মেয়েরা মাথা নুয়ে মুখ বুজে জীবন কাটাতো, সেই মেয়েরা, সেই সিঙ্গুরের মেয়েরা আজ পুলিশের মার খাচ্ছে। যে মেয়েরা ঘরের বাইরে বেরোয়নি কোনওদিন, কলিকাত্তার বাঙ্গি দেখেনি, আজ অনশন করছে। পুরুষও করছে অনশন। সিত্রুর থেকে ঘুরে এসে এক বন্ধু বলল, ‘পুরুষেরা যারা অনশন করছে, তারা তাদের সরকার বিরোধিতার পরিণতির কথা ভেবে ভয়ে এবং দুশ্চিন্তায় বিবর্ণ। কিন্তু অনশন করা মেয়েদের মধ্যে অসম্ভব তেজ ও দৃঢ়তা। মেয়েরা বলছে, মরলে মরবো। এত দৃঢ়তা, এত তেজ!’ কোথায় পেল মেয়েরা এত মনের জোর? কুড়ি থেকে সঙ্গের, সব বয়সী মেয়েদের জোর একইরকম। কেউ আপোস করবে না। পিছু হটবে না। দেখে ভালো লাগে। মনে পড়ে পশ্চিমের দেশগুলোয় ভোটের আন্দোলনের জন্য মেয়েদের পথে নামা! পথে পথে পুলিশের অত্যাচার সওয়া। এবং এক বিন্দু দমে না যাওয়া। মনে পড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশে দেশে মেয়েদের ভূমিকা। পুরুষেরা আপোস করছে। মেয়েরা করছে না। এই যে মেয়েদের আপোসহীন, সংকল্পে সিদ্ধান্তে অসংকুচিত চরিত্রের খবর আমরা পাচ্ছি, কোথায় যায় এই চরিত্রগুলো? চার দেয়ালের ভেতর যেই না ঢুকে গেল মেয়েরা, অমনি তাদের টুঁটি টিপে ধরা হয়। কণ্ঠরোধ করা হয়। পায়ে শেকল পরানো হয়। অসম্ভব তেজ আর দৃঢ়তা নিয়ে তারা ঘরে ঘরে পচে মরে। দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হলেই একমাত্র তাদের চোখে পড়ে। মিছিলের অগ্রভাগে মেয়েরা। ঘোমটা ফেলে বোরখা ছুড়ে বেরিয়ে আসা মেয়ে। ঘরে ঘরে কে বন্দি করছে মেয়েদের? কী নেই মেয়েদের যে শক্ত দেওয়ালটা ভাঙতে পারছে না! যদি কেউ কেড়েই নিয়ে থাকে হাতুড়ি, মেয়েরা কি পাল্টা কেড়ে নিতে পারে না? পারে না ভাঙার জন্য অন্য কোনও হাতুড়ি যোগাড় করতে? মেয়েদের এত সততা এবং সাহস, অনড় মন কোথায় হারায়? কে হত্যা করে তাদের? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি। জেনেও বেশির ভাগই মুখ বুজে থাকি। ভান করি না-জানার।
মনে প্রশ্ন জাগে, ছিনিয়ে নেওয়া সিঙ্গুরের কোনও জমি কি আদৌ মেয়েদের ছিল? নাকি ছিল মেয়েদের বাবার, মেয়েদের স্বামীর, মেয়েদের ভাইয়ের? মেয়েদের অধিকারে কিছু নেই, মেয়েদের মঙ্গলের জন্য কিছু নেই, কিন্তু মেয়েদের দ্বারাই সহায় সম্পত্তি সব রক্ষা হয়। রক্ষা মেয়েরাই করে। মেয়েরাই একএকসময় দেখি পরোয়া করে না কোনও দুঃসময়ের, কোনও দুঃসহ দুর্দিনের। ঝুঁকি নিতে পারার ক্ষমতা গোটা পৃথিবীতে মেয়েদেরই বেশি। মেয়েরা তা প্রমাণ করেছে বহু বহু বার। ঝুঁকি নিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। কিন্তু তারপরও মেয়েদের দৃঢ়তাকে ঋজুতাকে ঘরে বাইরে সর্বত্র হত্যা করার আয়োজন করে নোংরা পুরুষতন্ত্র।
