায্য করার জন্য কোথাও কোনও প্রাণী অপেক্ষা করে নেই। যত রকম মেরুদণ্ড আছে, সব মেরুদণ্ডই শক্ত করে আমাকে স্রোতের বিপক্ষে বৈঠা বাইতে হবে। কলাম লিখে টাকা রোজগারের একটি পথই এখন অবশিষ্ট। কিন্তু কলাম থেকে আসা টাকা দিয়ে সংসার চলে না। আমার লেখা থাকে বলে পত্রিকা আপিসে হামলা হয়, পত্রিকাগুলোও এখন লেখায় সরকার বা ধর্ম বিষয়ে কোনও মন্তব্য থাকলে ছাপছে না। ভয়। ভয় সরকারি বিজ্ঞাপন হারাবার। সরকারি রোষানলের শিকার হবার ভয়, মৌলবাদীদের হামলার ভয়। ইয়াসমিন আর মিলন সংসারের বাজার খরচ দিচ্ছে, তার ওপর ভালবাসার জন্য ওদের খরচ আছে। আমার টেলিফোনের বিল বাকি, বিল বাকি বিদ্যুৎএর। প্যারিস ছাড়ার পর ফরাসি প্রকাশক ক্রিশ্চান বেস আমার ঠিকানায় লজ্জা বইটির জন্য অগ্রিম রয়্যালটির চেক পাঠিয়েছিলেন। চেকটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম আমি।

 

চেক আসে না, কিন্তু ফোন আসে ক্রিশ্চান বেস এর। মাঝে মাঝে ফোন করে ভাল আছি কি না, নিরাপদে আছি কি না, কোনওরকম কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না ইত্যাদি জানতে


Rx Munna

447 Blog posts

Comments