আচ্ছন্ন দিনগুলি
নীলা তখন ঘোরে, মালাবারে, আর ঘরে বিকশিত ধবল দস্তরাজি—সহাস্য সুশান্ত, স্নাত সুগন্ধিত, আয়েশি ভর্তার মতো হস্তদ্বয় প্রসারিত করে শোভনাঙ্গী স্বৈরিণীর পিনোন্নত পয়োধরে। সুখদ সম্মোহে সম্ভোগে সম্মত নীলা, মহাসুখসম্প্রপ্তি সমাপনে সুশান্ত শ্ৰান্তপ্রশান্ত।
মেঘ সরে যেতে দুধেল পূর্ণিমায় নক্ষত্র বিভ্রম কাটে, নেকড়ের জ্বলন্ত চোখ ঝলসে দেয় তার সর্বাঙ্গ।
থিরথির কাঁপে শীতে, পায়ের কাছের কাঁথাটি গায়ের ওপর টানতে গেলেই ওটি কেড়ে নেয় এক হিংস্র থাবা, যেন হাত থেকে আঙুল কেড়ে নিচ্ছে কোনও আততায়ী, আর্তনাদ করে ওঠে নীলা।
তোমার গায়ে জ্বর। কাঁথায় ঢেকো না। চোখের সামনে মূর্তিমান সুনীল।
ধীরে বালিশে মাথা রেখে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে নীলা, আপনি এখানে কী করছেন?
সুনীল দম টেনে হাসে, অদ্ভুত শোনায় সে হাসি।
আশঙ্কায় কুকুরকুণ্ডুলি হয়ে নীলা শোনে, কিষানের খবর রাখো? ও তো ডিভোর্সের ব্যাপারে উকিলের সঙ্গে কথা বলেছে।
কুণ্ডুলির চতুষ্পার্শ্বে আরও মুঠো মুঠো শব্দ ছুঁড়ে দেয় সুনীল, চৈতালির সঙ্গে সম্পর্কটা তার ভাল যাচ্ছে না। ওর মেজাজ আজকাল বেশ খিটখিটে হয়ে উঠছে। রাতে এক বিছানায় শোয়া হয় বটে, স্পর্শ করে না পরস্পরকে। এভাবে কোনও পুরুষমানুষের যে চলে না, তা চৈতালির বোঝা উচিত। অনেকক্ষণ থেমে সরু গলায় বলে, ওকে আসলে বিয়ে করাই উচিত হয়নি আমার। খুব অন্য প্রকৃতির মেয়ে। এ বাড়ির জন্য কাগজপত্র দেওয়াতে চৈতালি খুব রাগ করেছে। তোমার জন্য চাকরির খোঁজ করতেও বাধা দিচ্ছে। বলে, বউ বাচ্চা সংসার ফেলে এত নীলা নীলা করো কেন, কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর আছেই। উফ…
সুনীলের উফ শেষ না হতেই দরজায় শব্দ। তড়িঘড়ি জামা চড়িয়ে, কুণ্ডলির ওপর কাঁথা ছুঁড়ে সুনীল দরজা উদোম করে, বেনোয়া।
কুণ্ডলির ওপর কোমল একটি হাতের স্পর্শ। ওদিকে আসি বলে স্বচ্ছন্দে চলে গেছে সুনীল। টেবিলের ওপর রেখে গেছে কলকাতা থেকে নিখিলের পাঠানো চিঠি।
বেনোয়ার হাতে রঙিন কাগজে মোড়া উপহার, আর লাল একটি গোলাপ।
সুদূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ নীলার, ওই লোকটি আমাকে ধর্ষণ করেছে।
.
নীলাকে, নীলার সমস্ত উত্তাপ বুকে জড়িয়ে হু হু করে কাঁদে বেনোয়া।
আঙুলে বেনোয়ার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে নীলা বলে, জানি না, হয়তো আমিই চেয়েছিলাম। মাথার ঠিক ছিল না।
আমার ওপর রাগ করে, আমি জানি।
কষ্টে ভরা আবেগ নিয়ে বেনোয়া বলে, এই আমি তোমার পাশে আছি, আমি ছাড়া আর কেউ তোমাকে ছুঁতে পারবে না। আমি তোমাকে সব দেব, সব।
সত্যি দেবে? আলুথালু বেশ, উড়োখুড়ো চুল, যেন ধুলোর ঝড়ে পড়া মেয়ে নীলা, কাতর স্বরে উদ্ধার ভিক্ষে চাইছে।
বেনোয়া কথা দেয়, নীলাকে ছেড়ে আর সে কোথাও যাবে না। নীলাকে নিরাপত্তা দেবে সে।
রঙিন কাগজ আর ফিতে খুলে নিলে বের হয় বোদেলেয়ারের সবগুলো কবিতার বই। নীলার তপ্ত শুষ্ক ওষ্ঠ সিক্ত হয় প্রেমার্দ্র চুম্বনে। আরও সিক্ত হতে চায় নীলা, প্লাবনে ভাসতে চায়। বেনোয়া বলে, আগে সেরে ওঠো, তারপর।
বেনোয়ার হাতটি নিয়ে নীলা তার কপালে রাখে, ইচ্ছে এভাবে কপালে হাত রেখে বেনোয়া বলুক, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। জ্বর হলে মলিনা যেরকম ক্ষণে ক্ষণে হাত রাখতেন কপালে, আর বলতেন ইস জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা, নীলার ইচ্ছে করে বেনোয়া বলুক অমন উদ্বিগ্ন স্বরে, জলপট্টি দিক কপালে মলিনা যেমন দিতেন, গলায় তোয়ালে পেঁচিয়ে মাথাটি বিছানার কিনারে এনে বদনিতে জল ঢালতেন মাথায়, জল গড়িয়ে নীচের বালতিতে পড়ত। নীলার ইচ্ছে করে বালিশের কাছে থোকা থোকা আঙুর এনে বেনোয়া রাখুক অনির্বাণ যেমন রাখতেন, দুর্বল হাতে একটি একটি করে সে আঙুর মুখে দেবে। মলিনা যেমন শিংমাছের পাতলা ঝোলের সঙ্গে জাউভাত করে এনে মুখে লোক তুলে দিতেন, তেমন দিক বেনোয়া।
কপাল থেকে হাতটি সরিয়ে বেনোয়া বলে, তুমি কি অসুস্থ বোধ করছ?
নীলা বলে, সে ঠিক আছে।
ইচ্ছেগুলো চেপে রেখে জিজ্ঞেস করে জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আমার গা তাই না?
ও তা তো জানি না। তুমি কি দেখতে চাচ্ছ তোমার জ্বর কত? ঠিক আছে আমি তোমাকে জ্বর মাপার যন্ত্র এনে দিচ্ছি।
জ্বর মাপার যন্ত্রটি স্নানঘরে রাখা ওষুধের বাক্স থেকে এনে নীলার দিকে বাড়াতেই নীলা