পুরুষেরা যুদ্ধ করে। যুদ্ধে জয়ী হয়ে পরাজিত সৈন্যের জিনিসপত্র লুঠ করে। ভিটেমাটি, ঘটিবাটি, বাড়ি, নারী। আদিকাল থেকে এরকমই নিয়ম পুরুষের। পুরুষ কখনও মেয়েদের আলাদা অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। চিরকালই মেয়েরা পুরুষের নিজস্ব জিনিস। পুরুষেরা তাদের জিনিসগুলোকে যা ইচ্ছে তাই করে, করার অধিকার তাদের আছে বলেই মনে করে। যুদ্ধে মেয়েদের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। যুদ্ধে না অংশ নিয়েও তারা খুন হয়, ধর্ষিতা হয়, তারা উদ্বাস্তু হয়, অনাথ হয়, তারা নিঃসঙ্গে হয়, সর্বস্বান্ত হয়। যুদ্ধবাজ পুরুষের দুর্ভোগ তত হয় না, যত দুর্ভোগ পোহাতে হয় মেয়েদের। যুদ্ধে যুদ্ধে পুরুষের মৃত্যু হয়, আর যুদ্ধবাজ স্বামীর স্ত্রীরা পুত্রকন্যা নিয়ে যে দুর্ভোগ পোহায়, সেই দুর্ভোগ কে কোথায় আছে ভাগ করে!
আমি যুদ্ধবিরোধী মানুষ। পারমাণবিক বোমার মতো অমানবিক জিনিসে ছেয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। মারণাস্ত্রের পেছনে যত অর্থ ব্যয় হয় তার অতি সামান্যই কমিয়ে দিলে আজ সারা বিশ্বের সব মানুষের খাদ্য শিক্ষা চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিন্তে হয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধবাজ পুরুষেরা তা করবে কেন! শান্তি শান্তি বলে কম চিৎকার তো হচ্ছে না। বিশ্বময় যত অশান্তিই পুরুষ করুক, শান্তি পুরস্কার পুরুষেরই জোটে। শান্তির জন্য তারা করেনা কিছুই। আজকাল অবশ্য শান্তি পুরস্কারও হয়ে গেছে পুঁজিবাদের পোষ্য। দরিদ্রকে ঠকিয়ে ঠেঙিয়ে নির্বিঘ্নে ধনসম্পদ গড়ে তুলতে পারলেও শান্তি পুরস্কার হস্তগত হয়। পুরুষেরা পছন্দ করে অস্ত্র, মারণাস্ত্র, পছন্দ করে যুদ্ধ। হিংসা। পছন্দ করে রক্তপাত।
আমেরিকার প্রেসিডিন্ট ডুয়াইট ডেভিড আইসেনহাউয়ারকে আমি পছন্দ না করতে পারি, কিন্তু তাঁর এই কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে মানি—‘প্রতিটি বন্দুক তৈরিতে, প্রতিটি যুদ্ধ ঘটাতে, প্রতিটি রকেট ওড়াতে, যে টাকার দরকার হয় তা তাদের কাছ থেকে চুরি করা যারা ক্ষুধার্ত, যাদের খাবার নেই, যারা ঠাত্তায় কষ্ট পাচ্ছে, যাদের কাপড় নেই।’
সেদিন রবীন্দ্রসদনে, নন্দন চত্বরে হাঁটছিলাম। রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে দেখি নৃত্যানুষ্ঠান। কয়েক হাজার দর্শক। আর খানিক দূরেই পাঁচ ছজন বসে আছে মানবাধিকার সংস্থার আয়োজনে সিঙ্গুরে পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদ সভায়। দেখে মন খারাপ হল খুব। নাচে গানে এত লোক, প্রতিবাদে নেই! মানবাধিকারে নেই! মানুষের জন্য কি মানুষ আর তবে কাঁদে না? পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, তারপরও বলবো, অন্তত এই সিত্রুর প্রসঙ্গে একজোট হয়েছে, কথা বলছে। সকলে শান্তি