কুমিল্লা নগরের মাত্রাতিরিক্ত ইজিবাইকের কারণে যানজট সমস্যা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, পথে নেমে জনজীবন প্রায় স্থবির হয়ে পড়ছে; নষ্ট হচ্ছে বহু কর্মঘণ্টা।
নগরবাসীর অভিযোগ, ২০১১ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা হলেও নগরের সড়কগুলোতে এখনো শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি করপোরেশনের কর্তৃপক্ষ। তাদের অব্যবস্থাপনায় বছরের পর বছর ধরে যানজট সমস্যা বেড়ে তীব্র আকার ধারণ করছে।
নগরবাসীর পাশাপাশি জেলা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ বলছে, নগরীতে যানজটের প্রধান কারণ, অনিয়ন্ত্রিত ইজিবাইক। বাহনগুলো স্থানীয়ভাবে ‘মিশুক’ নামে পরিচিত।
বিগত সময়ে সিটি করপোরেশন নগরে পাঁচ হাজার মিশুক ও এক হাজার পায়ে চালিত রিকশা অনুমোদন দেওয়ার পরিকল্পনা করে।
যদিও বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার ইজিবাইক নগরীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন থেকে জানা গেছে, ২০২৩ সালের জুনের মাঝামাঝি করপোরেশন থেকে এক জরুরি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। সেখানে সিটি এলাকায় যানজট কমিয়ে, অর্থনৈতিক ক্ষতি কমাতে নাগরিকদের কর্মঘণ্টা বাঁচানোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়।
তখন শপিং মলের সামনে পার্কিং খালি করা, সড়ক থেকে ভ্যান গাড়ি ও ফুটপাত থেকে দোকান উচ্ছেদ এবং যানবাহন সীমিতকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে নগরে ৬ সিটের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও নিবন্ধনহীন যানবাহন চলাচল করতে না দেওয়ার কথাও বলা হয়।
সিদ্ধান্ত হয়, পাঁচ হাজার ইজিবাইক ও এক হাজার পায়ে চালিত রিকশার নিবন্ধন দেওয়া হবে। নিবন্ধনধারী ইজিবাইকে রং লাগিয়ে দেওয়া ছাড়াও মিনিবাস চালুর সিদ্ধান্ত হয়।
২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে এসব কার্যকরের কথা বলা হলেও আজও তা কার্যকর হয়নি। বরং ৫ অগাস্ট পরবর্তী নগরের সড়কে কয়েক হাজার মিশুক ও অটোরিকশা বেড়েছে।
নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নগরের কান্দিরপাড় এলাকায় প্রবেশের তিনটি দিক, সালাউদ্দিন মোড়, চকবাজার, টমছমব্রিজ, শাসনগাছা, বাদশা মিয়ার বাজার, পুলিশ লাইনস, রেইস কোর্স, রানীর বাজার, রাজগঞ্জ, মনোহরপুর, ঝাউতলা, বাদুরতলা, ধর্মপুর এলাকা, জাঙ্গালিয়াসহ বেশ কয়েকটি স্থানে যানজট লেগেই থাকে।
সকাল ৮টা থেকে রাত অন্তত ৯টা পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হচ্ছে থেমে থেমে।
কুমিল্লা নগরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে পদুয়ার বাজার (বিশ্বরোড) এলাকার দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। এ পথটি সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়ায় চলাচল করেন বেশিরভাগ মানুষ। স্বাভাবিকভাবে পথটি পার হতে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট সময় লাগার কথা। কিন্তু তীব্র যানজটের কারণে এই পথটি পার হতে বর্তমানে সময় লাগছে ৩০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত। শুধু এই পথই নয়, পুরো নগরের অন্য সড়কগুলোর চিত্রও একই। এতে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়ে থমকে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা।
চালক ও যাত্রীদের ভাষ্য
নগরীর ঢুলিপাড়া এলাকার একটি গ্যারেজ থেকে ইজিবাইক ভাড়া নিয়ে চালান মো. আমিরুল নামে এক যুবক।
