তেরো জুলাই, বুধবার
কালও কোনও পত্রিকা ছিল না, আজও নেই। ঝর দেখা নেই। ঝ যখন ঢুকলেন ঘরে, তখন রাত। দুদিন পর খাবার জুটল। খাবার গিলতে গেলে গলায় যন্ত্রণা হয়। রাত দশটার দিকে ক আর ঙ এলেন। নিঃশব্দে এলেন। ওঁরা নিঃশব্দেই আসেন। নিঃশব্দে এসে নিঃশব্দে চলে যান। কথা যখন বলেন, প্রায় নিঃশব্দেই বলেন। ওঁরা এলে ওঁদের এই জগতের কেউ বলে মনে হয় না। যেন স্বর্গ থেকে দেবদূত এলেন। স্বর্গ বলে কোথাও কিছু নেই জেনেও আমার এরকমই মনে হয়। ওঁরা জানেন সব, বোঝেন সব। আল্লাহর ওপর লোকে যেমন নিজের জীবনটির দায়িত্ব দিয়ে ভারমুক্ত হয়, আমিও তেমন ওঁদের কাছেই জীবনের দায় দায়িত্ব দিয়ে বসে আছি। নিজের ওপর আমার বিশ্বাসটুকু অনেককাল হারিয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস এখন ওঁদের ওপর। ওঁরা ইচ্ছে করলে আমাকে বাঁচাতে পারেন, ইচ্ছে করলে বাঁচাতে ওঁরা নাও পারেন। ওঁরা যতক্ষণ থাকেন, ততক্ষণ আমি নিজের কোনও অস্তিত্ব অনুভব করি না। ওঁদের মুখে দেশে ঘটতে থাকা নানারকম তাণ্ডবের গল্প শুনি। আমার কিছুতেই মনে হতে থাকে না যে যাবতীয় তাণ্ডব এই আমি মানুষটির জন্য। মনে হয় তসলিমা নামের মেয়েটি অন্য কেউ। ওঁদের সঙ্গে সঙ্গে তসলিমার জন্য আমিও দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কী এক ঘোরের মধ্যে থাকি যে মনে হয় না ওঁরা বসে আছেন বা কথা বলছেন বা শুনছেন। ওঁরা চলে গেলে বুঝি ওঁরা এসেছিলেন। ঙ জানালেন সরকারের সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিকদের দীর্ঘ দীর্ঘ বৈঠক হচ্ছে। আমার উকিলের সঙ্গেও বৈঠক হচ্ছে। কিন্তু সরকার রাজি নয় আমাকে জামিন দিতে। ঙর হাতে চুল।টর বাড়িতে যে পরচুলাটি ফেলে এসেছিলাম, সেটি তিনি নিয়ে এসেছেন। চুল হাতে নিয়ে বসে থাকি। ভাবলেশহীন মুখে বসে থাকি। স্পন্দনহীন বসে থাকি।
ক আর ঙ দুজন দেশের যে সব কথা মুখে শোনালেন, হাতের পত্রিকা খুলে পড়ে শোনালেন আমাকে, তা হল, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো যে যৌক্তিক, তা বলে বেড়াচ্ছেন চারদিকে। সরকারি আদেশেই বলছেন সব। যেসব পত্রিকায় আমার খবর ছাপা হচ্ছে, সবকটি পত্রিকায় চিঠি লিখে জানাচ্ছেন যে বাংলাদেশ সরকার যা করেছেন ঠিক করেছেন। ওয়াশিংটন পোস্টে আমাকে নিয়ে লেখা একটি সম্পাদকীয় নিয়ে তিনি আপত্তি করছেন। অন্যের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত দিয়ে আমি নাকি বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ আইন অমান্য করেছি। একশ বছরের বেশি আগে ব্রিটিশ সরকার ২৯৫ ক নামক আইনটি চালু করেন। আইনটি আমার নয় তার নয়, একেবারে খোদ ব্রিটিশের আইন। সুতরাং এই আইন সভ্য হতে বাধ্য!
একবারও কি হুমায়ুন কবীর লোকটি ভেবেছেন যে একশ বছর আগের পুরোনো জিনিস সবসময় নতুন জীবনে আর জগতে খাটে না, সময় গেলে পুরোনো মূল্যবোধ, পুরোনো আইন, পুরোনো মানসিকতার সংস্কার করতে হয়! একবার কি খবর নিয়ে দেখতে চেয়েছেন, ইংরেজরা নিজেরা এই আইনটি আর ব্যবহার করে কি না! গণতন্ত্র কাকে বলে তাও শিখিয়েছেন হুমায়ুন কবীর। নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব তসলিমার মৌলিক অপরাধের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ আর অসন্তোষের ব্যাপারে সাড়া দেওয়া।
এদিকে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ বিশাল এক সমাবেশের আয়োজন করেছে, ওতে যোগ দেওয়ার জন্য আর ২৯ জুলাইএর লং মার্চ সফল করার জন্য জনগণকে আহবান জানিয়ে বায়তুল মোকাররমের খতিব, শায়খুল হাদিস, চরমোনাইএর পীর, ব্যারিস্টার কোরবান আলী, আনোয়ার জাহিদ সকলে মিলে একটি বিবৃতি দিয়েছেন, বিবৃতিটি এরকম। জ্ঞ৩০ জুনের হরতালের অভূতপূর্ব সাফল্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের বারো কোটি মুসলমান এই রায় ঘোষণা করেছে যে বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং এই রাষ্ট্রের কোনও নাগরিকের কোরান অবমাননা