চব্বিশ জুন, শুক্রবার
গানের যন্ত্রটি পড়ে আছে হাতের নাগালে, হাতটি কতবার চলে যায় যন্ত্রের বোতামে। বোতাম থেকে বারবারই ফিরিয়ে নিয়ে আসি হাত। আমি এটি বাজাতে পারি না। কারণ যে ঘরে কেউ নেই, যে ঘরটি তালাবন্ধ, সে ঘরে হঠাৎ করে গান বাজতে পারে না। কতবার উঠে আনমনে দরজার কাছে চলে যেতে চাই, নিজেকে সামলে রাখি, শক্ত করে ধরে রাখি যেখানে আছি সেখানে। গরমে সেদ্ধ হচ্ছি, তবুও পাখাটি ছাড়তে পারি না, কিঁ কিঁ কিঁ করে একটি শব্দ হয় পাখা চলতে থাকলে, নিচতলায় না যাক, দোতলা থেকে যদি কান পাতলে শোনা যায় শব্দটি! আলোটি জ্বালতে পারি না, জ্বাললে দরজার ফাঁকে কারও চোখ পড়লে যদি বোঝা যায় যে আলো জ্বলছে ঘরটিতে। খাওয়া দাওয়া পানি পান কম বলে পেচ্ছ!ব পায়খানার ঝামেলা তেমন নেই, অন্তত এই ব্যাপারটি টয়লেট ফ্ল্যাশ করে শব্দ তৈরি করার ঝুঁকি থেকে নিস্তার দিয়েছে। এই প্রাকৃতিক কর্মগুলো আমি জমা রাখি ঝ যখন এসে এ ঘরে গানের যন্ত্রটি ছাড়বেন তখনের জন্য। শুয়ে থাকলে পাশ ফিরি সাবধানে, যেন শব্দ না হয়। পত্রিকার পাতা ওল্টাতেও সতর্কতা, যেন শব্দ না হয়। ঝ আমাকে নিজ দায়িত্বে এক নৈঃশ−ব্দ্যর জগত তৈরি করে নিতে বলেছেন। ঝ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে তিনি ছাড়া বাড়ির কেউ জানে না যে এঘরে কোনও প্রাণী আছে। সুতরাং আমাকে সেভাবেই এ ঘরটিতে বাস করতে হবে। প্রাণহীনের মত। প্রাণহীনের মত বেঁচে থেকে নিজের প্রাণটি বাঁচিয়ে রাখছি। আমাকে এখানে রেখে যাবার পর থেকে ক আর ঙর কোনও খবর নেই। জামিন আমার হচ্ছে কি হচ্ছে না, হলে কবে হবে, তার কিছুই জানি না। প্রতিদিন অপেক্ষা করি ক বা ঙ কোনও খবর নিয়ে আসবেন, কিন্তু কেউ আসেন না। ঝ নিজে যতটুকু পারছেন করছেন। তাঁর সাধ্য থাকলে আরও কিছু করতেন। যে মানুষটিকে হত্যা করার জন্য পুরো একটি দেশ ক্ষেপে উঠেছে, সেখানে খুব বেশি করার কিছু থাকে না।
দুপুরবেলা ঝ ভাত নিয়ে ঢুকলেন ঘরে। এক থালার মধ্যে ভাত তরকারি সব। ক্ষিধে পেতে পেতে একসময় ক্ষিধে মরে যায়। ক্লান্ত একটি ঝিমুনি ধরা শরীর পড়ে থাকে। প্রতিদিন আমি এভাবেই পড়ে থাকি। থালাটি মাঝখানে রেখে ঝ আসন করে বসে গেলেন মেঝেয়। আমাকে ডাকলেন ওই থালা থেকেই খেতে। ক্লান্ত শরীরটি উঠিয়ে নিয়ে না ধোয়া হাতেই ভাত ওঠাই মুখে। মনে হয় পুরো থালার ভাত বুঝি খেয়ে উঠতে পারব, কিন্তু দুতিন মুঠো খেয়ে আর পারি না। হাঁফিয়ে উঠি। গিলতে কষ্ট হয়। হাত ধুয়ে ফেলি। পানি দু ঢোক খেয়েই আর খেতে ইচ্ছে করে না। ঝ একটি গেলাস এ ঘরে রেখে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পানি খেয়ো মাঝে মধ্যে, পানিটা দরকার। আমি নিজেও জানি পানি খাওয়া দরকার। কলের পানিতে কি রকম একটা ব্লিচিং পাউডার গন্ধ আসে। আমার শান্তিনগরের বাড়িতে সবসময় পানি ফুটিয়ে খাওয়া হয়। এখানে ফুটোনো পানি পাওয়া দুষ্কর। ঝ লুকিয়ে ভাত যে আনেন এ ঘরে, সেটিই অনেক। তাঁর কাছে ফুটোনো পানির আবদার করা বাড়াবাড়ি। ঝ সিগারেটের প্যাকেট ছুঁড়ে দেন আমার দিকে। সিগারেট ফুঁকে কাশি শুরু হলে গানের যন্ত্রটি ছেড়ে দেন। ঝর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করি, ঙ কেন আসছেন না? ক কেন আসছেন না? আমার কি জামিন হবে না? ঝর কাছে এসব প্রশ্নের কোনও জবাব নেই।
–ঙকে কি একটা ফোন করবেন?
–এত অস্থির হচ্ছ কেন? ঙ বলেছেন, কোনও খবর জানলে তিনি ফোন করবেন। আমি চুপ হয়ে থাকি।
–আজকের পত্রিকাগুলো নিয়ে আসবেন? নীরবতা ভাঙি।
ঝ খাওয়া শেষ করে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলেন, কাগজ কলম যে দিয়ে গেলাম, কিছু কি লিখেছো?
–না।
–কেন?
–লেখা আসে না।
–কেবল পত্রিকা পড়ে পড়ে টেনশান করো তুমি।
–কি হচ্ছে না হচ্ছে দেশে, জানতে ইচ্ছে করে।
–তা জেনে কী লাভ? এগুলো পড়লে খামোকাই মন খারাপ হবে। বসে বসে নিজের লেখা লেখো। আরও কাগজ লাগলে আমি কাগজ দিয়ে যাবো।
–কিছু কি জানেন খবর? কি হচ্ছে? জামিনের ব্যাপারে উকিল কি বলছেন, তা তো কেউ আমাকে জানাচ্ছে না। ক নিশ্চয়ই জানেন কিছু। ক কোনও খবর দিচ্ছেন না..
ঝ বললেন, বিদেশি অ্যামবেসিগুলো থেকে ৩০ জন অ্যামব্যাসাডার দেখা করেছে ফরেন সেক্রেটারি আর হোম সেক্রেটারির সাথে। তোমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন তাঁরা।
–আমার সম্পর্কে?
–হ্যাঁ তোমার সম্পর্কে। ইউরোপ আর আমেরিকার অ্যামবাসাডাররা জানতে চেয়েছেন তোমার ব্যাপারে সরকার কি করছে, তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা হচ্ছে না কেন!
–কি করে জানেন?
–অবজারভারে ছাপা হয়েছে।
–ও।
–মিনিস্ট্রি থেকে বলে