তিনি বলেন, প্রতিদিন চারশত টাকা মালিককে দিতে হয়। তাছাড়া সড়কে অন্য খরচও আছে। কিন্তু রাস্তায় যানজটের কারণে ২০-৩০ টাকার ভাড়া মারতেও অনেক সময় চলে যায়। পাঁচ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৩০ মিনিট। এতে দিনশেষে যে টাকা নিজের পকেটে থাকে, তা দিয়ে সংসারের খরচ চলে না।
জেলার মুরাদনগর থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে কুমিল্লা শহরে এনে ভাড়া বাসায় রেখে ইজিবাইক চালাচ্ছিলেন এইচএসসি পাশ মো. হানিফ।
তিনি বলছিলেন, ইজিবাইকের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ায় নগরীতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে তাদেরও আয়-রোজগারে প্রভাব পড়েছে। ফলে সংসারের খরচ কুলাতে না পেরে স্ত্রী-সন্তানকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন।
এসব ইজিবাইকের নিয়মিত যাত্রী নগরের হাউজিং এলাকার বাসিন্দা সামছুল আলম বলেন, সম্প্রতি কুমিল্লা নগরের যানজট সমস্যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে তীব্র আকার ধারণ করেছে। সড়কে নামলেই শুরু হয় দুর্ভোগ। শুধু প্রধান সড়কগুলোই নয়- গলির ভেতরও এখন তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
যা বলছে সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক বিভাগ
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছামছুল আলম বলেন, “বর্তমানে যানজট সমস্যা তীব্র, এটি সত্য। সমস্যা সমাধানে আমরা ট্রাফিক বিভাগকে নিয়ে বৈঠক করেছি। এছাড়া অতীতে যানজট নিরসনে যানবাহন সীমিতকরণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটিও আমরা কার্যকর করার চেষ্টা করছি।
“পাঁচ হাজার ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ও এক হাজার পায়ে চালিত রিকশার নিবন্ধন দেওয়ার জন্য যে আবেদন ফরম জমা নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোও আমরা যাচাই করে দেখছি। আমরা চেষ্টা করছি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে।”
কুমিল্লা জেলা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের ইনচার্জ পরিদর্শক কামাল পাশা বলেন, “যে যেভাবে পারছে, অটোরিকশা নামাচ্ছে। নগরের মালিক সিটি করপোরেশন, তারা সিদ্ধান্ত দেবে আর আমরা সেটা বাস্তবায়ন করব। কিন্তু এখনো সেটা সম্ভব হয়নি। আমরা মতামত দিয়েছি, নগরের ২৭টি ওয়ার্ডের প্রত্যেকটিতে ২০০ করে পাঁচ হাজার ৪০০ মিশুক ও রিকশার অনুমোদন দেওয়া হোক।”
তিনি বলেন, “সব মিলিয়ে সংখ্যাটা সর্বোচ্চ সাত হাজার হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৪০ হাজারের বেশি অটোরিকশা, সংখ্যাটা প্রতিদিনই বাড়ছে।
“তাহলে যানজট সমস্য আমরা দূর করব কীভাবে?”
তিনি বলেন, “সিটি করপোরেশন এই খাত থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে পারে। অনুমোদনের সময় যদি পাঁচ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়, তাহলে হিসাব করে দেখেন, কত টাকা হয়! এছাড়া প্রতি বছর লাইসেন্স নবায়নতো থাকবেই।”
কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শহর বলা হয় কুমিল্লাকে। প্রাচীনকাল থেকেই কুমিল্লা ছিল একটি সাজানো-গোছানো শহর। তবে সমন্বিত নগর পরিকল্পনা না থাকার কারণে গত এক থেকে দেড় দশকের মধ্যে কুমিল্লা নগরে যানজট সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করেছে।
তার দাবি, বর্তমানে নগরের সবচেয়ে বড় সমস্যা যানজট। নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহনের পাশাপাশি রাস্তাঘাট প্রশস্ত না করে যত্রতত্র অপরিকল্পিত উন্নয়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সড়কের মধ্যে প্রচুর হকার বসা এবং সর্বোপরি সঠিক নগর পরিকল্পনার অভাবে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছ