বাবা খুব ঘটা করে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলে দেখতে ভাল, চরিত্রবান, মদ বা মেয়েমানুষের নেশা নেই। ভাল চাকরি করে। পাড়ায় তার সুনাম আছে। এমন ছেলে পছন্দ না হয়ে উপায় আছে! আমি তখন সবে হায়ার সেকেণ্ডারি দিয়েছি। দেখতে সুন্দরী। লোকে বলে, তাছাড়া আয়নায় দেখি। গায়ের রঙ ফর্সা, খাড়া নাক, চোখ বড় বড়, চিকন ঠোঁট। লম্বায় আমি পাঁচফুট পাঁচ। আর কী চাই! ছোটবেলায় খালারা বলতেন—’হীরার আর চিন্তা কী! ভাল জামাই পাবে।’ আমার ঘন কালো চুল পিঠের নিচে পড়ে। মা রিঠা দিয়ে চুল ধুয়ে দিতেন আর বলতেন–এমন মেয়ে লাখে নেই। আমি যে ভাল বিকোব, তা আমার বারো বছর বয়স থেকেই আমাকে জানানো হয়েছে। আমার এক ফুপু আমার দু’বছরের বড়, তিনি প্রায়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন-তোমার তো লেখাপড়া না করলেও চলবে।
আমি বলতাম–কেন?
ফুপু বলতেন–তোমার তো ভাল বিয়ে হবেই। ভাইজান বলেছেন এখন থেকেই নাকি বড় বড় বিয়ের ঘর আসছে তোমার।
ফুপু চাইতেন তাঁরও বিয়ে হয়ে যাক, পড়ালেখার ঝামেলা চুকুক। কিন্তু চাইলেই কী। হয়। ফুপু ছিলেন খাটো, কালো, তায় দাঁত উঁচু। ফুপুর পার হতে যে সময় লাগবে তা ফুপুও বুঝতেন।
আমি খুব বেশি সুন্দরী বলে স্কুল কলেজে কখনও আমাকে একা যেতে দেওয়া হয়নি। সঙ্গে একটি লোক দেওয়া হত। কবে আমার বিয়ে হবে আর এইসব পাহারা থেকে মুক্ত হব আমি সেকথাই ভাবতাম। আলতাফকে সবাই যখন পছন্দ করল আমার আপত্তি করবার কিছু ছিল না। আপত্তি করবই বা কেন, কার জন্য? এমন কেউ তো ছিল না যার জন্য বাড়ির পছন্দে ভেটো দেব। বাদলের সঙ্গে যেটুকু কথা হত, চোখে চোখেই হত। ও আমার এক ক্লাস উপরে পড়ত। আমাকে যেচে নোট দিত, সালেহার হাতে পাঠাত। সালেহা ছিল আমার ক্লাসমেট, ওদিকে বাদলের বোন। ওর নোটের ভেতর ছোট ছোট চিঠি থাকত। আমাকে ভালবেসে তার মরে যেতে ইচ্ছে করে এইসব লেখা থাকত চিঠিতে। আমি কখনও কোনও উত্তর দিইনি, বাদলকে যে আমার ভাল লাগত না তা নয়। আসলে আমার ভয় করত খুব, বাবাকে ভয়, রাস্তার ছেলেপেলেদের দিকে তাকাতে বারণ ছিল বাবার। বলতেন—’কলেজে সোজা যাবে, সোজা আসবে। কোনও দিকে তাকাবে না। লোকে যেন ভাল বলে এই ভাবে চলবে। কোনও বদনাম যেন কেউ করতে না পারে।’ আলতাফের সঙ্গে বিয়ে হলে সারাজীবন আমি রাজরাণী হয়ে থাকব এমন কথা আমার আত্মীয় স্বজন বলেছে, পাড়া পড়শিও বলেছে। রাজরাণী হবার খুব যে ইচ্ছে আমার ছিল তা নয়। কিন্তু বাবা মা আর বড় দুই ভাইএর স্বপ্নকে ভেঙ্গে দেব এমন ইচ্ছে আমার হয়নি কখনও, তাই ওঁরা আমাকে লক্ষ্মী মেয়ের মত যেদিন বিয়ের পিড়িতে বসতে বললেন, আমি বসেছি।
.
আলতাফ পি ডব্লু ডির ইঞ্জিনিয়ার। গুলশানে বাড়ি আছে নিজেদের। ইস্কাটন থেকে ফুল সাজানো গাড়ি করে আমি গুলশানে চলে এসেছি সে অনেকদিন। আলতাফ সুদর্শন যুবক একথা মানতে আমার কোনও আপত্তি নেই। বিয়ের আগে ওর সঙ্গে আমার কোনও কথা হয়নি। বাবা দেখেছেন, বাড়ির সবাই দেখেছে, আমার দেখবার দরকার কী! ছবি দেখেছি শুধু। ফুপু বলেছেন–কী যে সুন্দর তোমার বর, দুজনে চমৎকার মানাবে। আমাদের যে. মানাবে ভাল, তা আমিও মনে মনে বুঝতাম। সুন্দরের প্রতি আমার পক্ষপাত তো ছিলই সবসময়। কিন্তু বিয়ের একমাসের মধ্যে আমি যখন সুটকেস নিয়ে বাবার বাড়ি ফেরত এলাম, সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল–আলতাফ কোথায়?
–আসেনি। আমি একা এসেছি। আমার নির্লিপ্ত উত্তর।
–একা? একা কেন?
এর উত্তর আমার জানা ছিল না। বিত্তবান চরিত্রবান স্বামী রেখে বাবার বাড়ি একা একা চলে আসা যে উচিত হয়নি আমার, তা আমাকে বাড়ির সবাই তাদের কথা এবং ব্যবহারে বুঝিয়ে দিল। বাবার বাড়িতে বেশিদিন থাকা হয় না আমার। শাশুড়ি নিজে গিয়ে নিয়ে আসেন। বলেন–’বিয়ের পর ঘন ঘন বাবার বাড়ি এলে লোকে খারাপ বলে। আমার মা বাবাও বলেন—’ওঁরা যখন আসতে বলবেন, তখন এস। নিজের ইচ্ছেয় এস না আর। বিয়ে হয়েছে, এখন ওঁরা যা বলেন, যেভাবে চলতে বলেন, সেভাবে চলবে। নাহলে লোকে