দরজায় তালাবন্ধ করে রাখা

দরজায় তালাবন্ধ করে রাখা হয় আমাকে। বাবা বলেন–আমার মেয়ে হয়ে যা

দরজায় তালাবন্ধ করে রাখা হয় আমাকে। বাবা বলেন–আমার মেয়ে হয়ে যা তা করে বেড়াবে, এ আমি সহ্য করব না।

 

দরজার তালা খুলে মা আমাকে তিনবেলা খাবার দিয়ে যান। এ যে কী অসহনীয় অবস্থা তা আমি ছাড়া আর বুঝবে কে। আমার কান্নাও পায় না আজকাল। বরং জেদ হয়। ভীষণ এক জেদ হয় আমার। এইসব আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। দরজা ভেঙে বেরোব, এ আমার শক্তিতে কুলোবে না, শরীরের শক্তিতে না পারি, মনের শক্তিতে কখন দরজা খুলে বেরিয়ে যাই, বেরিয়ে চাকরি বাকরি করি, পড়াশুনা করি, যেমন খুশি থাকি, যেমন ইচ্ছে বাঁচি।

 

শনিবার পার হয়ে যায়। আমার বেরোনো হয় না। আলতাফের পরামর্শে আমাকে আটকে রাখা হচ্ছে এরকম ধারণা করি। আমার বাবা মা আমার ব্যাপারে নির্মম জানি কিন্তু এত নির্মম তা আমার বিশ্বাস হয় না। এভাবে আটকে থাকব আমি কতদিন, আমাকে তো বেরোতেই হবে। বাড়িতে ফিসফিস বলাবলি হয় আমি যেহেতু লতিফ নামের এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যেতে চাচ্ছি, তাই আমাকে আটকে রাখা হচ্ছে। এসবের কোনও প্রতিবাদ করতেও আমার ঘৃণা হয়। তাদের ভুল একদিন ভাঙবেই, যদি মন বলে কিছু থাকে তাদের, অনুতপ্ত হবে নিশ্চয়। ঘরের দু’একটা বই নাড়া চাড়া করি। পড়ায় মন বসে না। লেখায়ও না, লিখতে গেলেই দীর্ঘশ্বাস বেরোয় বুক চিরে, কাকে লিখব, কে আছে আমার আপন। খুব দুঃখের রাতে কার কথা ভেবে চোখের জল ফেলব, এমনিই নিঃস্ব আমি, এমনই একা; আমাকে এই সভ্য দেশে, একটি সভ্য শিক্ষিত পরিবারে তালাবন্ধ করে রাখা হয়, কথা বলবার, চলবার, ফিরবার সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

 

একদিন দুপুরে মা ভাত নিয়ে ঘরে ঢুকতেই, তখন সাতদিন কেটেছে আমার ঘরবন্দি জীবন, আমি মাকে এক ঝটকায় সরিয়ে চলে যাই ঘরের বাইরে। বাঘের অরণ্য থেকে হরিণ যেভাবে পালায়, আমিও উধশ্বাসে ছুটি, কোথায় যাব কোনদিকে যাব না ভেবেই ছুটতে থাকি। পরনে আমার মলিন জামা কাপড়। রাস্তার লোকের চোখে কৌতূহল উপচে পড়ে, একটি মেয়ে এমন দৌড়োয় কেন। পেছনে ফিরি না। পেছনে আমার ধরবার জন্য ছুটে আসছে কিনা বুনো মোষের দল–ফিরে দেখি না। একটি স্কুটার নিয়ে সোজা চলে আসি পাপড়িদের বাড়িতে। পাপড়ি অবাক হয় না। সব জানবার পর বলে–নো প্রবলেম, তুই থাক কদিন আমাদের বাড়িতে। দুর্গতি যেমন আমার জীবনে বারবারই আসে, হঠাৎ হঠাৎ সাফল্যও কোত্থেকে জানি না হাতের মুঠোয় চলে আসে। চারদিক বিরূপ যখন, তখনই দেখি কারও প্রসন্ন মুখ। সকলেই যখন ফিরিয়ে নেয় চোখ, ধু ধু শূন্যতার ভেতর কেউ হয়ত বাড়ায় তখন ভালবাসার হাত। পাপড়ির বাবা শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান মানুষ। আমাকে বললেন সাহস যখন করছ, মাঝপথে থেমে যেও না। গন্তব্যে পৌঁছুবার চেষ্টা করো। ইচ্ছে থাকলে কী না হয়। বাধা তো থাকবেই পদে পদে। এগোয় তো অনেকেই, বাধা পেয়ে বেশির ভাগই থেমে যায়।

 

পরদিন সকালে মতিঝিল যাই, চাকরিটি আমার প্রয়োজন। মনজু কাকা আমাকে বসিয়ে রেখেই এপয়েন্টমেন্ট লেটার তৈরি করে দিতে বলেন এডমিনিস্ট্রেশান অফিসার জালাল সাহেবকে। ছোট কাজ, আত্মীয় বলে খাতির নেই। টেলিফোন অপারেটর কাম অফিস এসিসটেন্ট। বেতনও খুব বেশি নয়। তিন হাজার টাকা।

 

মনজু কাকা বলেন–এত কম টাকায় তোমার হবে তো?

 

আমি খুশিতে ফেটে পড়ি। বলি–কোনও দিন কি এত টাকা আমি উপার্জন করেছি? এরচেয়ে বেশি টাকা হাতে পেয়েছি। কিন্তু সে ছিল অন্যের টাকা।

 

মনজু কাকা আপাদমস্তক


Rx Munna

447 Blog posts

Comments