ছোটবেলায় আমিও ছেলে হয়ে যেতে চাইতাম। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে দেখবো আমি ছেলে হয়ে গেছি। আমি তখন বাবা মার আদর পাবো বেশি, যত্ন পাবো বেশি, যা চাই তাই আমাকে দেওয়া হবে। দামি খেলনা চাই, পাবো। ফ্যাশনের জামা জুতো, পাবো। আমাকে খেতেও দেওয়া হবে সবচেয়ে ভালো খাবার। যেখানে খুশি যেতে পারবো, শহরের বড় মাঠগুলোয় খেলতে পারবো। কেউ আমাকে বাধা দেবে না। আমার সাধ আহ্লাদ সব মেটানোর জন্য একশ একজন দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি রাজা, আমি বাদশাহ, আমি পুত্র, আমি জগত, আমি ভগবান।
যত বড় হতে থাকি, ততই দুর্ভোগ বাড়ে। মেয়ে বলে মুখ ঝামটা, গালাগালি। কথায় কথায় চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান। ঘরের কোণে বসে বসে চোখের জল ফেলি আর ভাবি ‘ছেলে তো কত কেউ হঠাৎ হয়ে যায়, আমি কেন হতে পারি না!’ স্তনের দিকে পুরুষের লোলুপ চোখ, সুযোগ পেলেই থাবা দিচ্ছে। ঋতুবতী হওয়ার পরই শুনি আমি অপবিত্ত। এটা ছোঁয়া যাবে না, ওটা করা যাবে না। মেয়ে বলে আমাকে দিন রাত তটস্থ থাকতে হত, এই বুঝি কেউ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, ধর্ষণ করবে নয়তো গলা টিপে মেরে ফেলবে। এই বুঝি অ্যাসিড ছুড়বে মুখে, এই বুঝি সারা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেবে, ঠাত্তা মাথায় কুপিয়ে মারবে।
ছেলে হয়ে যেতে পারলে নিশ্চিন্ত হতাম। ভয় যেত। আরামে বাঁচতাম। পরিবার থেকে সমাজ থেকে আইন থেকে রাষ্ট্র থেকে সবসরকম সহযোগিতা পেতাম। মন দিতে পারতাম লেখাপড়ায়, গবেষণায়, অর্জনে, উপার্জনে, জীবন যাপনে। কিন্তু মেয়ে হয়েছি বলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যায় নিজের নিরাপত্তা রক্ষায়। কাজে মন দিতে হয়, একই সঙ্গে অগুনতি থাবা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। কোনওদিনই নিশ্চিন্তে রাস্তায় একা হাঁটতে পারিনি, পার্কে বেড়াতে পারিনি, নদীর ধারে বসে থাকতে পারিনি, সমুদ্রের সামনে দুদণ্ড দাঁড়াতে পারিনি। পুরুষের জগত এটি, এই জগতে আর কোনও কিছু, আর কেউ, কোনও প্রাণী এত নিরাপত্তাহীন নয়, যত নিরাপত্তাহীন নারী। শহরে, বন্দরে, গ্রামে, গজ্ঞে রাস্তায় ঘাটে মাঠে ক্ষেতে কখনও একা আমি নিরাপদ ছিলাম না, এখনও নই। নিজেকে রক্ষা করার জন্য আমাকে চিরকালই রক্ষী নিয়ে চলতে হয়েছে। কেউ না কেউ সঙ্গে থাকে আমাকে নিরাপত্তা দেবার জন্য, আমি একা আমার নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নই বলে। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের আইন, সমাজ, সমাজের রীতি নীতি কিছুই যথেষ্ট নয় একটি মেয়েকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। অনেকে এসময় ফোঁস করে উঠে বলবে, ‘পুরুষেরও তো অভাব নিরাপত্তার।’ তা ঠিক। পুরুষেরও অভাব। একটি পুরুষের নিরাপত্তার যে অভাব, সেই অভাব তো মেয়েদের আছেই, তার লক্ষগুণ বেশি অভাব মেয়েদের, মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে। এই সমস্যা কোনও পুরুষের নেই। প্রাণীজগতে অন্য কারওর নেই।
এই সমাজ নারী পুরুষ উভয়কে জন্মের পর থেকে শিখিয়ে আসছে যে পুরুষ একটু বেশি-মানুষ, নারী একটু কম-মানুষ। অনেক কিছু নারীর করতে নেই, বলতে নেই, চাইতে নেই, ভাবতে নেই। নারীর শরীর দুর্বল, মন দুর্বল। নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়। এই শিক্ষা পেতে পেতে নারীর ‘আত্মবিশ্বাস’ ভেঙে গুঁড়ো হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। মেয়েরা তাই একত্র হয় না, প্রতিবাদ করে না। রুখে ওঠে না। লাঙ্গি দেয় না। নারীবিরোধী সমাজের বিরুদ্ধে নারীরা কোনও টুঁ শব্দ তো করেই না, বরং আদরে আহ্লাদে আস্কারা দিয়ে একে মাথায় তুলে রাখে।
পুরুষেরা মনে করে সমাজে নারী পুরুষে যে বৈষম্য আছে, তা নারীর সমস্যা, তাদের নয়, এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করার দায়িত্ব নারীর, তাদের নয়। এই বৈষম্য বিলুপ্ত করার দায় নারীর একার। পুরুষেরা দায়দায়িত্বহীনের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই সমাজের সামান্য ভালোও যদি একটি পুরুষ চায়, তাকে বৈষম্য ঘোচাবার দায়িত্ব নিতে হবে। এক মানুষের আরেক মানুষকে অত্যাচার করে যাবার নিয়ম বহাল থাকলে কোনও সমাজ সুস্থ হয় না, সুন্দর হওয়ার প্রশ্ন তো নেইই। সমাজকে সুস্থ করার দায়িত্ব একা নারীর কেন, কেন দুজনেরই নয়! সমাজ তো নারী পুরুষ উভয়ের! এর মানে কি এই যে, পুরুষ চায় না বৈষম্য দূর করতে? পুরুষ চায় না সমতা? সমানাধিকার? চাইলে আজ ওপরতলায় যে মহান মহান পুরুষেরা বসে আছে, তারা এক ফুঁয়ে বৈষম্যকে শেকড়সুদ্ধ উড়িয়ে দিচ্ছে না কেন!
উড়িয়ে দিলে যৌন হেনস্থার সুযোগ পাবে না বলে! যে-পরিবারের বড়াই করে আসছে ভারতীয় সমাজ, সেখানেই জঘন্য অপরাধ ঘটে চলেছে। মেয়েশিশুদের ওপর চলছে যৌন হেনস্থা। বাবা কাকা দাদা জ্যাঠামশাই ঠাকুরদা দাদুর পরিবারে একটি ছোট্ট মেয়ে-শিশু নিরাপদ নয়।
‘দেশের ৫৩ শতাংশ শিশু কোনও না কোনওভাবে যৌন হেনস্থার শিকার। এর মধ্যে ধর্ষণ, পায়ুসঙ্গেম, যৌন নিগ্রহ থেকে শুরু করে জোর